আমি সেই সালোকসংশ্লেষ

আমি সেই শিশু 
পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা ফ্যানের বাটি
দুখিনি মায়ের চোখের নিচে পেতে বলেছিলাম,
তোমার চোখে এত তো জল
একটু এতে দাও না ফেলে!
আলোনা ফ্যান কি খাওয়া যায়, মা?

আমি সেই কিশোরী
যার মা পাড়ার বড়লোকের সামনে
হাত জোড় করে বলেছিল, মেয়েটা বড় পড়তে চায়…
একটা বই দেবেন ওকে?

অত্যাচারী জন্মদাতা মাত্র বারো বছরে বিয়ে দিতে
চেয়েছিল আমার
আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অন্ধকারে
স্বপ্নে দেখেছিলাম একটা উড়োজাহাজ
আকাশ থেকে হাত বাড়িয়ে আমার দিকে
এক বাক্স বই ছুঁড়ে দিয়ে বলছে
এই নাও ইচ্ছে দিলাম তোমায়
তুমি পড়ো…

ঘুম ভাঙতেই খিদের জ্বালা, রক্তাক্ত মা।
জন্মদাতার জ্বলন্ত সুখটান।

আমি সেই তরুণী
মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে আমার ছেঁড়া খাতায়
শব্দে এঁকেছিলাম
নখ দাঁত বের করা এক ভয়ংকর
প্রবল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হো হো করে
হেসে উঠে বলেছিল, মেয়েদের এত শখ কীসের?

ছবিটার নাম দিয়েছিলাম পুরুষ।

আমি সেই সদ্য উনিশ
ফুলশয্যার খাটে যে তার স্বামীকে
জিজ্ঞেস করেছিলাম, বদলে দেবে আমার ছবিটা?
ভালোবাসবে?

লোকটা হেসেছিল। ঠিক আমার ছবিটার মত হাসি

আমার চোখের সামনে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছিল
বুকের ভিতরের পাঁজরগুলো ঠকঠক করে কেঁপে
উঠেছিল
আমার আঁকা ছবিটা লোকটার মুখে বসে গিয়েছিল
পরক্ষণেই
দাঁত নখ বের করে সে বলেছিল,
বউ মানে পায়ের জুতো, জানিস না?

আমি সেই গৃহবধূ
যাকে পিটিয়ে ব্যবসার লোকসানের কষ্ট 
মেটানো যায়
যাকে ইচ্ছেমত কামড়ে আঁচড়ে রক্তাক্ত করে
অধিকার ফলানো যায়
যার দিকে তর্জনী স্থির করে বলা যায়
মেয়েছেলের এত শখ কীসের?

আমি সেই নারী
দীর্ঘ বছর সহ্য করে করেও
ছবিটার আরো
বীভৎস রূপ আঁকার পরেও 
একদিন বাঁধ ভেঙে ফেলি

এক ধাক্কায় আমার সমস্ত কলংকের ভয়কে
দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে আসি
রাস্তায়…

আমি সেই মূর্তি
যার দিকে হাসি ছোঁড়ে পাড়া
অমঙ্গল ছায়া বাড়িয়ে মায়া দিতে চায় 
ওদিকে যেও না! ও এক ঘর ছাড়া নারী…
মর্মে ক্রুশ বিদ্ধ হয় সুখী দাম্পত্যের সাবধান বাণী

জন্মদাতা থুক্কার ছোঁড়ে মায়ের দিকে
সব তোর গর্ভের দোষ! আয় তো দেখি হাত'টা
ভাঙি। বুক থেঁতলাই… 

থেঁতলে দেওয়ার আগেই মায়ের হাত ধরলাম আমি
মায়ের বুকে আমার বুক দিয়ে আগল দিলাম।
বললাম, আমাদের সূর্য উঠবে।
উঠবেই, দেখো!

আমার কোনো ঘর নেই
আমার কোনো কান্নাও নেই

বৃষ্টির জল খেতে খেতে আমার মা বলে,
এইতো বেশ স্বাদ! আলোনা খাওয়া যায়।


আমি সেই সালোকসংশ্লেষ
যার নিচে বসে আমার এক পৃথিবী মা 
প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়।
—-------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

No comments:

Post a Comment