বাহামণি বাস্কে

মেয়েটার নাম বাহামণি বাস্কে।
বসন্তের বাহা-মেলায় যখন ওর বাপ ঠাকুর্দায় 
নাচকোঁদ করছিল ঠিক তখন পাড়ার বুড়ি দাই এসে
খবর দিয়েছিল, অ বুধনা! শিগগির যা! দেখ গে
তোর চাঁদ পানা বেটি হয়েছে রে!

সে তার বাপের কী খুশি যে হল! একেবারে এক ছুটে 
ঘরে গিয়ে মেয়ে কোলে তুলে বললে, 
আমার বাহামণি আইছিস? 
ঠাকুরদা বললে, মারাং বুরুর থানে পুজো রেখে আয়
বাপ…পত্তম মেয়ে লক্ষ্মী হয়। 

এই বাহা যখন স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হল
অন্য সব অভিভাবকেরা হামলে পড়ল স্কুলের গেটে
কারা আবার শ্লোগান তুললো ওর মধ্যেই…
বিচার চাই! বিচার চাই! 

বাহার বাপের বুক ঢিপঢিপ
মেয়ের কানের কাছে মুখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলে,
হ্যাঁ রে মা! কিছু করিস নাই তো? 
বাহামণি হেসে বললো, করেছি তো বাপ!
বড়লোকদের ছিটকাই দিছি!

অনেক অনেক বার খাতা মিলিয়ে মিলিয়ে বাহামণির
পাওয়া নম্বর একটাও কমলো না। 
বরং বাংলায় সুন্দর হস্তাক্ষরের জন্য বরাদ্দ এক নম্বরটাও জুটে গেল তার। 
যারা বিচার চাইতে এসেছিল, পাংশু মুখ করে বললো
এত সুন্দর হাতের লেখা! কী করে হয়? 

তরতর করে এগোয় মেয়ে। 
বাহা উৎসবে বসন্ত নামে। মা বাপের সঙ্গে গিয়ে
নাচন কোদন করে। পান্তা খায়। 
মারাং বুরুর সামনে মাথা নোয়ায়।
খড় কাটে। গরুকে জাবনা দেয়।
বিকেলবেলা গা ধোয়, পাউডার লাগায়
বুধি, কমলি দের সঙ্গে গল্প করে…

রাত নামলে ডুবে যায় বইয়ে।
এক প্রবল আত্মবিশ্বাসে।

মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ছাড়িয়ে মেয়ে সাড়া ফেলে দিল হঠাৎ একদিন
হই হই কান্ড রই রই ব্যাপার…

বাহামণি বাস্কে মেডিকেলে পেয়েছে চান্স!

ওই যে যারা বিচার চাইতে এসেছিল
তারা আড়ালে হাসলো, বললো…
বোঝো না! সংরক্ষণ! নাহ! এ দেশের ভাগ্যে আর
ভালো কিস্যু হবে না!
ও যদি ডাক্তার হয়, মরবে! সব মরবে।

বাহামণি ডাক্তার হল। কিন্তু তার কাছে চিকিৎসা
নিতে এলো না কেউ…

বাহামণি গলায় স্টেথোস্কোপ নিয়ে সাঁওতাল পরগনার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো।

বাদল মুর্মু, টগরী টুডু, লম্বু হেমব্রম, লক্ষী, রতন, 
সোনালী সবাই একে একে এলো তার কাছে
বাহা…পেটে বড় বেদনা!
বাহা…বুকের বাঁ দিকে কী যে হয়! এতদিন মারাং বুরুর চন্নামেত্ত খেলুম, তাও…
বাহা…ভাগ্যিস তুই ছিলিস! 
বাহা…তোর অনেক ভালো হোক বেটি!

বাহামণি আরো ডিগ্রি অর্জন করলো। বিখ্যাত 
কার্ডিওলোজিস্ট বাহামণি বাস্কে পুরস্কৃত হল
দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে…

ওই যে যারা বিচার চাইতে এসেছিল, তাদের
বুকের রোগ নিয়ে এ ডাক্তার ও ডাক্তার করতে
করতে শেষে শুনলো, বাহামণি বাস্কেই শেষ উপায়।

বাড়ির লোককে বললো, আর কী! 
সব ডাক্তারই ওর কাছে রেফার করছে যখন…

ভদ্র পাড়া ধীরে ধীরে ভিড় জমালো 
সাঁওতাল পরগনায়।

বসন্তের বাহা উৎসব তখন খুব।
বাহামণি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাচছে, গাইছে।

ওর বাপ বললে, যা বেটি যা! ওদের বুক কেটে
ধুকপুক টা বের করে দিয়ে আয় আরো…
ওরা বেঁচে থাকলে তবে না আমার ঘরে বাহামণি জন্মাইবে!

বাহামণি টেবিলে শুয়ে থাকা ভদ্রলোকগুলোর
বুক কাটে, হৃদয় হাতে নিয়ে দেখে…
ঠিক কোনখানে লেখা থাকে, 

বাহামণি বাস্কে প্রথম হতে পারে না!
বাহামণি বাস্কে ডাক্তার হতে পারে না!
বাহামণি বাস্কে আগুন হতে পারে না!
বিচার চাই! বিচার চাই!
—----------–--
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

ওরে আমার নরম সবুজ প্রাণ

এ লেখায় মনের ভিতরের খানিক কষ্ট উগরে দিলাম

ওরে আমার নরম সবুজ প্রাণ
ওরে আমার অবুঝ আবেগ গান

তোদের বুকে পাঁজরের নীচে কেবল কি প্রেম লুকিয়েই থাকে? ভালোবাসিস তাকে? সে তোকে বাসে না বুঝি? পেয়েছিস উত্তর সোজাসুজি? তাইতে তোর মৃত্যু চাই? হ্যাঁ রে! তোর কি অন্য আপন নাই?

তুই যখন তোর মায়ের গর্ভে, জননী হওয়ার সে পর্বে তোর মায়ের সে যন্ত্রণার হাসি। চুমো দিয়ে তোকে বলেছিল ভালোবাসি…কই মরার সময় তাকে রেখেছিলি মনে? বাবা? ভুলে গেছিস? আর এক আপন জনে? বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন আর…
দুয়ো! বীর তুই! পরে মৃত্যুহার?

শোন রে শোন! যার জন্য মরণ নিলি, কষ্ট নিলি
তাকেই বরং আরো খানিক বাঁচতে দিয়ে গেলি।

ভুলে যাবে…ভুলে যাবে তোকে মাটি গাছ পাখি
কারো জন্য আটকে থাকে কিছু? পড়ে থাকে বাকি?

মনের দুঃখে হতাশ তুই, ইচ্ছে করছে মৃত্যু ছুঁই?
জীবন বৃথা ছাড়া তাকে…ওরে উন্মাদ! মস্ত বিশ্ব
তোর জন্যও থাকে। ঠিক সময়ে তাকেই পাবি
ভালবাসায় ভেসে যাবি…তোর জন্যও সে আছে!
তোকে বাঁচিয়ে যে নিজে বাঁচে।

যার জন্য মরলি তুই! নিজের দায়ে হারালি ভুঁই।

ইচ্ছে করে ফিরিয়ে আনি তোকে। বসিয়ে দিই একলা মায়ের শোকে।

যাক গে যাক। ভালো আছিস করি আশা। নিশ্চই পেয়েও গেছিস ভালোবাসা… নইলে কি আর যেতিস মরে? বিনা স্বার্থে কে আর এমন করে? 

আর যদি নিতান্তই অসুখী হোস। আমার লেখার পাশে চুপটি করে বোস। 

এখনো যারা ভাবছে তোকে দেখে, ঝুলতে চায় প্রেম খেলাতে ঠেকে… তাদের জন্য উঠিস ঝড়! বলিস, মরতে চাইলে নিজের জন্য মর! এক পৃথিবী মাটি আছে, স্বান্তনাটাও মায়ের কাছে। অপেক্ষাতে বাবা থাকে, মনের মধ্যে স্বপ্ন আঁকে। 

মরলি? তবে ফুরিয়ে গেলি! ভালোবাসা আর কি পেলি? 

দুয়ো তোকে! তুচ্ছ শোকে মৃত্যু চাস? 
দাঁড়া পাশে…যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হা হুতাশ!
ঘুমিয়ে শিশু খিদের চোটে, মুহুর্মুহু কান্না জোটে। মৃত্যু তাদের পায় না কই? অভাব কাঁধে জীবন চষে…মাভৈ! 

যে সময়ে খুব হারবি! তাকেই ভীষণ ধার ধারবি! মনে হবে আর তো নয় মোটে! ঠিক সে সময়ে ভাববি এদের। দেখিস তোর বুকেতে কেমন করে বেঁচে থাকা ফোটে।

বাঁচবি ওরে প্রাণ! বিলিয়ে স্নেহ দিবি ! দিন ফুরালে কত শত ভালোবাসা নিবি? 

কারোর জন্য মরতে হলে…জেনে রাখিস ওরে
ভুলে যাবে বিশ্ব তোকে। নতুন সূর্য উঠবে ঠিকই ভোরে।

তোকে ছাড়াই নতুন সূর্য উঠবে ঠিকই ভোরে।
তুই যে ছিলি। ভুলবে লোকে। যাবিই যাবি মরে।
—------------––-
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

একমাত্র ভালোবেসেই…

কাকু বাবার দূর সম্পর্কের ভাই।
আমি তাকে স্বপ্ন কাকু বলেই ডাকতাম।
আমাদের বাড়িতে এলে প্রতিবার মাসখানেক থেকেই যেত স্বপ্নকাকু।
বাবা মাকে বলতো, আহা! তিনকুলে কেউ নেই এই আমি ছাড়া…কোথায় আর যাবে?

স্বপ্ন কাকু ভালো ছবি আঁকতে পারত। ক্যানভাসে
আর মনে।
বাড়িতে ঢুকেই ছবি আঁকার জিনিসপত্র সোফার উপর রেখে আমার কাঁধে হাত রাখত,
কী খুকি! আছো কেমন?

বারো বছরের কিশোরীকে খুকি বলা নিয়ে
গাল ফুলিয়েছি বহুবার
তবু কাকু আমায় ওই নামেই ডাকত।
সন্ধে হলে দেশ বিদেশের গল্প শোনাতো। 
চুলে বিলি কেটে দিত।
মা ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ দিয়ে যেতে যেতে বলত
ঠাকুরপো! তুমি পারোও বটে! 
আমার এমন চঞ্চল মেয়ে তোমার গল্পে একেবারে চুপ! 

স্বপ্ন কাকু আমার ব্যাগের মধ্যে একটা ব্যাং এঁকে
ঢুকিয়ে রেখেছিল।
স্কুলে গিয়ে আমি ব্যাগ খুলতেই দেখি তাতে লেখা
খুকিকে…স্বপ্ন কাকু!

আমি বাড়ি ফিরে কাকুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
কাকুর বুকে আমার বুক
দুই হাতের মধ্যে আমার মুখ
তিরতিরে ঠোঁট…
তখন আমি বারো পেরিয়ে তের
তের পেরিয়ে চোদ্দ

ব্যাঙের ছবিটার নীচে লিখে রাখলাম
স্বপ্ন কাকু তোমায় ভালোবাসি।

সেবার যখন কাকু এলো আমাদের বাড়ি
আমি খুব ধরে পড়লাম তাকে,
আমাকে তোমায় আঁকতেই হবে কাকু!

কাকু অনেক ভেবে বললো, আঁকতে পারি
শর্ত আছে। সম্পূর্ণ হওয়ার আগে অবধি দেখতে
পারবে না।
তাই সই।

আমি শাড়ি পরেছি। চোখে কাজল দিয়েছি। 
চুলে খোঁপা। রাতের রজনীগন্ধা তাতে।
গোটা ঘর ম ম করছে গন্ধে।
স্বপ্ন কাকুর মন পড়ার চেষ্টা করছি আমি।

মুখ আঁকার শেষে কাকু বললো, 
এবার গলা, গলা বেয়ে
বুক…

আমি বুক থেকে শাড়িটা খানিক নামিয়ে দিলাম নিচে
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভাঁজ। 
আলোড়ন কি কাকুর ভ্রুতে?

শান্ত কণ্ঠে কানে ভেসে এল সুর
যা নিভৃতে সুন্দর, তাকে রাখো অন্তঃপুরে।

দিন কয়েক পরে চুপিচুপি আমি স্বপ্নকাকুর ঘরে ঢুকি। 
বাক্স প্যাটরা হাতরাই। যদি আমার কথা কিছু 
লিখে রাখে তার নিত্য লেখা ডায়েরিতে!

এক গোছা চিঠি আলগোছে পড়ে যায় আমার হাতের
উপর…

প্রিয়তম,
     তোমার দেওয়া নামই রাখলাম শেষে। অনিরুদ্ধ। দেখতে হুবহু তুমি। 

প্রিয়তম,
      এবার বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলে। তোমার ছেলেটি যে তোমার মতই শিল্পী হয়ে উঠছে, তা দেখে গেলে না!

প্রিয়তম,
       তোমার সবচেয়ে প্রিয় আমার বুকের অতন্দ্র প্রহরী স্তন দুটোয় মারাত্মক অসুখ বাসা বেঁধেছে। ডাক্তার বলেছে বাদ না দিলে…

কই তুমি তো আর এলে না? স্তন বাদ গেছে বলে কি? শরীর ছাড়া আমার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?

একবার এস! ছেলেটাকে নিয়ে আমার স্বামী আমায় ফেলে চলে গেছে। আমার চরিত্রহীনতার প্রমাণ তোমার ছেলেই তাকে দিয়েছে তোমার দেওয়া চিঠি দেখিয়ে। অসুস্থ স্ত্রীকে ছেড়ে যাওয়ার এই তো মোক্ষম সুযোগ! 

এলে না আর? দিলে না জবাব? আমার চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। চিঠিখানা আর পোস্ট করার ক্ষমতা নেই। যদি আসো, আমার কঙ্কালের পাশ থেকে নিয়ে যেও। 

স্বপ্ন কাকু কখন যে এসে ঘরে ঢুকেছে, আমার হাত থেকে ভালোবাসা কেড়েছে
আমার কিচ্ছু মনে নেই।

চলে গেছে সেই শেষ বার…

ক্যানভাসের উপর চাপা দেওয়া সাদা কাপড় সরিয়েছি
এক টানে…

চুল ওঠা স্তন হীন অসুস্থ এক নারী!
নীচে লেখা, 
ভালোবাসি। কিন্তু আমিও ফুরিয়ে এসেছি যে রমা!

আমার খোঁপার রজনীগন্ধা, ঠোঁটে গোলাপি
লিপস্টিক, শাড়ির পরিপাটি ভাঁজ কোথাও নেই
এক ফোঁটা…

খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল বাবা। 
মাকে বলেছিল, আহা আমরা ছাড়া কেউ তো নেই
ছেলেটার!

অনেক কষ্টে ধরে বেঁধে এক বছর পরে পুলিশ
একজন পাগলকে নিয়ে এল আমাদের বাড়ি

মুখ গাল ঠোঁট দাড়ি গোঁফে ভর্তি। মাথার চুল 
ঘাড় ছাড়িয়েছে। সারা গায়ে আঁষটে গন্ধ
স্বপ্ন কাকুর কোনো চিহ্ন নেই তার মধ্যে

বাবা নাক সিটকে বললো, না না এ আমার ভাই নয়
মা বললো, ঠাকুরপো শিল্পী! পাগল তো নয়!

পাগল টা বিড়বিড় করছে, যা কিছু নিভৃতের
তাকে রাখো অন্তঃপুরে…
রমা! আমিও যে ফুরিয়ে গেছি!

আমি চিৎকার করে উঠলাম! অফিসার!
এ আমার স্বপ্ন কাকু নয়!
নিয়ে যান ওকে! 

ওকে নিয়ে যান…

কান্না শেষ করে প্রশ্নটা গুছিয়ে রেখেছি মনের ভিতর…

পরের জন্মে রমা হয়ে স্বপ্নকাকুর কাছে জেনে নেব…
প্রিয়তম, আগে থেকেই তুমি কী করে বুঝেছিলে গো 
একমাত্র ভালোবেসেই ফুরিয়ে যাওয়া যায়?
—--------------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

স্বর্গ থেকে নীল পাখি নেমে এসেছে

স্বর্গ থেকে নীল পাখি নেমে এসেছে।
গমগমে ঘর
কর্ণ, কুন্তী সংবাদ বিতরণ করছেন মঞ্চের
আলো আঁধারী ঘুমন্ত কুরুক্ষেত্রে 
সঞ্চালনায় শান্ত উদার স্বর প্রক্ষেপন…

শত সহস্র দর্শক নিশ্চুপ মন্ত্রমুগ্ধ।

সমস্ত আয়োজনের শেষে নিভু নিভু রাত 
তানপুরায় বেঁধে নিল বিষাদ…
শূন্য এ প্রান্তরে ফিরে এস সুখ

পার্থ দা! 
বলো চন্দ্র…
তফাৎ কেবল এই, 
হ্যাঁ চন্দ্র, এ পারের দর্শক জ্বলে ওঠে আনন্দে
অন্ধকার চিরে আলো বুনতে জানে
দেবতার গ্রাস শুনে চিৎকার করে বলে, 
'শোন নি কি জননীর অন্তরের কথা?'
সে তো নয় দেবতা মোটে…
চন্দ্র!
এখনো অনেক বাকি পার্থ দা!
আমি ঘোষণা শুরু করি এইবার…

চন্দ্রমৌলি বন্দ্যোপাধ্যায়। হাতের মুঠোয় মাইক্রোফোন, চোখে জিজ্ঞাসা
শুরুটা করবো কোথায়?
গৌরী দি! এই যে এত প্রেম তোমার
ডেকে নিলে দাদাকে তোমার কাছে
বলো তো, এই দিয়ে করি শুরু?

আলোচনার শেষে আবার নামলো রাত
মঞ্চ ঝলমল করে উঠলো।
থোকায় থোকায় জোনাই আলোকসজ্জায়
মাইক্রোফোনের সামনে শুভ্র দুই ঠোঁট নড়ে উঠলো। 
আকাশবাণী আকাশ…
আজকের উপস্থাপনা…

করতালিতে চিরে যাচ্ছে সমগ্র আকাশের রাত্রি
ভীষণ আগ্রহে তারারা আবেগ ছুঁড়ে দিচ্ছে
আরো চাই! আরো চাই!
আমরা সৃষ্টি চাই!

সকাল হতেই টুক করে খসে পড়লো উল্কা-ফুল
তানপুরার সুর বদলে গেল একাদশী কন্যের হাতে
তার আবৃত্তি মুগ্ধ করে তুললো অপর প্রতিযোগীকে
বাহ! দারুণ কণ্ঠ তোমার! নাম কী? 
মেয়েটি বড় সপ্রতিভ… গৌরী। আর তোমার?
পার্থ। 
হাসছে চন্দ্র মৌলি। 
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভ্যেস করছে
আকাশবাণী পৃথিবী! আপনারা শুনছেন…

শূন্যতা কোনোদিন শূন্য থাকে না।
আবার মাটি জন্মায়।
—-----------––--–------–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

ভালোবাসা

আমার বড় ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়।
যে মানুষটা আমার ঘর কেড়ে নিয়ে
প্রাচীন মরুভূমির মত শুষ্ক হেসেছে
তাকেও আমার ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়
শ্যাওলা ছেড়ে দিয়ে আসতে ইচ্ছে হয়
তার শিরা উপশিরায়
তা থেকে তার হৃদয়ে সৃষ্টি হবে বাস্তুতন্ত্র।

যে মানুষটা আমার আলো নিভিয়ে
মুঠো মুঠো অন্ধকার ঢেলে দিয়েছে মাথায়
আমার খুব ইচ্ছে হয় তার খুব ভালো চাইতে
তাকে খুব ভালোবাসতে
একটা সূর্য তার উঠোনে বসিয়ে তাতে সার জল
দিয়ে ফল ফুলে ভরিয়ে দিতে

যে মানুষটা আমার সুর রক্তাক্ত করেছে
ভাষা রূদ্ধ করেছে
ভয়ংকর আনন্দে চিৎকার করেছে
তবে! এইবার কী করে আনন্দ গাইবি তুই?
আমার খুব ইচ্ছে করে, 
তার ঠোঁটের সেই হাসিতে আমার ভালোবাসা রেখে যাই
যদি কোনোদিন অ-সুরে তার কোনো ক্ষতি হয়!
ইচ্ছে করে, আমার অস্থি দিয়ে তার জন্য বজ্র বানিয়ে রাখি

যে মানুষটা আমাকে ভালোবাসতে চায়
যে মানুষটা আমাকে আঁকড়ে রাখতে চায়
জড়িয়ে রাখতে চায়
আমার জন্য ঘর আলো গান বেঁধে দিতে চায়
আমার খুব ইচ্ছে করে, তাকে জোর করে 
ছিটকে দিই আমার কক্ষ থেকে
আমার খুব ইচ্ছে করে চিৎকার করে তাকে বলি
ভালোবাসা এত সহজ নাকি, 
যে এত সহজে আমাতে বিলিয়ে দিতে চাইছো?
—-------------––-
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

যাপন

একদিন এসেছি মাটির বুকে শান্ত ছায়ায়
কোমল মায়ায়, খেলাঘরে।
এখানে পাখি ডাকে। গান গায়। আলো হয়ে
রোদ পড়ে।

বাতাসে বাতাসে সৌরভ ছোটে। ফুল ফোটে।
শিশির লুটায় ঘাসে।
পেখম মেলে প্রেমিক ময়ূর নৃত্যে ভোলায় মন।
আনন্দ ভালোবাসে।

বৃষ্টি নামে খুব। গা ধুয়ে গান লেখে।
পৃথিবীর উঠোনে সুখ
এখানেই স্বর্গ আঁকার ক্যানভাস। শাখায় শাখায়
স্নেহ আর শ্রদ্ধার মুখ। 

হৃদয় ডাকে হৃদয়ের তীরে। উচ্ছাস ঢেউ তার…
নাম লেখো, লেখো নাম তবে
কিছু নয় অক্ষয়। ধুয়ে যাবে প্রাণ
'অমর কে কোথা, কবে?'
তবু যাবে থেকে। ক্ষেতে সুখ ছুঁয়ে
অঘ্রাণ প্রতি মাসে
এ পৃথিবী ভুলবে তোমায়। তুমি থেকে যাবে
নবান্নের নিত্য সহবাসে।

যা করেছি ধুলো খেলা, যা রেখেছি আমার
আজ আর দাবি নেই কোনো
মেঘে মেঘে মিলেছে শরীর। শিশিরে কান্না
বাতাসে হিমেল মনও

যা কিছু বলেছি কথা, ফেলেছি ব্যথা
বৃথা ভুল চুক
মাটির বুকে মিলিয়ে নিও ক্ষমা
দুঃখ কষ্ট অহেতুক 

কাদা মেখে গড়েছি পুতুল। করেছি আলিঙ্গন
ভেবেছি জগৎ এই বেশ
থাকেনি শরীর। থাকেনি ক্লান্তি
ধোঁয়াতেই মুক্তি। এইটুকু অবশেষ।

তবু যদি ভেবে দেখো মণিকোঠায় আমি
একটুও আছি পাশে
মিশিয়ে নিও ভালোবাসায়। নতুন দিনের
সবুজ দূর্বা ঘাসে।

ডেকো না আমায় সাড়ম্বরে। 
রেখো না ফুল-ঝাড়ে
মুঠো ভর্তি আলো বুনো, একলা যাপন
অন্ধকারে
—------------–-
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

তিন মাস

কী মজা! এখনো তিন মাস আমি ফুল দেখব
আলো দেখব। অন্ধকারের গন্ধ নেব। 
আর তোমায় ভালোবাসবো। 

ইস কেন কাঁদছো এভাবে? 

দেখো আকাশের দিকে তাকাও।
মেঘকে জড়িয়ে রেখেছে আকাশ তার বুকে
অমনি করে আমায় ধরো তো দেখি একটু
আহ বড় শান্তি প্রিয় 

এই দেখো, দেখেছো! মেঘ ঠিক বৃষ্টি হয়ে ঝরতে
শুরু করলো।
আকাশ যে অত ভালোবাসলো
ফল কী হল? 
মেঘ কিন্তু বৃষ্টি হয়ে মাটিতে মিশে গেল।
আবার কবে সে বাষ্প হবে
আবার কবে ধুলো পাবে
পরের জন্মে আকাশে ফিরবে আবার সে!
আকাশ যদি জন্ম জন্ম অপেক্ষা করতে পারে তার
মেঘের জন্য, তুমি পারবে না?

তিন মাস! এখনো তিন মাস আমি বেঁচে থাকবো।
দুরারোগ্য কর্কট আমাকে তিন মাস কিচ্ছু করতে
পারবে না।
চলো পথে পথে পাথর সরিয়ে আদর ছড়াবো। স্নেহ
ভরাবো আমরা দুজন।
পাতায় পাতায় লিখে আসবো মায়া।

আলো ফলেছে যে গাছে তার নিচে বসে
গা মেলবো। প্রজাপতি হবে তুমি, আমি হলুদ ফুল।

আবার কাঁদছো? 
ও মা…দেখে যাও! তোমার ছেলে একটুও কথা
শুনছে না! 
মা! আজ কাঁচকলার কোপ্তা করেছ না? 
সত্যি! কেউ মৃত্যু আগে থেকে জেনে গেলে
বেশ কিন্তু হয়। 
কত যত্ন…ভালোবাসা

কিন্তু তোমরা এটা মনে রাখতে চাও না
আমি একটু এগিয়ে যাচ্ছি না হয়…
আমার পিছু পিছু আসবে তোমরাও
দশ, বিশ, পঞ্চাশ বছর পরেও
তোমরাও কিন্তু মাটিতে রাখবে শ্বাস।

মৃত্যুর মত অমর আর কী আছে?

আমার চলে যাওয়ার পরে আলো গাছ
বসিও খুব, প্রিয়।
অন্ধকারের গন্ধ এঁকো।
প্রজাপতিকে ফুল দিও
শূন্য ঘরে সুন্দর স্বপ্ন

এই শোনো না! এখন কথা, কান্নাকাটি বাদ।

একটা ভীষণ আবদার আছে তোমার কাছে।

তিন মাসের মধ্যে আমায় তিনশো লক্ষ
চুমু দেবে গো? 
–––---------–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

দ্রোহ

'বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির 
ওই শিখর হিমাদ্রির!'

'গুরুজী আমি আপনাকে খুন করব!'

চোখে একরাশ বিস্ময়
বুকে গনগনে আগুন
হাতের মুষ্ঠি কঠিন

গুরুদেব বুকে টানলেন তাঁকে
'হ্যাঁ কাজী তুমিই আমাকে খুন করবে!'

অসির চেয়ে মসির জোর যে বেশি!

তালতলা লেনের ঘরে সারারাত্রি ধরে
শেকল ছেঁড়া বর্ণমালা পেন্সিলের ছোঁয়ায় 
কাগজের উপর যে বজ্র এঁকেছিল 
শত বর্ষ ধরে সে ভৃগু হয়ে ভগবানের
বুকে পদচিহ্ন রেখে যায় বারবার…
'আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন!'

বাইরে ঝমঝম করে পড়ছে বৃষ্টি
হিম শীতল রাত
কাজীর হাতে অস্ত্র
সৃষ্টির ভয়ঙ্কর উল্লাস
লৌহ কপাট ভেঙে ফেলার সাহস
ষাটের বুকে আঠারোর প্লাবন জাগানিয়া ঢেউ
'মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!'

দুলে উঠেছে সমুদ্র
ফুলে উঠেছে জোয়ার
পাহাড় টলেছে
বাতাস দিক হারিয়েছে
ছুটে এসেছে নাবিক 
বিদ্রোহীর দ্বারে
হে সাম্যবাদের কবি!
আমিও আগুন হতে চাই!
একই বৃন্তে সহস্র মানবতা হয়ে ফুটে উঠতে চাই!

মেহের আলি সারারাত্রি অট্টহাসিতে প্রাসাদ কাঁপায়।
চিৎকার করে বলে 
'আমি উন্মাদ! আমি উন্মাদ!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!'

বৈধ্যবের সব রঙ পুড়ে যাওয়া মেয়েটা
বেনারসী খুঁজে বের করে আনে
আত্মহননের চিতা থেকে...
চন্ডালের ঘর্মাক্ত কাঁধে মুখ ঘষে দেয়

তালতলার ঘরে বিনিদ্র রাত ঘোষণা করে

'আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!'

চুরুলিয়ার আকাশে ধূমকেতুর আলো
জ্বলজ্বল করছে!
মেতে উঠেছে মেঘ
ছুটছে ধুলো… বইছে তুফান
ওই…ওই কবি ডাকছেন    
'…আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।'

প্রদীপ জ্বলে উঠলো। 
জাহেদা বিবির সন্তান জন্ম নিল বলে শঙ্খধ্বনি করলো হিঁদু পাড়ার মাতা অন্নদা।

হামাগুড়ি দিচ্ছে ওই বালক মুয়াজ্জিন
এরপর উঠবে! দাঁড়াবে! ছিন্ন ভিন্ন করবে
অন্ধকারের ত্রাস।
কলম দিয়ে চিৎকার করবে
'আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি মানি নাকো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
ভাসমান মাইন!'

ভীষণ প্রেমে সে আগুন জড়িয়ে ধরবে প্রেয়সীর উঠোন
প্রথম সন্তানের নাম রাখবে
কৃষ্ণ মহম্মদ।


--------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

লোকটা

আমি ত দুগ্গার শিরেও সিন্দুর চড়হাই
তবে উ কি আমার বহু রে পদ্দ?
উ আমহার মা লাগে, মা…
তুর ভালে সিন্দুর দিয়েছি পদ্দ
তুও আমহার মা রে বেটি

অমন দুগ্গা পানহা চোখ কইরে হাতে অস্তর লিয়ে
হ কেনে অমন আগ!
তুর বাপকে বুঝাই দে, মাইয়া মানে সে ফ্যালনা লয়
মাইয়া মানে সে বুঝা লয়! 
মাইয়া মানে মা রে পদ্দ!
মাইয়া মানে দুগ্গা!

ই টুকুন বইলে লোকটা আমহার দিকে তাকাইল
আমহি বল্লম, ই বিহা তবে ছালেখেলা বটেক?

লোকটা বুক চাপড়ে বল্যে ওঠে, হ হ খেলা 
তবে ছেলে খেলা লয় পদ্দ
তুকে মানহুশ করার খেলা।

মা টো আমহায় জনম দিয়েছে। 
তার পরেই মরহে গেছে।

অ লোক টা! তোমহার গায়ের ই গন্ধটকেই
মা মা গন্ধ বলহে, লয়?

পাড়হার লোকে বলে, ঘরকে এনে বাপ
মদের বতল গুঞ্জে দিয়েছিল আমহার মুখে
পদ্দ ডেকেছিল কমলি পিসি
বলেছিল, এ ভুবনা তুহর বেটি গুবরে পদ্দ রে!
ইত রূপ…
মাস্টার বুলেছিল, ভুবনা! মাইয়াটারে অন্তত
মাধ্যমিক দিতে দে…বিহা দিস লা রে!

রাতের আন্ধারে বাপ ই লোকটার কাছকে 
আমহাকে বেইচ্যে দিল
লোকটা বুড়হা
আমহার কপালে সিঁদুর দিয়া
তার ঘরে লিয়ে আসে সক্কলকে বুলল
সুন তোরা! ই আমহার বহু বটে
কেউ এর অসম্মান করবি লি…

লে পদ্দ তুকে ভর্তি পুকুর দিলহাম
টলটলে জল
তু কেবল ছড়াই যা…

সাহেব বাবু ইল আমহাকে পড়াইতে
অক্ষরে অক্ষরে তাকে চিনতি চিনতি
কখন জানি কী হইয়ে গিল…

মাধ্যমিকে সারা ইলাকায় পথম হলাম আমহি
লোকটা সুবাইকে মিষ্টি খাওয়াইয়ে
নেচে কুন্দে এক্কেরে খুশিতে ডগমগ

তারপর আমহাকে চমকাইয়া সাহেব বাবুকে
কাছে আনি আমহার হাতে দিলে তুলে

সাহেব বাবু বললে, ভালো বাসি আমিও পদ্দ কে
ইতে ভুল লাই
কিন্তুক উ আপনার বহু বটে
কী কইরা ই সম্ভব…

লোকটা চিৎকার করি উঠল

ই যে লক্ষী মা দেখছস আমহার ঘরে
ইকেও আমহি সিন্দুর দিই, ভালোবাসি
তা বলে উ কি আমহার বউ? 
উ পদ্দ। আমহায় উর ছেলে কিংবা বাপ
বলতে পারহ।

ই লোকটা আমহার বাপ।
হ হ ঠিক বুলেছে উ সাহেব বাবু!
শুধু জনম দিলেই বাপ হওয়া লাগে না
আগল দিতে লাগে। 

সাহেব বাবু আমহয় বিহা করে ঘরে লিয়ে
যাওয়ার আগে, 
লোকটা আমহায় চুপিচুপি বইলল
মনে রাইখ পদ্দ! 
তুমহি কিন্তুক পয়োজনে দুগ্গা হইতেও জানো!
––--------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

দুয়ারে ওঝা

হ রে গণশা! শনলোম নাকি তু টেরেন লাইনে মাথা
দিতে গায়েছিলি?
টেরেন লাকি তুকে মাঝে রাখে হরেন মাইরতে মাইরতে
ছুইটে গেছে! 
তুহর নাকি কিছুই হয় লাই? 
ই সইত্য বটে?

হ হ জানি জানি
তুহার বাপের অসুখ, বুনের বিহা
তুর খাদানের কামও আর লাই
তা ব্যলে ইত সহজে হার মাইনবি তু? 
বল ন গণশা! কী হৈয়েছে?

কী বৈইলছিস? তুহার লিখাপড়া?
ইটা আর কে ন জানে বুল?
ফটোক বালা আলো। মন্ত্রী আলো
বুলল, খাদানে কাম করতি করতি
ই ছেলে যখেন দশ টো হৈয়েছে বোর্ডের 
পরীক্ষাটোতে
তখেন ইর সব লিখাপড়ার খরচ আমহাদের!
ই তো সবাই জানে। লতুন তো লয়।
ফটোক বালা দুয়ারে আসে তুকে মন্ত্রীর সঙ্গে
জড়ায়ে জাপটে ফটোক তুইললে।
তুকে জিগালো, বড় হইয়ে কী হইতে চাও গণশা?
তুর চুখে কি খুশি তখেন, বৈললি মাস্টর হব আমহি।
মাস্টর!

তু গড়গড়ায়ে পৈরলি
হরহরায়ে উইঠলি কেলাসে কেলাসে।
কিন্তুক টেরেনের লিচে কেনে গেইছিলি বল ন?

কান্দিস ন গণশা! বৈলতে হবেক না 
বুঝে লিছি আমহি
ইত ভালো লেখাপড়া টো করেও তুর
মাস্টর হওয়া হল নি।
খাদানের কাম ও গেছে গা
বাপ ধুঁকছে
গণশা তোর বাপ লয় রে
ধুঁইকছে ই রাইজ্য, ই দ্যাস
বুক বাজায় বগল বাজায় লাইচ্যে 
কটা মাত্তর ল্যতা মন্ত্রী সিপাই

আরে আরে গণশা! কী হল তুহার?
অমন করে পাগলপানা ছুইটতে লাগিলি কেনে রে?
কুথাকে যাবি গণশা?

গণশা থাম থাম দাঁড়া কেনে

গণশা তু পাগল হলি রে বাপ?
শহীদ মিনারের উপরে উইটলি হরহরায়ে
আরে লামে আয় বাপ ধন
লামে আয়!

ওরে ওরে কে কুথাকে আছস ছুইটে আয় রে
আমহাদের গণশা পাগল হইছে
শহীদ মিনার থাকে উর দাবি ছুইড়ছে রে
সুইন্যে যাহ
উ কি বৈলছে তুমরা সুইনতে পাইচ্ছ না?
উ বলছে দুয়ারে ওঝা দাও!
দুয়ারে ওঝা!
গণশা বুলছে, ঝেইট্যে বিদেয় করো ন 
ই দুর্নীতি! 
গণশা বলছে, দুয়ারে ওঝা লে আনো
নইলে আমহি লামব না!
ঝেইট্যে বিদেয় করো মন্ত্রীর লাতি, পুতি আর
বিনি পাসে মাস্টর

দুয়ারে ফটোকওয়ালা চাই নি আমহার
দুয়ারে ওঝা খুঁজে নে আনো।


গণশার খাদানের কাম টাও গেছে 
উ অনেক বেশি লিখাপড়া করে করে পাগল
হয়ে গেছে …

ইমন পাগল কি বাবু লোকদের ছেলেপিলহার মাস্টর হইতে পারহে?


গণশা বাপ! তু ঝাঁপায়ে পড়। 
টেরেন তুর দুঃখ বুঝে লাই
মাটি তো মা। ঠিকই বুইজবে।

এবার মরে ওঝা হইয়ে জন্ম লিস বাপ
ল্যতা মন্ত্রী ছেলে মেয়ে শালী শালা 
বিনি পাসে মাস্টর…
ধরবি আর বিষ ঝাইরবি।
ধৈর্বি আর বিষ ঝাইরবি
গণশা! উ দেখ উরা এখনই পালাইচ্ছে।

তু তারহাতারি ঝাঁপায়ে পড়।
মর মর!
দুয়ারে ওঝা হইয়ে আয় গণশা
দুয়ারে ওঝা…
যাঃ!
—---------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

সন্ধের গন্ধে যে পূরবী থাকে

সন্ধে বেলা শান্ত মনে চোখ বুজে আছি আমি
পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুর
'আই পূরবীকে বাহার সখিরি
রেখাব ধৈবত মধ্যম বিকারত…'

বাতাসে বাতাসে আলোর কণা
তারা খসে পড়ছে একটা দুটো…
আমার শ্বাস পড়ছে শুভেচ্ছায়
এক পৃথিবী সুখ দাও তাকে
সন্ধের গন্ধে যে বন্ধু হয়ে থাকে।

ঢেউ লাগলো হঠাৎ রক্তে
নাচন হৃদয় জুড়ে
গোপন কথাটি কানে উপুড় করে দিল 
মন…
এ আয়োজন স্নেহের
এ উৎসব আলোর!
এ মাটি জন্ম ক্ষণের!
ঘাসে বাসে আনন্দের ছড়াছড়ি তাই

দুহাত তুলে আকাশকে বলি আবার
এক পৃথিবী সুখ দাও তাকে
সন্ধের গন্ধে যে পূরবী থাকে।
—---------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

শুকনো গাছ কাটা হবে

শুকনো গাছ কাটা হবে।

সজ্জিত কাঠের উপর শোয়ানো হবে আমার দেহ
আমাকে ঠিক অন্ধকারের মত সুন্দর লাগবে
আমাকে ঠিক ধোঁয়ার মত সুন্দর লাগবে

একটু আগে সূর্য-রশ্মি আমাকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল
এখন আমি আগুনের মত স্নিগ্ধ
বাতাসের মত নরম

কেউ কেউ বলবে, শহীদ বলা চলে? 
ভালো ভাবে বাঁচতে চাওয়া পরাজিত সৈনিক
দাবানল মুছিয়ে তাদের শ্বাস দিতে চাওয়া বৃষ্টি
ঝড় থামিয়ে বৃক্ষের কচি শাখায় হাসি দেখতে চাওয়া
রোদ্দুর?

পুড়ে গেছে! ছারখার হয়ে গেছে অরণ্য!
বৃক্ষের কচি শাখা লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে
রোদ্দুর ওঠেনি…

আমার সঙ্গে ভাগ্য জড়িয়েছে যে প্রাণ
তার হৃৎপিণ্ড হাহাকার করেছে বারংবার

কেউ কেউ বলবে, শহীদ তো মোটে নয়! 
বরং যা হয়েছে, বেশ।

শ্মশানের শেষ আগুনের আভার মত সুন্দর হবো আমি

আমার কোনো আকাশ নেই, মাটি নেই, বৃষ্টি নেই।

উঠোনের গাছটায় দুটো মাত্র তুলসি পাতা আছে 
আর কী চাই?
                —---
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন

মাননীয় বিধি!

আপনি অলৌকিক কী লৌকিক, সরকারী কী আধা সরকারী তা আমি জানি না। কিন্তু আমি আপনাকে ভীষণ ভাবে খুঁজে পেতে চাই। 

যেদিন আমার দিনমজুর বাবা পায়ের নিচে রক্ত আর বুকের পাঁজরে আশা নিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল বই কেনার টাকা! বলেছিল, মান রাখিস। মস্ত চাকরি পেয়ে মস্ত মানুষ হোস। ঠাকুরদা উঠোনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, সবই বিধির বিধান। ভাগ্যে থাকলে নিশ্চয়ই হবে। 
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিধি কে? ঠাকুরদা উপরের দিকে মুখ তুলে নমস্কার করে বলেছিল, জন্মের পরেই আমাদের এই চার আঙুল কপালে যিনি ভবিষ্যৎ লিখে দেন তিনিই তো বিধি!
আমি প্রতিবাদ করেছিলাম, তুমি জানো না দাদু ওসব বিধি টিধি হয় না। ভালো করে পড়াশোনা করলে বড় হয়ে ঠিক চাকরি পাবো আমি।

আমি এক দিনমজুরের সন্তান। বয়স ত্রিশ। স্নাতকোত্তরের সঙ্গে সঙ্গে দু একটা শিক্ষণ বিষয়ক ডিগ্রিও আছে। বাবার রক্ত ঘাম আর এক বিঘে জমি এর বদলে ফাইল ভর্তি কাগজ! 

সন্ধেয় বেশ মনোযোগ দিয়ে ছাত্র পড়ানোর সময়েই মায়ের কাশি বাড়ে। ভয় পেয়ে বাবা আমায় ফোন দেন, আমি উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে আসি বাড়ি। বাসক পাতা ফুটিয়ে ফুটিয়ে কালো করে ফেলি শসপ্যান। মায়ের কাশি কমে না। কমে যায় আমার সন্ধের মনোযোগ…
ছাত্রের অভিভাবক বলেন, অনেক হয়েছে মাস্টার মশাই, আপনি মায়ের সেবা করুন মন দিয়ে। 

প্রেমিকার ঠোঁটে একদিন ঠোঁট রাখতে চেয়েছিলাম। সে থুতু ফেলে বলেছিল, দু টাকার ফুচকা খাওয়াতে গেলে যে কাঁপে, সে খাবে চুমু! 


রাত্রে বিছানায় শুয়ে ছটফট করি। সাদা কাগজে কপাল আঁকি। তাতে চাকরি লিখি। মায়ের অসুখ সারে, বোনের বিয়ে হয়, ভালো থাকে বাবা। বিয়ে হয়, চুমু হয়, সন্তান…


একটা চোখ বিক্রি করে সংবাদপত্রে নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দিতে এসেছি, বেশ বড়সড় চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন
মাননীয় বিধি! আপনি কোথায়? 
মেঘাসনে নাকি সিংহাসনে? 
আপনি যেখানেই থাকুন যতদূরে
আপনি সরকারী হোন বা আধা
আপনি ফিরে আসুন
আমাদের মত কপালগুলোয় ভবিষ্যৎ লিখতে ভুলে গেছেন আপনি…
আপনি আসুন! 

আপনার রাজ্যে পঁচিশ…ছাব্বিশ…আঠাশ…ত্রিশের
বাবা মায়ের অসুখ হয়, বোন থাকে, 
স্বপ্ন আসে…
খিদে পায়!

হে বিধি! আপনি যেখানেই থাকুন ফিরে আসুন।

আপনি ফিরে এসে আপনার স্বচ্ছ কলমে যোগ্যতার স্বচ্ছ বিচার লিখলে না হয় পাথরের চোখ বানিয়ে নেব একখানা।
ইতি, আপনার ফেরার অপেক্ষায় আমাদের প্রবল খিদে…
—------------–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

অরোরা বোরিয়ালিস

আমার মল্লিকার কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
কী বলছো এসব মলি? 
গোলাপি মাছ, সবুজ ঘাস, আকাশে আকাশে 
আলোর চাষ?
এ শহরের কংক্রিটে কোথায় পেলে তাদের?

দশ বছর চাকরিতে কোনো প্রমোশন নেই
যাকে এক টুকরো দিঘা দেখাতে পারলাম না,
তার হাত ধরে অরোরা দেখাবো কেমন করে?

আমার মল্লিকার চোখে লাল রঙের নিরুত্তাপ দৃষ্টি,
বেগুনি শাড়ি, মেঘ রঙের চুল, বাতাসের মত
মৃদু হাসি ঠোঁটে
তুমি কেমন করে পেলে তাদের, মল্লিকা?

মল্লিকার আঁচল ভর্তি স্নিগ্ধতা
জিভ নড়ে উঠলো, বললো
এখানে সঙ্গম করলে জন্ম নেয় প্রজাপতি

আমার চোখের সামনে দিয়ে পরিযায়ী হাঁস উড়ে গেল 
নীল হ্রদে পা ডুবিয়েছি আমরা দুজন
আকাশে আকাশে ভেসে যাচ্ছে আলো গুলো
বেগুনি সবুজ ছাড়িয়ে লাল 
হৃদয়ের মত লাল

স্বর্গ গুহার দেওয়ালে দেওয়ালে ঘোষণা লিখছে
দেবতারা…
এ আলোয় স্নান করলে গর্ভ সূচিত হয়।
জন্ম নেয় ফুল।

মল্লিকা! আমার তৈলাক্ত মুখ।
ইঁট বালি সুড়কির ওঠাবসা
প্রমোশনহীন নির্জীব মেদ
এ শহরে আমার মল্লিকার চোখে আমি অরোরা
দেখতে পেলাম।

কঠিন অসুখ ছিল মল্লিকার। 
তবু তার মৃত্যু হল না। 

প্রজাপতির দল তার চোখ, মুখ, নাক ছুঁয়ে রইল।
আমি তার অশরীরী আলোয় স্নান করলাম।

এবার প্রজাপতি গুলো আমার চোখ, মুখ, নাক ছুঁয়ে
বসলো
—--------––--
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি!'

'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি!
ধম্মং শরণং গচ্ছামি!
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি!'

পুত্রহারা মায়ের কানে 
হাত পা বিহীন সরীসৃপ প্রায় ভিক্ষুকের কানে
অত্যাচারিতা স্ত্রীর কানে এ সুর দিলাম আমি
ওদের বুক ভিজে গেল। 
কান্নার প্রাচীর তুলে আমাকে আড়াল করতে করতে
ওরা বললো, এত দুঃখ তুমি নেবে?

মানুষটার প্রবল বৈভব
ঐশর্যের প্রাচুর্য
দাস দাসী 
কিন্তু মানুষটার বড় অসুখ
চিকিৎসক বদ্যি হাকিম অসহায় চোখে দেখছেন
তাঁর যন্ত্রণা
আমি গিয়ে মানুষটার বন্ধ চোখের উপর রাখলাম
মন্ত্র
'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি!'

মানুষটা চিৎকার করে উঠলেন,
এ যন্ত্রণা নিতে পারবে এখনই?

আমি বৃক্ষের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বললাম, 
অন্যকে ভালো রাখলে নিজে ভালো থাকা যায়, জানো?
'বয়ধম্মা সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথা'
আমার বুদ্ধের শেষ বচন।

আমাকে বিস্মিত করে বৃক্ষ বলে উঠল,
যা কিছু জাগতিক, অবশ্যম্ভাবী বিনাশ
তাই আমি প্রতি মুহূর্তে ভাগ করে নিই শ্বাস।

আমি সে বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরলাম।
এস এস প্রাণ! 
আমরা যে কদিন আছি বাকি
জড়াজড়ি করে থাকি।
জড়াজড়ি করে থাকি।

'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি!
ধম্মং শরণং গচ্ছামি!
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি!'
—--------------–––-
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

নিষিদ্ধ জন্ম

আমি কোনোদিন নিষিদ্ধ পল্লীতে যাইনি
সেন্টিনালী দ্বীপে গিয়েছিলাম।
ওদের ছোঁড়া তীর আমার গায়ে লাগার আগেই
খসে গেল।
ওরা অবাক হলো। আলোচনা হলো।

মেয়েটার খোলা চুল, খোলা বুক
ভয়াল সমুদ্রের মতই গায়ের রঙ
আমি ভয় পাইনি।
আমি কোনোদিন নিষিদ্ধ পল্লীতে যাইনি
সেন্টিনালী দ্বীপে গিয়েছিলাম।

চোখে শালুক রঙের বিস্ময় লেগে ছিল তার
আমার মৃত্যু হচ্ছিল না
ওরা ইশারা করছিল
কাঁচা মাছ চিবিয়ে খেতে খেতে হাসছিল
মেয়েটার কোমর জড়ানো অজগর
তার নিচে গুহা
মেয়েটার ঠোঁটে একখানা তিল
আমি ঠিক জানি, ঠোঁটে তিল থাকলে
প্রেমজ বিবাহ অবধারিত
মেয়েটা দুদিকে ঘাড় নাড়লো।
হৃদয় পড়ে ফেললো নাকি?

ওরা আমার পোশাক খুলে ফেললো
শুঁকে নিল মাথা থেকে পা পর্যন্ত
মৃত্যু কেন হলো না, এ বিষয়ে আশ্চর্য হয়ে
ওদের গবেষক ডেকে নিয়ে এলো।
কী সব বলাবলি করার পরে সবাই চলে গেল।

খেজুর কাঁটা দিয়ে ঘেরা আমার কারাগারে
মেয়েটা এলো চুপিচুপি
হাত বাড়িয়ে ইশারায় ইশারায় কথা বুনলো
চলে যেতে বললো
আমি বুঝলাম।
আমি নিষিদ্ধ পল্লীতে কখনো যাইনি
কিন্তু নিষিদ্ধ দ্বীপের আমি এ মায়া কাটাতে পারলাম না।

আমার হারিয়ে ফেলা বন্ধুরা দ্বীপের আশেপাশে
আমায় খুঁজতে বেরিয়েছে
আমাকে ডাকছে
আমার দিকে ফিরে যাওয়ার উপায় ছুঁড়ে দিচ্ছে
আমি খেজুর কাঁটার ভিতরে উন্মুক্ত মেয়েটার
হৃদয় খুঁজে চলেছি
বিষ খাওয়াবে আমায়
তিন রকম বৃক্ষের শিকড় বেঁটে সন্ধের সময়
বালির নীচে চাপা দেবে আমার শরীর
বুঝছি আমি, কিন্তু শুনছি না

তুমি জানো অলোকা, ঠোঁটে তিল থাকলে
প্রেমে বিয়ে হয়?
তোমায় একটা আকাশী রঙের শাড়ি কিনে দেব
সমুদ্রে এসে মিশবে আকাশ
তোমার চুলে দেব জুঁই
তোমার জন্য গান বাঁধবো

মেয়েটা আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে
তাকিয়ে রইল।
তারপর…
আমায় বিষ খাওয়ানো হল।

তারপর বালির নিচে টানতে টানতে নিয়ে গেল আমার শরীর
আমি ঘুমানোর আগে বিড়বিড় করলাম
অলোকা, তোমার গুহার দেওয়ালে আমি সভ্যতা
আঁকবো।
মেয়ে হলে নাম রাখবো বৃষ্টি

আমি কোনদিন নিষিদ্ধ পল্লীতে যাইনি
আমি সেন্টিনালী দ্বীপে গিয়েছিলাম।
আমার বন্ধুরা আমায় না পেয়ে ফিরে গেছে
আমার ঘুমন্ত চোখ 
নীল শরীর
নাক দিয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত
শ্বাসে আটকে যাচ্ছে বালি

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আমার
মেয়েটার উন্মুক্ত বুক থেকে মাতৃত্ব গড়িয়ে পড়ছে আমার মুখে
আমার পাশে শুয়ে আমার আলোকা
এক নিষিদ্ধ দ্বীপে আমার নতুন জন্ম দিচ্ছে
তার স্তনের চারপাশে থোকা থোকা জুঁই
গুহার দেওয়ালে আঁকা স্নেহ।

আমি বেঁচে উঠছি
আমার ঠোঁটে তিল 
গায়ের রঙ সমুদ্র
সারা শরীর উন্মুক্ত…

ফিরে আসার পরে আমি নিষিদ্ধ পল্লী গেছি বহুবার,
কিন্তু কোনোদিন সেন্টিনালী খুঁজে পাইনি।
—------------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

আমরা তোমার ছায়ায় মায়ায় বাঁচি, মা!

আমরা তোমার ছায়ায় মায়ায় বাঁচি, মা!

তোমায় দেখে দেখেই শিখেছি কীভাবে না খেয়ে
মাটি কামড়ে পড়ে থেকে ছিনিয়ে নিতে হয় 
অধিকার…

খিদেয় কুঁকড়ে গেছি!
গাল গেছে ভেঙে
কিন্তু চিবুক দৃঢ়

ঠিক সে মুহূর্তে তুমি এসে দাঁড়ালে পাশে
বললে, বাছা আমার! আমি আছি তো!

মমতা ভরা কণ্ঠে যিনি তুমি আমাদের কাঁধে হাত রাখলে
বললে, তোমরা এবার খাও
আমি তো মমতাময়ী! তোমাদের জন্যও…
নিজ বাসভবনে বসে তুমি প্রতিশ্রুত হলে,
চিন্তা কোরো না আমি তো আছি
এত স্নেহ যার! এত আশ্বাস
তিনি নিশ্চয়ই কুমাতা হতে পারেন না!

আমার ঘরে আমার গর্ভধারিণীর বড় অসুখ
বয়স্ক বাবা, ভাই বোনের লেখাপড়া…
আর আমার যোগ্যতা
যে নিজের মায়ের মুখে অন্নের সংস্থান করতে পারে
না, সে কী করে দেশ ভালোবাসবে 
হে মমতাময়ী?

তুমি বারবার আমায় কথা দিয়েছ
বারবার বলেছ, চাকরি তোমরা পাবেই
বলেছ, আমরা আছি তো কেবল ভোট টা হয়ে যাক…

তারপর…তারপর তোমার লোকেরা আমায় ধরে কারাগারে পুরেছে
আমায় শাসন করেছে
তর্জনী তুলে বলেছে, ওই যে চাকরিপ্রার্থী
ওরা সন্ত্রাসবাদী! 
ওরা আতংকবাদী!
আমাদের ভুলে
গেলে তুমিও…
তুমিও আমাদের ভুলে গেলে মা!
আমরা এখনো পথের ধুলোয় মিশে আছি
আমরা এখনো রোদ বৃষ্টি যন্ত্রণায় ভিজে আছি
আমার অসুস্থ মা এখনো কান্নার কাঁথা বুনছে

বলো তো তুমি কী করে তবে আমার যশোদা মা হবে?
তোমার শিকড় শক্ত করে রাখার মাটি
আমি কী করে হবো তবে?

আজ শুধু এইটুকু জেনে রেখো তুমি
তুমি যতই সন্ততি ভুলে যাও, যতই মায়া ভুলে যাও
আমার গর্ভধারিণী আর আমার বাবার দীর্ঘশ্বাসে
তোমার পথ হবে পিচ্ছিল

আর আমি তোমায় বারবার মনে করিয়ে দিতে দিতে
যদি একবার প্রবল স্পর্ধা হয়ে উঠি?
যদি একবার বারুদ হয়ে উঠি?

আমরা কুপুত্র হয়ে ওঠার আগেই
তুমি আমাদের সুমাতা হয়ে উঠতে পারো নিশ্চয়ই!
       —
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

অলিখিত পত্র

আমিও তাকে মন্দ মেয়েই বলি।
মন্দ সে নয় জানি 
তবু মা বললো, নাকটা বোঁচা
ও মেয়েরা খুব খারাপ হয়।
কাকিমা বললো, হ্যাঁ মরুভূমির মত চোখ
সংসারে অকল্যাণ একেবারে
বাবা বললো, না। আমি দেখেছি লুকিয়ে কাঁদে
ওটা তো আরো খারাপ!

জ্যেঠিমার অভিযোগ আরো গুরুতর
ঈশ্বরে ভক্তি নেই মোটে
কেবল রবি ঠাকুর আর রবি ঠাকুর
কাব্যি করা মেয়ে বড় ভয়ংকর!

আমি তাকে ঠেসে ধরি দেওয়ালে
জানিস, কেন তোকে মারছি?
সে বলে, জানি না তো! আমি মন্দ বোধহয় খুব…

অবহেলা পেতে পেতে
মার খেতে খেতে 
তারপর একদিন সে চলে গেল।
আমি কোনদিন তার এ স্পর্ধা ভাবিনি

মা বললো, মন্দ! ছি!
কাকিমা বললো, দুয়ো!
বাবা বললো, অলক্ষ্মী ছিল বলেই এত খারাপ হচ্ছিল
আমি বললাম, বেশ তবে তাই হোক। 
সব ভালো হোক।

একদিন, দুদিন, দশ দিন…
আমার মধ্যে বাসা গড়লো অনাবৃষ্টি
ফুটিফাটা ধূ ধূ ফাঁকা মাঠ
বুকের বামদিকে বসে থাকা গোলাপি রঙের যন্ত্রটা বললো,
এর নাম দুর্ভিক্ষ।

খবর পেলাম আমার মন্দ মেয়ে তোমার সঙ্গে থাকে।
তোমার উঠোন জুড়ে বৃষ্টি 
ক্ষেতে পাকা ধান
খড়ের আঁটি বোঝাই নৌকা
তার পায়ে আলতা, কোমরে চাবি গুচ্ছ
নবান্নের আয়োজনে তোমার বাড়ি উৎসব লেগে থাকে বারোমাস

খবর পেলাম, আমার মন্দ মেয়ে তার আকাশ উপুড় করে তোমার বুকে
শব্দ বোনে, কাব্যি করে, ছবি আঁকে…

আমার কান্নার বর্ণমালা নেই।
শুধু মনে পড়ে এইতো সেদিন 
প্রবল উত্তাপ সারা শরীরে আমার
ব্যথায় দু চোখ বোজা…
কাজ শেষ করে সে এসে বসে আছে পাশে।
তার ভেজা আঁচল আমার কপাল জুড়ে শুয়ে
শুষে নেয় আমার সমস্ত উত্তাপ,
আমার ব্যথা।

ও আমার মন্দ মেয়ের নতুন জীবন!
তার কাছে ক্ষমা চাইবার বর্ণও আমি শিখিনি কখনো

একটা প্রশ্ন কেবল তোমার কাছে…

তোমায় যখন সে খুব আদর করে, জড়িয়ে ধরে
বুকের উপর খুব ঢেলে দেয় সুর
শীতলপাটি বিছিয়ে বসে গল্প বাঁধে আগাগোড়া
তখন, কোনোদিন…কখনো 
আমার মন্দ মেয়ে তোমার বুকে আমার জ্বর খুঁজে
পেয়েছে গো? 
বলো না! ও ভালো মানুষ! 

ও হ্যাঁ, ওকে একটা কথা বলে দিও
ওর ঠাকুরকে আমি বড় আগলে রেখেছি এখন
নির্ঘুম রাত গুলোয় তাঁকে জড়িয়ে ধরি

আর একটা মজার কথা 
গতকাল কাকিমা আমার ঘরে এসে বললো,
এ কী রে! তোর চোখ এমন মরুভূমি হলো কী করে?

বাবা বললো, না না আমি দেখেছি লুকিয়ে কাঁদে…
—–---–--------–––-
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

আত্মদীপ ভবঃ!

কালো মেঘের ঘনঘটা। মাথার উপর ঝুঁকে পড়ছে
বজ্র। আমি ভীষণ রকম আশ্রয় খুঁজছি
বন্ধ ঘরটার চারপাশে গিয়ে কেঁদে উঠলাম
আমাকে বাঁচাও! 

বৃষ্টি নেমে এল। আমার কান্না ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
বিদ্যুতের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম 
ঘরের জানলা আধখোলা…
কাষ্ঠ হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলছে, ভয় পেও না। আমি আছি।

এক বৃক্ষের নীচে আশ্রয় নিলাম। 
সে আমায় শ্বাস দিল। আমিও তাকে।
রাত্রি নেমে আসার আগে আমায় বললো,
আত্মদীপ ভবঃ!

আমি কৃতজ্ঞ হলাম সে বৃক্ষের কাছে।
সে বলল
'অত্তাহি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরসিয়।'
তুমিই তোমার ত্রাণ জেনে রাখো।

দুই হাতে অন্ধকার কেটে কেটে এগিয়ে গেলাম
পায়ে পায়ে কন্টক। গায়ে গায়ে অদৃষ্ট ব্যথা

কিছু পরে আমার চোখ জ্বলে উঠল।
অন্ধকার মাড়িয়ে আমি আরো দ্রুত এগোলাম।
কণ্টক ডিঙিয়ে, ব্যথা এড়িয়ে খুঁজে পেয়ে গেলাম
বিশাল আশ্রয় এক…

মাটির উপর বজ্রাসন। চোখ মুদিত।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে ধরায়।
বজ্র মুহুর্মুহু।

আমি বসে আছি নিভৃত নির্ভয়।
আমার শরীর… গা ভিজে নামছে বিস্ময়
মাঝে মধ্যে চোখ জানলা খুলে আত্মা দেখে নিচ্ছে
কেউ কি বাইরে আছে? চাইছে আশ্রয়?

ওকেও শিখিয়ে দেব আজ
আত্মদীপ ভবঃ! আত্মদীপ ভবঃ।
–––----------–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

'Dogs and natives are not allowed!'

'Dogs and natives are not allowed!'
ছিঁড়ে ফেলেছিলাম ওদের ক্লাবের দেওয়ালে টাঙানো এ নির্দেশিকা।
ভয় পাইনি এক বিন্দুও…
ওদের প্রমোদ ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিলাম সেদিন।
নিজের জন্য নিজের কাছেই তো রেখেছিলাম স্পর্ধাকে।

কল্পনা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল আমায়, ছাগ বলি
দিতে পারিস, রাণী?
আমি হেসেছিলাম। না তা পারিনা। কিন্তু… 
চিবুক শক্ত করে বলেছিলাম, দেশের জন্য
মরতে ও মারতে দুইই পারি।

সমস্ত পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে ঢেলেছিলাম।
জয় হিন্দ! বন্দেমাতরম…
কেঁপে উঠেছিল ইউরোপীয়ান ক্লাব! প্রবল ইংরেজ।

আমিই তো সে!
বৈধব্যের নীতি অমান্য করে রামচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী
সেজেছিলাম। সন্ধান নিয়ে এসেছিলাম গোপন অস্ত্রের
আমার সারা অঙ্গে ঝাল লংকা ঘষছিল জমাদারনী
জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিলাম আমি
চিৎকার করে বলেছিলাম, বলবো না! বলবো না!
পানিশমেন্ট সেলে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল
আমি জ্ঞান হারাচ্ছিলাম
তবু বলেই চলেছিলাম, বলবো না। বলছি না।
গোল্ডি আমার সঙ্গে প্রতারণা করলো!
আমার চোখে আগুন!
বুকে ঘৃণা
ক্রোধ দিলাম উগড়ে গোল্ডির গালে
ইতিহাসের পাতায় লিখে দিলাম
শোনো! আমার অন্য হাত বাকি এখনো
প্রয়োজন পড়লে…

অস্ত্র আইনে প্রথম যেদিন ধরা পড়ি আমি পুলিশের হাতে
সেদিন ওরা আমার প্রহরা এত শক্ত করে দিল
মনে মনে হাসলাম
নারীকে কারা যেন হীন দুর্বল ভাবে আজকেও?

প্রীতিলতা আমি! ননীবালা আমি! দুকড়িবালা,
কল্যাণী হয়েছি। আমি সুহাসিনী হয়েছি। 
বীণা, কল্পনা হয়েছি।

ওই দেখতে পাচ্ছ মিছিল? 
ভালো করে তাকিয়ে দেখো সামনে বুক চিতিয়ে
ভারতবর্ষ মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলেছি আমি
আমি মাতঙ্গিনী! 
শুষ্ক ত্বক, জীর্ণ শরীর হলেও বুকে আমার জ্বলন্ত আগুন
ইতিহাস আমায় নাম দিল বীরাঙ্গনা।

এখন আকাশে ভাসছি আমি
পর্বতের শিখরে রেখে আসছি সাফল্য
বিজ্ঞানে জ্ঞান মিশিয়ে করে চলেছি আবিষ্কার
শিক্ষায় দীক্ষায় বৃক্ষ হয়ে উঠছি









কে ওখানে? ননী বালা দেবী?
এস পিসিমা, এস।
এক্ষুণি তোমার কথাই ভাবছিলাম। 
কী তেজ তোমার কণ্ঠে! ওহ! 
মনে পড়ে যায় সব গো
নির্দ্বিধায় অন্যের স্ত্রী হয়ে উঠলে
সারা শরীরে লংকার ঝাল মেখেও হেসে উঠলে
মাটির নিচে পানিশমেন্ট সেলের অত অত্যাচারেও 
বলে উঠলে, বলছি না। বলবো না।
গোল্ডির গালে দিলে চড়
আগুনের মত তেজ তোমার চোখে এখনো, পিসিমা?

ওই দেখো ঐদিকের তারাটাও জ্বলতে জ্বলতে
এদিকে আসছে। 
চিনতে পারছো তুমি? 
অস্ত্র আইনে প্রথম বন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামী 
দুকড়ি বালা দেবী।
পিসিমা, ভালো আছো? 
সারাটা জীবন উৎসর্গ করলে দেশের জন্য
বলেছিলে, ছেলেরা পারলে মেয়েরা কেন নয়?
এ কী তোমার চোখেও জ্বলন্ত প্রতিবাদ যে দেখি এখনো!

কল্যাণী, বীণা, কল্পনা, সুহাসিনী সবাই এসেছ
ঘিরে ধরেছ আমার চারপাশ
আমি কি তবে ঘুমিয়ে ছিলাম এতদিন? 
তোমাদের এ আগুন আমায় স্পর্শ করেনি কেন? 
ওই তো… ওই তো লাঠি হাতে মিছিলের মুখে
মাতঙ্গিনী হাজরা

আমায় ডাকছে…
বলছে, প্রীতিলতা! ভারতবর্ষের মাটিতে এখন
স্বার্থ আর দ্বেষ
ভারতবর্ষের মেয়েরা এখনও কোথাও পড়ে পড়ে মরে।
ওদের শেখাতে হবে। 
ওদের মুষ্ঠি শক্ত করতে শেখাতে হবে
ওদের জাগাতে হবে।

হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাদের সঙ্গে আমিও যাবো। 
জ্বালা মুখ হয়ে কীভাবে অন্যায়ে লাভার উদগীরণ 
ঘটাতে হয়, তা শিখিয়ে আসবো।

শুধু একটা মাস্টার দা খুঁজে আনা চাই! 
আর অন্যায়ের হাতে ধরা পড়ার আগে খানিকটা পটাশিয়াম সায়ানাইড…
–––– —------- ––––-
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

যেতে যেতে পথে…

'যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি।
ঝড় এসেছে, ওরে…'

আমার হৃদয়ে মরুর হাহাকার, বাইরে প্রবল প্লাবন।
পিতা,মাতা, ভ্রাতা, ঘর… সব নিয়েছে বিধ্বংসী সে ঝড়

শূন্য আঙিনায় আমি সেদিন একা।
আকাশের বিদ্যুৎ থেমে গেছে। 
অন্ধকারে ঝিল্লি ডেকে চলেছে এক টানা। 

পাড়ার জ্যেঠু, কাকু আমাকে আমার পরিবারের সঙ্গে কিছুতেই সহমরণে দিল না
সহ হরণে নিল।

তাদের শ্মশান খরচ, আনুসঙ্গিক অন্যান্য…
শরীরে ঝঞ্ঝা আমার আরও প্রবল
আঁচড় কামড় ঘা…

সব শেষে যখন রাত্রি গভীর, 
আমার ছিন্ন আঁচল লুটালো পাথর ছড়ানো পথে

সূর্য ওঠার আগেই একটা ছ ফুট বাই সাত ফুটের কামরায় রক্তাক্ত আমার গা চেটে দিয়ে গেল
সে পাড়ার কুকুর।

আমার দু চোখ স্থির হয়ে রইল। নির্ঘুম, নিঃস্বপ্ন।

এরপর প্রতিদিন রাত আসে।
ঠোঁটে রঙ বোলাই। হাতে তুলে ধরি কুপি।
একটা দুটো চারটে ছ'টা নরক তৈরি হয়
আমার বুকে, মুখে, গহনে।

একদিন আমার কামরায় থলি ভর্তি সৌরভ এল কোত্থেকে
আবেশে আকুল হলাম আমি।
জিজ্ঞেস করলাম, কে তুমি? এ গুলো কী এনেছ থলিতে?

তার হাতে ধরা আলো। আমার দিকে বাড়িয়ে দিল…

'সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা,
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়
আমারে তুমি করিবে ত্রাণ, এ নহে মোর প্রার্থনা…'

আমার মত তোমারও বুঝি সব হারিয়েছে?
সে হেসে এক মুঠো চাঁপা আমার কোঁচড়ে দিয়ে 
চলে গেল। 
মিলিয়ে গেল নিমেষে।

এরপর সে প্রতিরাতেই আসতো। আমায় চাঁপা
দিত, আর দিত রবীন্দ্রনাথ…
'বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি, সে কি সহজ গান !'

শেষ যেদিন এসেছিল, সেদিন এ পাড়ার কুকুরগুলো
ওর ঘাড়, মাথা কামড়ে ধরেছিল।
স্পর্ধা অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছিল সে ভিক্ষুকের।
ও রক্তে ভেজা শেষ চাঁপা দুটি কম্পিত হাতে 
আমায় দিয়ে বললো, 
'মোর মরণে তোমার হবে জয়।'

আমার দু চোখে আগুন জ্বলে উঠলো এইবার।
এক ভয়ংকর দাবানল! 
সব কটা কুকুরের সব দাঁত নিলাম উপড়ে
ছয় বাই সাত ঘরের দেওয়াল দিলাম ভেঙে
দুহাতে কুকুরগুলোর আর্তনাদ নিয়ে 
আমি ছুটে চললাম সকালের দিকে…

ছুটতে ছুটতে…
আরও চল্লিশ বছর কাটিয়ে দিলাম 

পাহাড়ের পাদদেশে এসে বসলাম। 
এখানে শান্তি বয়ে যায় কুলকুল শব্দে।
হরিণের বুকে মাথা রেখে হরিণী ঘাস ফুল গায়।
বুনো হাঁস তানপুরায় বাঁধে স্ত্রী হাঁসের মন

আমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছে তাদের।
অরণ্য, নদী, পাখি সকলকেই বলে রেখেছি 
যেদিন প্রথম সকাল হবে, সূর্য উঠবে…
যেদিন আমার দু চোখে ঘুম নামবে…
সেদিন আমার পাশে রেখো একটি কেবল
'গীতবিতান'। 

আমার সে হৃদয় সহবাসী বিরহী আমার হাতে হাত
রাখবে। প্রসন্ন হবে। 
স্বপ্ন আঁকবে। 

রবীন্দ্রনাথ ছাড়া মৃত্যুই কী সহজ এত? 

'গীতবিতান' আর আমার কপালে প্রথম চুম্বন দেবে তার…
'কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুমচয়নে।'
—----------------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

বীরাঙ্গনার মা

'Dogs and natives are not allowed!'
ছিঁড়ে ফেলেছিল সে মেয়ে ওদের ক্লাবের দেওয়ালে টাঙানো এ নির্দেশিকা।
ভয় পায়নি এক বিন্দুও…
ওদের প্রমোদ ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিল সেদিন।

কল্পনা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল তাকে, ছাগ বলি
দিতে পারিস, রাণী?
সে হেসেছিল। না তা পারিনা। কিন্তু… 
চিবুক শক্ত করে বলেছিল, দেশের জন্য
মরতে ও মারতে দুইই পারি।

সমস্ত পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে ঢেলেছিল সে মেয়ে।
জয় হিন্দ! বন্দেমাতরম…
তার কণ্ঠে কেঁপে উঠেছিল ইউরোপীয়ান ক্লাব! 
প্রবল ইংরেজ।

ওই তো ননী বালা দেবী
এক্ষুণি তার কথাই ভাবছিলাম আমি। 
কী তেজ ননীর কণ্ঠে! ওহ! 
মনে পড়ে যায় সব গো
নির্দ্বিধায় অন্যের স্ত্রী হয়ে উঠল সে
সারা শরীরে লংকার ঝাল মেখেও হেসে উঠল
মাটির নিচে পানিশমেন্ট সেলের অত অত্যাচারেও 
বলে উঠল, বলছি না। বলবো না।
গোল্ডির গালে দিল চড়

ওই আর একজন 
অস্ত্র আইনে প্রথম বন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামী 
দুকড়ি বালা দেবী।
সারাটা জীবন উৎসর্গ করল সে
বলেছিল, ছেলেরা পারলে মেয়েরা কেন নয়?

কল্যাণী, বীণা, কল্পনা, সুহাসিনী আরো কত যে 
বজ্র আমার!

ওই তো… ওই তো লাঠি হাতে মিছিলের মুখে
মাতঙ্গিনী হাজরা
সারা শরীর রক্তে ভিজে তার, তবু পতাকা খানা
আগলে রেখেছে বুক দিয়ে…

আকাশে মাটিতে পর্বতে আমার মেয়েরা 
লিখছে নাম। গাইছে জয়গান
বিজ্ঞানে জ্ঞান মিশিয়ে করছে আবিষ্কার
গলায় স্টেথোস্কোপ নিয়ে হয়ে উঠছে 
আশীর্বাদ…
গর্বে আমার হৃদয় ভরে উঠছে।

তোমরা আমায় ভারতবর্ষ বলে ডাকলেও
আমি গলা উঁচিয়ে বুক ফুলিয়ে বলি,
ওরে! আমি শুধু ভারতবর্ষ নই রে
তোরা শোন! 
আমি শত শত লক্ষ লক্ষ বীরাঙ্গনার মা
আমি বীরাঙ্গনার মা

তবুও আজ বড় স্বার্থের কষাঘাত
দ্বেষ হিংস্র হয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠছে
হানাহানি, দাঙ্গা…
কখনো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে কান্নারা
ছিন্ন ভিন্ন প্রাণ ছটফট করে মাটিতে!

ঠিক তখন আবার আমার প্রসব বেদনা উঠতে চায়
আমার গর্ভ জন্ম দিতে চায় ঝাঁসির রাণী, প্রীতিলতাদের…
আমি যে কেবল ভারতবর্ষ নয়, আমি বীরাঙ্গনার মা হতে চাই!
বারবার…
বারবার…
—-----------–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

নিজের গড়

এই মনে করো একমুঠো ছাই
উড়িয়ে দিও। ভাসিয়ে দিও।
অমূল্য কিছু না পেলেও ছাই দূর হয়ে
সে স্থান হয়ে উঠবে উজ্জ্বল। 
চারিদিকে দেওয়াল দেবে বাতাস
রোদ্দুর পড়ে সেখান সোনার মত চকচক করবে।
তুমি তার নাম রাখতে পারো, সোনার সর।

যদি পদ্মের পাতায় টলমল করে জল
তুমি তা বেঁধে দিও তোমার দুহাতের প্রহরায়।
সে জল মুক্তা না হলেও তোমার তৃষ্ণায় 
এক বিন্দু শান্তি হতে পারে। 
তুমি তার নাম রাখতে পারো, প্রাণের ঘর।

প্রতিটি ধূলিকণা মেঘ হতে পারে
বৃষ্টি হয়ে তোমার স্নান হতে পারে
মাছরাঙা রঙ নিয়ে এসে তোমায় বন্ধু করতে পারে
কলমি লতায় লুটিয়ে পড়তে পারে আলো
তোমার উঠানে খেলতে আসতে পারে
চড়াই, শালিক, পায়রা।
তুমি তাদের কথা বুঝতে না পারো
কিন্তু তারা তোমার গান হতে পারে স্বচ্ছন্দ্যে।
তুমি তোমার উঠানকে ডাকতে পারো, আনন্দ-বর।

এই মনে করো, বিষাদ বড়, দুঃখ যাপন
তোমার জন্য পথ নেই, রথ নেই।
শোককে খুব ধুইয়ে দাও।
মন থেকে চোখ, চোখ থেকে গাল
গাল থেকে খুলে রাখো বাষ্পে…
ভালোবাসো, ভালোবাসো, ভালোবাসো।
তুমি তোমার ফোলা ফোলা দু চোখের নিচে
হাসি রেখে তার নাম রাখতে পারো, নিজের গড়।

নিজেই নিজেকে জড়িয়ে ধরো।
নিজের সামনে জ্বালো আলো।
নিজের গড়ে নিজেই রাজা, নিজেই প্রজা
যুদ্ধ এলে সাজাও ক্ষেত্র হৃদয় ময়দানে

তারপর সন্ধি করো। ভালোবাসা ঢালো। 
তারপর সন্ধি করো। ভালোবাসা ঢালো।
—--------------–----–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

সত্য সুন্দর

"Beauty is truth, truth beauty,that is all
Ye know on earth, and all ye need to know.”

বিড়বিড় করে কথা কটি বলেই চোখ বন্ধ হল নিরূপমার। 
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়েই আচমকা পা পিছলেছে সে,
বাড়ির সম্মান পিছলানোর সামান্য আগেই।

সিঁড়িতে তেল ঢেলে রেখেছিল আমার কাকীমা।

দু বছর ধরে তারা অনেক সহ্য করেছে যে!

আমার মৃত্যুর আগের দিন নিরূপমার হাত
নিয়েছিলাম আমার হাতে।
বলেছিলাম, আমি তো যাবো অসুখে। ভেবো
চাকরি সূত্রে বিদেশ, তোমারও হবে প্রমোশন
সময় এলেই…
নিরূপমা হেসেছিল। আমি বলেছিলাম, এই তো চাই!

আমার মৃত্যুর দিন ও দ্বার রূদ্ধ করে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিল।
বৃষ্টিতে ভেজেনি। 

পাড়ার লোকে যৌথ পরিবারের দিকে তর্জনী
তুলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল, হায় হায়! শেষ হবে
এইবার বাড়ি এ অলক্ষ্মীর জন্য…

বছর চল্লিশের নিরূপমা আমার। 
বলে এসেছিলাম, 
আমার পরের জন্মদিনেও তোমার সাজ কিন্তু চাই!

ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল, লাল শাড়ি
সে হেসেছিল, প্রমোশন তাতে দ্রুত হবে বুঝি?

নিরূপমার এলো চুল। কম্পিত ঠোঁট। চোখে গান।

সোনার তরী হাতের ভাঁজে। 
আকাশে মেঘের হুলুস্থুল
পাড়ায় উষ্ণ আলোচনা

আমি বলে এসেছিলাম তাকে, সত্যকে সহজে নিও।

সিঁড়িতে তেল ঢেলেছিল কাকীমা। 

নিরূপমা বড় বাড় বেড়েছিল।
বৈধব্যের নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করছিল প্রতি মুহূর্তে
সাদা শাড়ি সরিয়ে রেখে পরছিল সে আমার
পছন্দের মাছরাঙা রং, গোধূলি রঙ।

নিরূপমার সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
তার নিজ হাতে তৈরি বাগান সৌরভ পাঠিয়ে
বারেবারে দেখে যাচ্ছে তাকে।
মনমরা প্রজাপতি, ফিঙে। 

মৃত্যু, বিজয় গর্ব কোরো না। এ আমার প্রমোশন।
তার বিড়বিড় শুনল হলুদ রোদ্দুর, মাধবীলতা আর আমি।
ঝমঝম করে নামলো বৃষ্টি। 
আমার হাওয়া শরীর খুব ভিজলো, খুব!

মৃত্যুর পরে নিরূপমার ঘুম ভাঙেনি এখনো।
ভাঙলে ওকে বলবো, এই ভালো। ধুলোয় ধুলো
হয়ে দুজনে সংসার করবো কেমন!

কিন্তু ওকে না বলে আমার উপন্যাসের উপসংহারে চুপিচুপি একটা কথা লিখে রাখবো,

নিরূপমারা মরেই যায়। কেউ পণের দায়ে, কেউ 
কলঙ্ক গায়ে…

তারপর ভুলে যাবো সব। 
নিরূপমা জেগে উঠলে দুজনে মিলিত উচ্চারণ করবো…
"Beauty is truth, truth beauty…"
—----------------------
SUJAN MITHI (SUATA MISHRA)