'SCREEN SHORT FEST 2019 Short Film festival
তৃতীয়স্থান প্রাপ্ত, পুরস্কার প্রাপ্ত গল্প
-- ‘আচ্ছা, তোমার ‘সাঁজবাতি’ নামটা কে রেখেছিল?’
-- ‘আমার বাবা। সন্ধ্যের বাতির সময়ে আমি মায়ের আঁতুরঘরে কেঁদে উঠেছিলাম প্রথম, তাই বাবা’ই ঠিক করেছিলেন এই নাম।’
হো হো করে হেসে উঠল বিকাশ, বলল- ‘যে কিনা নিজেই আলোহীন সন্ধ্যে, সে নাকি আবার সাঁজবাতি! ওই বাবা’ই আবার তার সাঁজবাতিকে মাত্র কয়েক হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন আমার কাছে!’
-- ‘তুমি ফের এসব কথা বলছ আজ? থামো না, আমার শুনতে ভালো লাগে না। মায়ের শেষ ইচ্ছা রাখতে যখন বিয়ে করলে, তখন কোনো সূর্যমুখিকে কেন করলে না? কেন এই জন্মান্ধ কে তুলে নিলে কাঁধে? মা মরা আমি সৎ মা আর বাবার কাছে নাহয় সারাজীবনই মার খেয়ে থাকতাম।’
-- ‘হে প্রিয়তমা, প্রাণ আমার। তুমি কি জানোনা, কেন আমি তোমায় বিয়ে করেছি? সেদিনের সেই কথা আজও কানে ভাসে আমার। কলেজে এলেন ইতিহাসের নতুন অধ্যাপক অনিল, অল্পবয়সী, উদ্যমী, কিন্তু রূপান্তরকামী। হাসি-ঠাট্টা, উফফ্! কি ভয়ংকর ছিল ওর জন্য সেই দিনগুলো। আর চুপিচুপি আমিও দিয়েছিলাম যোগ তাতে, পৌরুষত্বের প্রমাণে। অনিল কলেজের বাথরুমের ভিতরে ঝুলছিল সেদিন লজ্জায় ঘৃণায়। মা মৃত্যুশয্যায় বিয়ের কথা বারবার বলতেন জানো তো। তুমি ছাড়া অন্য কেউ কি এমন তৃতীয় লিঙ্গের পুরুষ বা অ-পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে থাকত, বলোতো?’
কথোপকথন চলতে থাকে কলেজের রাশভারী অংকের অধ্যাপক বিকাশ বাবু এবং তার বিবাহিতা জন্মান্ধ স্ত্রী সাঁজবাতির মধ্যে। সাঁজবাতি এও জানে বিকাশ তার মাকে মিথ্যে বলেছিল বিয়ের পরেও তাঁর মায়ের বেঁচে থাকা অবশিষ্ট দিনগুলিতে। সাঁজবাতি যখন অসুস্থ শয্যাশায়ী শাশুড়ির মাথায় তার পেলব হাতের আঙ্গুল বুলিয়ে পরশ দিত শান্তির, তাঁর শাশুড়িমা তাকে বলতেন, ‘ আমার ছেলেটাকে দেখিস রে মা।’ কিন্তু ওই পটলচেরা চোখ যে আসলে মিথ্যে ছিল, তা তিনি মৃত্যুতেও বুঝে গেলেন না। আশীর্বাদ করে গেলেন দুহাত ভরে।
-- ‘আসতে পারি স্যার?’
-- ‘হ্যাঁ এস এস, রাহুল, এস।’
উল্লসিত বিকাশ ঘরের দিকে ডাক ছুঁড়ল- ‘ বাতি, বাতি এস একবার এখানে।’
সাঁজবাতি লিভিংরুমে এসে পৌঁছালে বিকাশ আগত রাহুলের উদ্দেশ্যে বলে, -- ‘রাহুল, এই তোমার ছাত্রী। অন্ধ হওয়ার কারণে আর গ্রাম্য পরিবেশে সুবিধা না থাকার জন্য পড়াশোনা শেখার সুযোগ পায়নি।’
তারপর সাঁজবাতিকে বলে, -- ‘এই যে বাতি, এ আমার ছাত্র রাহুল। তোমাকে লেখাপড়া শেখাবে’।
-- ‘আমাকে? কিন্তু আমি যে দেখতে পাইনা, পড়ব কি করে?’
-- ‘আছে বাতি আছে। ব্রেইল মাধ্যমে রাহুল শেখাবে তোমায়। তোমাকে যে অনেক পড়াশুনা করে আমায় সাহায্য করতে হবে। রাহুল, তুমি তবে ছাত্রীকে বুঝে নাও। আমি বেরোই।’
বিকাশ কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। রাহুলের ক্লাস শুরু হয় সেদিন থেকে।
সাঁজবাতিকে বিয়ের পরে সত্যিটা বলেছিল বিকাশ। বলেছিল -- ‘আমায় তুমি ক্ষমা করবে কিনা জানিনা, সামাজিক মানসন্মানের জন্য আমি এই বিয়ে করেছি। তোমার বাবা, মা তোমার উপর চরম অত্যাচার করত আমি জানি, তাও আমি যা করেছি, অন্যায়। তুমি ফিরে যেতেও পার।’
না, সাঁজবাতি যায়নি। ব্রেইল শিখতে গিয়ে রাহুলের হাতের স্পর্শ অনুভব করছে, অন্য ইন্দ্রিয়ের অতি সক্রিয়তায় বুঝেছে স্পর্শের অন্য অনুভূতি, শরীরে জেগেছে শিহরণ।
-- ‘আমায় ক্ষমা করো তুমি, তোমার পায়ে পড়ি। এই মুখ আর দেখাবো না। আমায় দূর করে দাও বিকাশবাবু।’
-- ‘কি বলছো এসব বাতি! বিয়ে যখন করেছি, বাচ্ছা হবে না আমাদের? খুব ভালো সংবাদ তো এটা, খুব ভালো। আমি খুব খুশি বাতি, খুব! তবে রাহুলকে বলোনা এ ওর বাচ্ছা।’
-- ‘আমি ওই দিনই রাহুলকে তাড়িয়ে দিয়েছি। ওরও আর পাওয়ার কিছু নেই। কিছু না।’
নয়মাস খুব আদরে রাখলো বিকাশ ওর বাতিকে। কলেজের কলিগরাও খুব রসিকতা করতে লাগলো বিকাশের অনিয়মিত কলেজ আসার কারণে।
সেই দিন এসে উপস্থিত হলো। সকালে প্রদীপ জ্বেলে আরতির সময়ে সাঁজবাতি গাইল, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’
অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরোলেন ডক্টর চিন্তিত মুখে, বিকাশের উদ্দেশ্যে বললেন,-- ‘ বিকাশবাবু আপনার মেয়ে হয়েছে। কিন্তু আপনার স্ত্রী আর নেই।’
বিকাশ মূর্তির মত থম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
শ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লির ভিতরে বাতির দেহটা ঢুকে যাচ্ছে একটু একটু করে, বাতি এবার আগুন হয়ে উঠছে তীব্র ভয়াণক। এতক্ষণে চিৎকার করে ওঠে বিকাশ, -- ‘বাতি, তুমি যেওনা! বাতি আমি তোমার জন্য পুরুষ হয়েছি। তোমার জন্য বাবা হয়েছি। বাতি…।’
বন্ধুরা জোর করে সরিয়ে আনে বিকাশকে, কোলে তুলে দেয় ছোট্ট মেয়েটিকে।
মেয়ে বিদিশা কিন্তু সমাজকে ভয় পায়নি। টমবয় বিদিশা ছোট থেকেই ‘বিডস্’।
বিডস্ একজন রূপান্তরকামী, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। সমাজে তার নামজশ প্রভাব প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন। বিয়ে করে আনে সোহিনীকে। বাবা দুহাত বাড়িয়ে দুজনকে আঁকড়ে ধরে সাঁজবাতির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে গেয়ে ওঠে,
-- ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’
__________________
Sujata Mishra
No comments:
Post a Comment