"সত্যান্ন প্রমদিতব্যং।
ধর্ম্মান্ন প্রমদিতব্যং।
কুশলান্ন প্রমদিতব্যং।
ভূত্যৈ না প্রমদিতব্যং।"
বাবা বললেন, এই হোক তোমার জীবনের মূলমন্ত্র।
সামনে প্রদীপ জ্বলছিল। সদ্য স্নান করে
আমি আর বাবা বসেছি ঘরের এক কোণে।
বাবা আমায় দীক্ষিত করবেন।
আমায় পথ দেখাবেন।
এটাই এ বাড়ির রীতি।
ছেলে মেয়েরা একটু বড় হলেই বাড়ির গুরুজনই
তাদের কানে প্রবেশ করিয়ে দেন জীবনের মন্ত্র।
আমি তখন পঞ্চম শ্রেণি। বাবা আমার কোলের
উপর রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, প্রণাম করো
ইনিই তোমার গুরু।
আমি রবীন্দ্রনাথ এবং বাবা দুজনকেই প্রণাম করলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, ইনি ঈশ্বর বাবা?
বাবা হাসলেন। বললেন, বড় হও, বুঝবে।
আমি রবীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে
রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধা করতে করতে
নবম শ্রেণিতে যখন,
আমার পায়ের পাতায় বসন্তের ঢেউ লাগল।
কানের সামনে মুখ নামিয়ে সে গাইল,
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি…
আমি শিহরিত হলাম।
এ যে রবীন্দ্রনাথ!
ইনি তো ঈশ্বর!
ইনি তো আমার গুরু!
আমি ছুটে গেলাম বাবার কাছে…
বাবা! বাবা! জানো, আজ কোকিল ডাকছিল!
সেই সুরে আমি যে আমার রবীন্দ্রনাথকে পেলাম!
কিন্তু তা কী করে হয়?
উনি যে…
বাবা হাসলেন। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
উনিই তো বসন্ত!
তিরতির করে উঠল আমার ঠোঁট।
এই প্রথম আমি রবীন্দ্রনাথকে প্রেমিক ভাবলাম।
বাবার সামনে থেকে এক ছুটে ঘরে এসে
বিছানায় উপুড় হলাম।
আমার বুকের নীচে গান বয়ে চলল
আমারও পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো…
একদিন আমার বসন্ত প্রখ্যাত গবেষক হয়ে বিদেশে গেল।
তার শিকড় প্রবেশ করল সেখানেই।
তার কোকিল রবীন্দ্রনাথ ভুলে গেল।
আমি কেঁদে পড়লাম বাবার কাছে।
বাবা! বাবা! এ কেন হল?
আমি যে নিঃস্ব হলাম!
বাবা মাথায় হাত রাখলেন, বললেন
…"আছে দুঃখ আছে মৃত্যু।"
আর আছে শক্তি...
"অসতো মা সদ্গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মামৃতং গময়।
আবিরাবীর্ম এধি।।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং,
তেন মাং পাহি নিত্যম্।"
আমি পঞ্চম শ্রেণি থেকে রবীন্দ্রনাথ
বুকে ধরে আছি।
বাবা বলেছিলেন, বড় হও, জানবে।
আমি আজও বড় হয়ে চলেছি...
স্নান করে রবীন্দ্রনাথ এর সামনে প্রদীপ জ্বেলে
প্রণাম করেছি।
দ্বিপ্রহরে বুকে জড়িয়ে ধরেছি সঞ্চয়িতা।
গভীর রাতে গীতবিতানের সুর ভিজিয়েছি
বিষাদের অশ্রুতে।
আমার বুকের গহনে সোনার তরী ভেসে যাচ্ছে
আজও…
পাকা ধানক্ষেতে দুলছে শিশির,
দুলছে আকাশ।
বসে আছি কূলে আমি আর রবীন্দ্রনাথ।
------------------
Sujata Mishra
No comments:
Post a Comment