আমি তাকে স্বপ্ন কাকু বলেই ডাকতাম।
আমাদের বাড়িতে এলে প্রতিবার মাসখানেক থেকেই যেত স্বপ্নকাকু।
বাবা মাকে বলতো, আহা! তিনকুলে কেউ নেই এই আমি ছাড়া…কোথায় আর যাবে?
স্বপ্ন কাকু ভালো ছবি আঁকতে পারত। ক্যানভাসে
আর মনে।
বাড়িতে ঢুকেই ছবি আঁকার জিনিসপত্র সোফার উপর রেখে আমার কাঁধে হাত রাখত,
কী খুকি! আছো কেমন?
বারো বছরের কিশোরীকে খুকি বলা নিয়ে
গাল ফুলিয়েছি বহুবার
তবু কাকু আমায় ওই নামেই ডাকত।
সন্ধে হলে দেশ বিদেশের গল্প শোনাতো।
চুলে বিলি কেটে দিত।
মা ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ দিয়ে যেতে যেতে বলত
ঠাকুরপো! তুমি পারোও বটে!
আমার এমন চঞ্চল মেয়ে তোমার গল্পে একেবারে চুপ!
স্বপ্ন কাকু আমার ব্যাগের মধ্যে একটা ব্যাং এঁকে
ঢুকিয়ে রেখেছিল।
স্কুলে গিয়ে আমি ব্যাগ খুলতেই দেখি তাতে লেখা
খুকিকে…স্বপ্ন কাকু!
আমি বাড়ি ফিরে কাকুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
কাকুর বুকে আমার বুক
দুই হাতের মধ্যে আমার মুখ
তিরতিরে ঠোঁট…
তখন আমি বারো পেরিয়ে তের
তের পেরিয়ে চোদ্দ
ব্যাঙের ছবিটার নীচে লিখে রাখলাম
স্বপ্ন কাকু তোমায় ভালোবাসি।
সেবার যখন কাকু এলো আমাদের বাড়ি
আমি খুব ধরে পড়লাম তাকে,
আমাকে তোমায় আঁকতেই হবে কাকু!
কাকু অনেক ভেবে বললো, আঁকতে পারি
শর্ত আছে। সম্পূর্ণ হওয়ার আগে অবধি দেখতে
পারবে না।
তাই সই।
আমি শাড়ি পরেছি। চোখে কাজল দিয়েছি।
চুলে খোঁপা। রাতের রজনীগন্ধা তাতে।
গোটা ঘর ম ম করছে গন্ধে।
স্বপ্ন কাকুর মন পড়ার চেষ্টা করছি আমি।
মুখ আঁকার শেষে কাকু বললো,
এবার গলা, গলা বেয়ে
বুক…
আমি বুক থেকে শাড়িটা খানিক নামিয়ে দিলাম নিচে
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভাঁজ।
আলোড়ন কি কাকুর ভ্রুতে?
শান্ত কণ্ঠে কানে ভেসে এল সুর
যা নিভৃতে সুন্দর, তাকে রাখো অন্তঃপুরে।
দিন কয়েক পরে চুপিচুপি আমি স্বপ্নকাকুর ঘরে ঢুকি।
বাক্স প্যাটরা হাতরাই। যদি আমার কথা কিছু
লিখে রাখে তার নিত্য লেখা ডায়েরিতে!
এক গোছা চিঠি আলগোছে পড়ে যায় আমার হাতের
উপর…
প্রিয়তম,
তোমার দেওয়া নামই রাখলাম শেষে। অনিরুদ্ধ। দেখতে হুবহু তুমি।
প্রিয়তম,
এবার বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলে। তোমার ছেলেটি যে তোমার মতই শিল্পী হয়ে উঠছে, তা দেখে গেলে না!
প্রিয়তম,
তোমার সবচেয়ে প্রিয় আমার বুকের অতন্দ্র প্রহরী স্তন দুটোয় মারাত্মক অসুখ বাসা বেঁধেছে। ডাক্তার বলেছে বাদ না দিলে…
কই তুমি তো আর এলে না? স্তন বাদ গেছে বলে কি? শরীর ছাড়া আমার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?
একবার এস! ছেলেটাকে নিয়ে আমার স্বামী আমায় ফেলে চলে গেছে। আমার চরিত্রহীনতার প্রমাণ তোমার ছেলেই তাকে দিয়েছে তোমার দেওয়া চিঠি দেখিয়ে। অসুস্থ স্ত্রীকে ছেড়ে যাওয়ার এই তো মোক্ষম সুযোগ!
এলে না আর? দিলে না জবাব? আমার চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। চিঠিখানা আর পোস্ট করার ক্ষমতা নেই। যদি আসো, আমার কঙ্কালের পাশ থেকে নিয়ে যেও।
স্বপ্ন কাকু কখন যে এসে ঘরে ঢুকেছে, আমার হাত থেকে ভালোবাসা কেড়েছে
আমার কিচ্ছু মনে নেই।
চলে গেছে সেই শেষ বার…
ক্যানভাসের উপর চাপা দেওয়া সাদা কাপড় সরিয়েছি
এক টানে…
চুল ওঠা স্তন হীন অসুস্থ এক নারী!
নীচে লেখা,
ভালোবাসি। কিন্তু আমিও ফুরিয়ে এসেছি যে রমা!
আমার খোঁপার রজনীগন্ধা, ঠোঁটে গোলাপি
লিপস্টিক, শাড়ির পরিপাটি ভাঁজ কোথাও নেই
এক ফোঁটা…
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল বাবা।
মাকে বলেছিল, আহা আমরা ছাড়া কেউ তো নেই
ছেলেটার!
অনেক কষ্টে ধরে বেঁধে এক বছর পরে পুলিশ
একজন পাগলকে নিয়ে এল আমাদের বাড়ি
মুখ গাল ঠোঁট দাড়ি গোঁফে ভর্তি। মাথার চুল
ঘাড় ছাড়িয়েছে। সারা গায়ে আঁষটে গন্ধ
স্বপ্ন কাকুর কোনো চিহ্ন নেই তার মধ্যে
বাবা নাক সিটকে বললো, না না এ আমার ভাই নয়
মা বললো, ঠাকুরপো শিল্পী! পাগল তো নয়!
পাগল টা বিড়বিড় করছে, যা কিছু নিভৃতের
তাকে রাখো অন্তঃপুরে…
রমা! আমিও যে ফুরিয়ে গেছি!
আমি চিৎকার করে উঠলাম! অফিসার!
এ আমার স্বপ্ন কাকু নয়!
নিয়ে যান ওকে!
ওকে নিয়ে যান…
কান্না শেষ করে প্রশ্নটা গুছিয়ে রেখেছি মনের ভিতর…
পরের জন্মে রমা হয়ে স্বপ্নকাকুর কাছে জেনে নেব…
প্রিয়তম, আগে থেকেই তুমি কী করে বুঝেছিলে গো
একমাত্র ভালোবেসেই ফুরিয়ে যাওয়া যায়?
—--------------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)
No comments:
Post a Comment