কবি-বাগেশ্রী আর কতক্ষণ? এ নাদ তোমার অন্তঃসলিলা ফল্গুকে আরো গভীরে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে যে!
পূজারিণী-ওই যে দেখো! খসে গেল তারা। ওর গা থেকে খসে গেল আলো। প্রদোষকালে ও গাইছিল,
'চরণ ধরিতে দিও গো আমারে…'
কবি-আমার যাবার সময় হল।
পূজারিণী-মূর্তিখানি আর একটু বাকি যে! দাও সময়।
কবি-তবে ওই তারার জন্য তোমার আঁচল বিছিয়ে দাও! তোমার ক্রোড়ে রজনীগন্ধা হয়ে ফুটে উঠুক। জ্যোৎস্না হয়ে উথলে উঠুক। স্নেহ হোক।
পূজারিণী-মায়া ফিরিয়েছি আগেই
কবি-তাই তো এসেছি আমি। যে মাটির মূর্তি তুমি গড়ছ আজ! ধুলার ফুল রেখেছ সাজিতে… যজ্ঞের আয়োজনে রেখেছ অরনি… এ পুজো আমি চাইনা!
তোমার হৃদয় খুঁড়ে ক্ষমা আনো! ক্ষম অতীত প্রখরতায়…শুষ্ক নদী, মরুভূমির ত্রাসে।
পূজারিণী-মূর্তিখানি প্রায় শেষ। এ মধ্যরাতে পূজার বাদ্যে গান ছাড়া আমার আর দেবার কিছুই নাই। মন্ত্রে মন্ত্রে অশ্রু কেবল… গ্রহণ করো আমায়! ঋণী করো!
কবি-অমৃতলোক থেকে তোমার আবাহনে দ্রুত এসেছি ছুটে। তোমার দুয়ার ধরে অপেক্ষা করেছি তোমার গহন নিদ্রার। স্বপ্নে তোমার আত্মার সামনে স্থির হয়ে আছি বসে। তুমি আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা করছ, অঞ্জলি দিচ্ছ অথচ পুরাতন গ্লানিতে ক্ষমা দিতে পারছ না? যে তারা খসে পড়ছে আলোহীন, তাকে ভালোবেসে বাসা দিতে পারছ না?
পূজারিণী-কবি! অন্তরে ঘৃণা বড়! শুধু তোমাকেই জড়িয়ে ছিলাম আমি। দাবানল পাঁজরে পাঁজরে। সে আর ফিরে আসেনি। এসেছে তার পত্র। এই দেখ, বুকের ভিতরে ভাঁজ করে রেখেছি আজও। প্রবল জ্বরে বাষ্প হতে চেয়েছি আমি! পারিনি। গর্ভে তখন এক পৃথিবী প্রাণ…
কবি-তবে! এই জন্য তো বলছি তোমায়। সে তোমার অমৃতলোক। সে সন্তান কোথায়?
পূজারিণী-আমায় ছেড়ে গেছে। বলে গেছে, পিতাহীন অরণ্য যাপন যুক্তিহীন। সে নিজে পিতা হয়েছে। শহরে সোহাগে সহজে আছে। তারপর প্রদীপ জ্বালাই নি আর কোনোদিন
কবি-আজ তবে আমায় ডাকলে কেন?
পূজারিণী-শেষ অর্ঘ্য নিবেদন করব তোমায়
কবি-কী সে?
পূজারিণী-আমার প্রাণের পুজো।
কবি-এ পুজো আমি নেব কেমন করে?
পূজারিণী-মধ্যরাতের কৃষ্ণ মেঘ ঝুলে আসবে আমার পুজোর পরে। পাঁজরে পাঁজরে যে দাবানল পুড়িয়ে দেবে আমার বুক মুখ চোখ শোক
তুমি আমার হোমানল গ্রহণ করবে কবি!
কবি-আমি কিন্তু হার মানিনি। চোখের জলে বিদায় দিয়েছিলাম আপন মৃত্যুকে বারবার…
পূজারিণী-আমিও দিয়েছি, নিজেকে।
কবি-আমি তোমার ভালোবাসায় সম্পুর্ন সিক্ত।
পূজারিণী-তবে নাও। এই দেখ আমার ক্রোড়ে খসে পড়া তারা খানি। ওকেও হারতে দেব না। শিখিয়ে দেব জীবনের বন্দীশ। ওই যে আমার সন্তান নিজ পুত্রের মুখে চুমো দিয়ে সুখ ছুঁয়ে নিচ্ছে। ক্ষমা করেছি ওদের।
প্রবাসে সুখী পরিবার তাকে তো কবেই …
আমায় গ্রহণ করো কবি!
কবি-বেশ। তবে তাই হোক। সময় হল শেষ। প্রত্যুষেই রওনা দিতে হবে ভৈরবীতে।
পূজারিণী-কবি! ধন্য আমি! আমি ধন্য! তুমি আমায় গ্রহণ করেছ! আমার শরীর ধোঁয়া হয়ে মেঘ হয়ে বৃষ্টি হোক। ক্ষমা হয়ে ঝরে পড়ুক এ বিশ্বের ঘাসে, বাসে, অবহেলায়…
শুধু আমার এ স্বপ্ন শেষ না হোক কোনদিন! এ নিদ্রা শেষ না হোক কোনোদিন! এ মন্ত্র উচ্চারিত হোক আমার রাত্রির প্রহরে প্রহরে…
'চরণ ধরিতে দিও গো আমারে, নিও না… '
—-------------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)
No comments:
Post a Comment