প্রিয়
ঠাকুর, ছেলেবেলায় বীরেন কাকা লিখতে শিখিয়েছিল তাই তোমাকে এই চিঠি লিখতে পারছি নইলে কিছুতেই আমার কথা বোঝাতে পারতাম না হয়ত। জন্মেই তো মাকে খেয়েছি আর আমার বাবা যে কে, তা কেউই জানে না…
এর কাঁধে, তার ট্যাঁকে আমার ছেলেবেলা ভালোই কেটেছিল। দু পয়সার লজেন্চুস আর ভিক্ষের পাত্রে দয়া, মন্দ কী?
সন্ধে হলেই বীরেন কাকা স্লেটের উপর পেন্সিল ঠেকিয়ে লিখত, তোর নাম একাদশী…
বীরেন কাকা লিখত, লেখাপড়ায় তোর খুব ভালো মাথা, একদিন অনেক কিছু শিখবি… কিন্তু তোকে শেখাবে কে? আমি তো অত জানি না।
আমি ভিকারী মায়ের মূক বধির একাদশী। আমায় শেখাতে শেখাতে বীরেন কাকার স্লেটও একদিন ধোঁয়া হয়ে গেল। আমার ভাঙা প্লেটে ছিটকে এল করুণা আর ধিক্কার…
খুচরোগুলো কুড়িয়ে রাখতে রাখতে আমার বয়স হয়ে গেল কুড়ি বাইশ বত্রিশ…
না গো ঠাকুর, আমার কোনো অভিযোগ নেই। শুধু একটা আর্জি…
ডাস্টবিনের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় কদিন আগে প্লাস্টিকে মোড়া এক প্রাণ দেখতে পেলাম, জানো?
খুব করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আনন্দে আমার চোখ মুখ ঠোঁট কেঁপে উঠল। চুমো খেলাম সেই প্রাণের হাসিতে। সে তখন আমার কোলের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে কী সুন্দর হাসছিল! আমি হৃদয় দিয়ে, দুচোখ দিয়ে সেই হাসি শুনছিলাম। আমার সারা শরীর নেচে উঠছিল...ওহ কী সুন্দর সেই সুর!
মনে হচ্ছিল, আমি বধির নই! আমি মূক নই!
আমি সব শুনতে পাচ্ছি, আদরের ভাষা বলতে পারছি...পৃথিবীর সব চাইতে সুখী তখন এই একাদশী।
বীরেন কাকা আমায় একটা বাঁশি দিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল...শুনতে না পেলেও এর সুর একদিন তুই ঠিক বুঝবি! আমি সেই বাঁশি নিয়ে কতরকম করে বাজালাম। ও হাসল, হাত পা ছুঁড়ল… আমার গলা জড়িয়ে ধরল।
তারপর কে যে কী খবর দিয়ে এল পুলিশকে!
ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল আমার কোল থেকে ওরা!
হেঁচকা টানে ছুঁড়ে ফেলে দিল আমার সুখ, ইশারায় বুঝিয়ে দিল, এ হয়না! নিয়ম নেই…
একাদশী খুব কাঁদছে ঠাকুর! একাদশীর বুক ফেটে যাচ্ছে! ওরা কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে তার পৃথিবী, তার সূর্য...
আমার একটা আর্জি আছে ঠাকুর…
না না আমি আমার কণ্ঠ, শ্রবণ কিছুই চাইনা…
আমি যে আমার ছিন্ন প্রাণের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি!
কেবল ওদের অক্ষম ইন্দ্রিয়গুলো সক্ষম করে দাও! ওরা যে দেখতেও পায়না, শুনতেও পায়না! কেবল ওদের চক্ষু কর্ণ দাও ঠাকুর! ওরা যেন আমার কান্না শুনতে পায়...আমার দীর্ণ হৃদয় দেখতে পায়!
ঠাকুর, ওদের দৃষ্টিশক্তি দাও!
ঠাকুর, ওদের শ্রবণ শক্তি দাও!
একাদশীর কান্না যেন ওদের ইন্দ্রিয় ছুঁতে পারে!
ঠাকুর…
ইতি
একাদশী
----------------
Sujata Mishra
No comments:
Post a Comment