চিত্রাঙ্গদা

আমার পিতা তোমাকে চাইলেও
এখন আমি আর তোমাকে চাই না অর্জুন!
সমগ্র মহাভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে
ঘুরে আমি তোমাকে ভালোবাসতেই ভুলে গেছি

ভালোবেসেছি তোমার জ্যেষ্ঠ অথচ সুতপুত্র
কর্ণ কে।

আমি চিত্রাঙ্গদা! মণিপুর রাজকন্যা।
জন্মে নারী হলেও কর্মে আমি বীর!
উত্তর থেকে দক্ষিণ
পূর্ব থেকে পশ্চিম
বাম থেকে ডান
আমি বিস্তার করে রেখেছি আমার কঠিন বাহু,
স্নেহের স্রোত
আমার ছায়ায় কম্পিত হয় দুর্বৃত্তরাজ
আমার মায়ায় শঙ্কিত হয় দারিদ্র্য

কর্ণকে ভালোবাসতে বাসতে 
ওর সংকট মুহূর্তে পৌঁছানোর বড় বাসনা আমার…

যে ক্ষণে ধরণীর বুকে বসে যাবে ওর রথের চাকা
বীর যোদ্ধা, বীর হৃদয় কর্ণ ভুলে যাবে তার 
অস্ত্র বিদ্যা…
তোমার কানে মন্ত্রণা দেবেন কৃষ্ণ 
তুমি গাণ্ডীব তুলে নেবে হাতে…
ঠিক সে ক্ষণে আমি গিয়ে দাঁড়াবো কর্ণের সামনে
তোমার অঞ্জলীক চূর্ণ বিচূর্ণ হবে আমার 
দৃষ্টি বাণে
তুমি বিস্মিত হবে! কৃষ্ণ তোমায় আবার
প্রচেষ্টায় নিযুক্ত করবেন
আমি আবার কর্ণের প্রবল যন্ত্রণার সময়ে
ভালোবাসার মন্ত্র উচ্চারণ করবো
আমার শাণিত ওষ্ঠে…
হে পুরুষোত্তম 
আমি চিত্রাঙ্গদা। দুর্বল সঙ্গ না।
হৃদয় তোমায় দিয়েছি প্রিয়
নই রূপবতী; আমি বীরাঙ্গনা!

অর্জুন! তোমার প্রবল পৌরুষের ভীত কণ্ঠ 
যুদ্ধক্ষেত্রে আমার বজ্রমুঠিতে ছটফট করবে! 
তারপর আকাশে ভীষণ প্রখর সূর্য উঠবে
আমি প্রশ্ন করবো তাঁকে…
কেন, কেন?
আমার ভালোবাসা কেন এমন অসহায় মৃত্যুবরণ করবে, যখন আপনি ওর পিতা?

চারিদিকে ঝড় উঠবে অর্জুন!
অনুতাপে সূর্য লুকাবে মেঘে,
অন্ধকার হবে কঠিন!
তোমার শর দিকভ্রষ্ট হবে পুনরায়।

একটা কুটির বাঁধবো কুরুক্ষেত্র ছেড়ে।

একমুঠো মাটি কপালে লাগিয়ে আমার কর্ণ
আমায় বলবে…
বীর বধূ আমার!

অর্জুন! আমার নতুন মহাভারতের এ অধ্যায়ে
আমায় এমন সুখী দেখে তুমি ক্রুদ্ধ হয়ো না

তার চেয়ে বরং মাতা কুন্তীকে বুঝিয়ে 
যাজ্ঞসেনীর একলা পুরুষ হয়ো।
যাজ্ঞসেনীর একলা পুরুষ…
-------------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

শকুন্তলা

চা বাগানের কামিন বস্তিতে রোজই বসে
আসর।
একদিন মদের ঘোরে বাপ 
আমায় রাখল বাজি,
…লাগ লাগ লাগ শকুন নামে দশ ট্যাকা…

'শকুন্তলা' নাম রেখেছিল মা আমার
বিছানায় যন্ত্রণা নিয়ে আছড়াতে আছড়াতেও
আমায় বলতো, শকুন্তলা মা রে
এ অন্ধকারের ঠিক পরেই আছে
আলোর রেখা
ছায়াবৃত্ত টা তোকেই যে পেরোতে হবে রে মা!

মা আমার 'বর্ণপরিচয়' পড়েছিল
'সহজ পাঠ' 'বোধোহয়' ও…
মায়ের বাপ নিলামে তুলল তার ইজ্জত
আমার বাপের দয়া হল
ছিনিয়ে এনে চিনিয়ে দিল প্রেম

আমায় কোলে নিয়ে রোদ্দুরে পিঠ দিত মা
বাপ ঘাম নামিয়ে হাসি ফোটাতো ঠোঁটে
বলতো, কামিন হলেই বা কী!
তু আমাদের মেয়েকে বই শেখাইবি…

চা বাগানের মালিক মায়ের কোমর ধরল

বাপ খুন করল, জেলে গেল
মায়ের মরণ জ্বর হল। আমার জীবন পুড়ল।

বাপ ফিরে আসার আগেই আমার শরীরে
টলটলে নদী, মস্ত পাহাড়, গভীর গিরিখাত

বাপ ছুঁড়ে দিল আমায় চুলের মুঠি ধরে… 
মেয়েছেলে মানেই পাপ! মেয়েছেলে মানেই
সব্বনাশ!

আমি শকুন্তলা। 
আমার দুষ্মন্তর রাজ্য নেই
পান্তা আছে। 
চুপিচুপি দুপুর বেলা 
শ্মশান ধারের কুঁড়েয় গিয়ে রেখে আসি।
কোনো কোনোদিন লবন লংকা…

হাতের উপর হাত রেখে সে বলতো,
আংটি থাকুক বা না, দুষ্মন্ত কোনোদিন ভুলবে না
তার শকুন্তলাকে

কদিনের মধ্যেই দুষ্মন্ত চাকরি নিয়ে বিদেশে
রাজ্য গড়তে চলে গেল
পান্তা, কাঁচা তেঁতুল, স্মৃতি
পড়ে রইল শ্মশান পারে।

প্রাইমারীর সাঁওতাল দিদিমণি আমার বাপ 
জেল থেকে আসার
আগে আগলে রেখেছিল আমায়
বলল, শকুন্তলা তুই যা শিখেছিস
তাই নিয়ে শহরে যা! খেটে খা…

আমার বাপের বাজি চড়ছে
…লাগ লাগ লাগ শকুন নামে কুড়ি ট্যাকা…

তারপরের গল্প জানা চেনা
শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঝকঝকে আলো
চকচকে চোখ
ধবধবে ফর্সা বিছানা
নরম গদি, রাত জাগা কুকুর
ছিবড়ে মাংস, শকুনের আনাগোনা
কুড়ি ট্যাকায় হবে না বাবু
বান্ডিল বের করুন

বছর পাঁচেক পর
দুষ্মন্ত এল সব খুইয়ে একদিন
শকুন্তলা তুই এখানে?

আমি হাত থেকে ছুঁড়ে দিলাম বনফুলের আংটি
যা ভাগ! 
শকুন এমন ভিখিরীর পচা মাংস ছুঁয়েও দেখে না!
—---------------–-––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

'মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব…'

কবি- 'এসো এসো বিনা ভূষণেই, 
দোষ নেই তাহে দোষ নেই।
যে আসে আসুক ওই তব রূপ অযতন-ছাঁদে ছাঁদিয়ো।
শুধু হাসিখানি আঁখিকোণে হানি উতলা হৃদয় ধাঁধিয়ো' 

কবি-প্রিয়া- ইস! বড় কাব্যি যে আজ!

কবি- হ্যাঁ প্রাণে আছেন রবীন্দ্রনাথ।

প্রিয়া–আহ! মুখে ফের সিগারেট?

কবি–ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় মিলবে শরীর, এইতো নিয়ম প্রিয়ে

প্রিয়া–হাত ছাড়ো। আমি চলে যাবো।

কবি–আহা হা রাগ করছো কেন?
আজ এ অবিন্যস্ত তোমাকে সত্যিই অপূর্ব লাগছে।

প্রিয়া–কী যে তোমার অদ্ভুত ইচ্ছে…না সেজে আসতে হবে!

কবি– প্রকৃতি যে তোমায় এত সুন্দর সাজিয়ে পাঠিয়েছে
 'রজনীগন্ধা অগোচরে
যেমন রজনী স্বপনে ভরে সৌরভে,
তুমি জান নাই, তুমি জান নাই,...'

প্রিয়া-চলে তো আমায় যেতেই হবে। তবে দেরি কেন?
এবার ছেড়েই দাও। ভাসিয়ে দাও আমার স্মৃতি
তারপর যত ইচ্ছে সিগারেট খাও, কেউ দেখবে না!

কবি-কিছুই আর করার নেই, না?

প্রিয়া-চাকরি টা করলে না যে!

কবি- মানুষের হাতে মানুষ হাত ধরবে। এর সঙ্গে চাকরির কী সম্পর্ক?

প্রিয়া- খাওয়াবে কী? এ প্রকৃতি? আকাশ? বাতাস? নাকি ধোঁয়া?

কবি- ভালোবাসা।

প্রিয়া-(হেসে-)জানো না তুমি ভালোবাসা অভাবে কেমন জানলা দিয়ে পালায়?

কবি- আমার মাটি হতে বড় ইচ্ছে করে। আমার বুক থেকে রস নিয়ে জন্ম নেবে বৃক্ষ। সেই ছায়ায় বসবে তুমি এমন আলুথালু হয়ে। এমন অবাক তাকিয়ে থাকবে। রোদ্দুরের গন্ধ নেবে… বৃষ্টি পড়লে চুল খুলে দেবে। দুহাতে জড়িয়ে ধরবে প্রতিটি ফোঁটার আনন্দ। তোমার আঁচলের নীচে থাকবে গীতবিতান…

প্রিয়া- এসব কী বলছো আজ? কী হয়েছে তোমার? 
 
কবি- গত দু মাস মায়ের ঠোঁট সাদা। শুকনো মুখ। বাটিতে শুকনো মুড়ির উপর একটা বাতাসা দিয়ে পাশের বাড়ির কাকিমা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, অপদার্থ! 

প্রিয়া- এসব বলো নি কখনো?

কবি–-রক্ত বিক্রি করলাম। এর থেকে সহজে উপার্জন আমার দ্বারা আর কী বা সম্ভব? ছাইপাশ যা লিখি কোনো প্রকাশক কখনো ছাপবে না জানি। ঘাস হয়ে আমার খাতায় রয়ে যাবে। বড় জোড় তোমার বিয়ের পরে আমার বিষাদ হবে…

প্রিয়া–এমন বোলো না গো! কান্না পায় যে!

কবি–পরশু শেষবার রক্ত দিতে গিয়ে জানলাম আমার শরীরের রক্ত আর দেওয়া যাবে না। পচন ধরেছে প্রিয়ে! রক্তে কর্কট বাসা বেঁধেছে। আমাকে না নিয়ে ওর শান্তি নেই!

প্রিয়া–কী বলছো এসব? এমন করে মিথ্যে বলা যায় বুঝি? শোনো আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না। সেই আনন্দ নিয়েই আজ এসেছি তোমায় বলবো বলে। বাবা বলেছেন, তাঁর অফিসেই তোমায় ব্যবস্থা করে দেবেন। অবশ্য মন দিয়ে কাজটি তোমায় করতে হবে ব্যাস।

কবি–আমায় সমাধি দিও ঠিক এইখান'টায়…

প্রিয়া–তোমার দুটো পায়ে পড়ি! এমন বোলো না আর!

কবি–খুব বেশি সময় নেই হাতে প্রিয়ে। রবীন্দ্রনাথ তোমার আমার। এ কটা দিন আমায় তুমিই শুনিও। বাবাকে বোলো, ওসব চাকরি করা আমার ধাতে এ জন্মে আর কুলালো না!

প্রিয়া–আমি আর সহ্য করতে পারছি না!

কবি–যেতে তো হবেই প্রিয়ে…

প্রিয়া–ইস! একসঙ্গে ভালোবেসে একলাই যাবে বুঝি? ওহে কবি! নারী যদি পুরুষকে ভালোবাসা না দিতে পারে, রহস্যের মায়াজালে জড়িয়ে না নিতে পারে, তবে কেমন করে তার শব্দেরা খেলা করবে আঙুলে, কলমে শুনি!
আমি তোমার জীবনেও আছি। মৃত্যুতেও। যে কদিন আছে বাকি, এসো জুড়ে জুড়ে থাকি…

'উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান দুর্গমপথমাঝে
দুর্দম বেগে দুঃসহতম কাজে।
রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব--
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।'

কবি–প্রিয়ে…

প্রিয়া–ভালোবাসি। ভালোবাসি।
এ মন্ত্রে আমরা বিবাহিত হলাম আজ থেকেই। নাও ধোঁয়া ফেলে আপাতত ধুলো দিয়েই আমার সিঁথি ভরিয়ে দাও! 

কবি–ভালোবাসি…ভালোবাসি…
—-----–––------

SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

সুভাষিণী

নদীর ঘাটে একলাটি অশ্রু বিসর্জন করছেন প্রতাপবাবু? 
আপনার স্ত্রী প্রবল মুখরা? 
দ্বিপ্রহরে আপনার মাছ ধরার সঙ্গিনী সে 
কোনোকালে হয়নি?
সেজে দেয়নি যত্ন দিয়ে ভালোবাসায় মোড়া পান?
কাঁদবেন না প্রতাপবাবু! আর যাই হোক
মূক সু তো আর ঝোলেনি আপনার গলায়!

আমার স্বামীর দ্বিতীয়টি বেশ।
গান গায়, চোখ আঁকে।
নয়নতারা ফুল খুব পছন্দের তার
ঊষাকালে বাগানেই তার সময় কাটে বেশি
স্বামীটির আবার বিছানায় চায়ের শখ
মেটেনি জানি, কিন্তু ক্ষতি কী!

মতিহার কিংবা বেনারসি শাড়ির জন্য চিৎকারে
বাড়ি মাথায়ও তো সে করতে পারে!
কোনো কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা মূককে সুখ সাজিয়ে 
কি আর পাঠিয়েছে তার ঘরে?

বাপের চোখে জল দেখি মাঝেমধ্যে
মাও আঁচলে মুছে নেন দৈবাৎ

কেবল আমার সর্বশী, পাঙ্গুলির দুচোখের ধারা
কখনো বন্ধ হল না।
অন্য কেউ অবশ্য তা দেখতে পায় না।
শুধু আমার বুকের উপর পড়ে তা মনখারাপ হয়ে
গড়িয়ে যায় অনাথের মত।

সুখ-নিদ্রা তো কবেই ভুলে গেছে আমার সে 
বিড়াল।

না ঠাকুর! কোনো অভিযোগ নেই আমার আর।
আপনি আমায় মৃত্যু দিয়ে তো ভালোই করেছেন!
না। কোনকিছু ফিরে পাওয়ার লোভও আর নেই
আমার।

আপনার সুভাষিণী মরে গিয়ে যে মাটি হয়েছে ঠাকুর!
মূক হলেও…
এখন কি আর তাকে কেউ হারিয়ে ফেলতে পারে? 
—-----------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

ফেলে আসা…

অস্তাচলে দিবস। নিভু নিভু আকাশ।
পক্ব কেশ, কোঁকড়ানো ত্বক, ছিন্ন শিকড়
ঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে তুমি

ওই ভেসে আসছে বৃদ্ধ নদীর বুকে বুকে
তরীখানা…

কত তুমি পেলে মাটি, কত মাখলে গায়
আঙুলে আঙুলে হিসেব গুনে গুনে
ঘুমিয়ে পড়েছিলে এ অবেলায় 

তরী থেকে নেমে এল এক অপূর্ব জ্যোতি
তুমি বললে, জ্যোৎস্না? আজ পূর্ণিমা বুঝি?

হাসলো সে। তোমার কাঁধে রাখলো হাত।
আর কিছু পরেই নামবে রাত।
তোমার আকাশ হয়েছে ধূসর
পাঁজরে পাঁজরে ক্ষয়।

ভয় পেলে তুমি। অন্তত আরো কিছুকাল যদি…
জ্যোতি বেড়ে গেল শত গুন
আলো হয়ে উঠলো সকল।
তুমি বললে, অন্য দিবস?
সে আবার হাসলো। বললো, এই তো নিয়ম!
রাত শেষ হবে। জন্ম নেবে ঊষা। 
বেলা বয়ে যাবে।
অবেলায় সেও আসবে তোমার পিছু পিছু।

ধীরে ধীরে তুমি বসবে উঠে তরীর কিনারে।
বৈঠা বাইবে বাতাস।

তুমি ভাববে, কত ধান রয়ে গেল বাকি।
সাথীটির ক্রন্দন গান…

পিছন থেকে ডেকে উঠবে ঊষা, দ্বিপ্রহর, অপরাহ্ন…

কিছুপরে তোমার তরীর পিছে পিছে 
সাথীটির ক্রন্দন গান, তোমারই ফেলে আসা নবান্ন…
–––—--------------–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

এই বাচ্চা! শসা খাবি?

এই সর সর…সরে যা বলছি!
ওই নোংরা গা নিয়ে এদিকে একদম নয়!
ছি! ছি! ছি!...

ট্রেনের মহিলা কামরা। নিত্যযাত্রীর ভিড়।
গোটা কামরা জুড়ে কিছু সাজগোজ করা প্রাণী।
মধ্যে অগোছালো আমি। 

শব্দগুলো ভেসে আসার পর তাকিয়ে দেখি
বয়স কতই বা, এই সাত কিংবা আট
দুই গালে ক্ষত, চোখ রক্তবর্ণ। কটে যাওয়া চুল,
খালি পা।

আমি তার হাতে কয়েন দেওয়ার সময় কেঁপে
উঠলাম। 
কেন ঈশ্বর! কেন এরা আসে? কী বা ক্ষমতা আমার?

যত সব আগাছার দল!...
কামরার দুটো সিটের প্রাণীগুলোর কুঞ্চিত ঠোঁট 
বলে উঠলো।

শসা নেবেন, শসা…সস্তায় খান। গরমে ভালো থাকুন…

আর একটি…মেরেকেটে বারোর ঘরে পা

হ্যাঁ রে স্কুলে মিড ডে মিল…শ্রী ছেড়ে
কেন এসেছিস এখানে? 

আমার বাপ মাকে কে খাওয়াবে? তুমি?

না না এসব কথা উচ্চারিত হয়নি কোনো পক্ষেই

ট্রেনের শব্দ হৃদয় আর সাজ দুলিয়ে ছুটে চলেছে।

এই বাচ্চা শোন! 
কে ডাকলো? 
কামরার একদিকে একটি মানুষ?
বিস্মিত হলাম ভীষণ!

মানুষটি সেই সাত, আটের মৃতপ্রায় তারাকে
ডাকল
বলল, শসা খাবি?

কী বলল মানুষটি?
শসা খাবি? নাহ আমি যেন শুনলাম, বললো
আয় জীবন নিয়ে যা…

বিপরীত দিকের সজ্জিত প্রাণীদের ভ্রুতে বক্রোক্তি।

বছর বারোর সংগ্রামী বিক্রেতা পকেটে টাকাটা
ভরে নিল যত্নে…
আমি আবার যেন শুনলাম, 
বোনের খুব লাল চুড়ির শখ

ছেলেটি শসা খাচ্ছে। মানুষটি হাসছে।

আমি দেখতে পাচ্ছি, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি
ট্রেন ছুটছে আকাশগঙ্গার দিকে
ওই ময়লা পোশাকের রুগ্ন শিশুটির হাত ধরে
মস্ত বড় বৃক্ষ হয়ে নেমে যাচ্ছে মানুষটি
তার শিকড় ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা আকাশে
সালোকসংশ্লেষে প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে
স্টেশনের এক দুই তিন আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম।

বিপরীত দিকের প্রাণীগুলো লিপস্টিক, গয়নার প্রতিযোগিতা সামলাতে সামলাতে 
ট্রেন থামার পরে ধুপ করে নেমে গেল নর্দমায়।

আমি যেন দেখলাম …
মধ্য বারোর শসা বিক্রেতা বোনের হাতে 
লাল চুড়ি পরিয়ে দিতে দিতে 
হো হো করে হেসে উঠে বলল,

শুনে যাও, শুনে যাও! 
পৃথিবী এখনো বেঁচে আছে গো মেমসাহেব'রা! 
—-----–––--------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

ছুটি

'এক বাঁও মেলে না
দু বাঁও মেলে না…'
আমার ছয় বছরের ছেলে উদগ্রীব হয়ে উঠল
তারপর? ফটিকের কী হল মা?

প্রতিদিন সন্ধেবেলা গল্পগুচ্ছ শোনা চাই আমার
ছেলের।
তার খুব ইচ্ছে বড় হয়ে তার মাকে সে এত কাজ
থেকে ঠিক ছুটি দিয়ে দেবে।
আমি হেসে বলি, দূর পাগল! মায়েদের কি ছুটি হয়?

শাশুড়ি মায়ের ডাক, বৌমা চা চাই!
ছেলের উত্তেজনা, মা রান্নাঘর থেকেই বলো
আমি ঠিক শুনতে পাবো!

'এক বাঁও মেলে না
দু বাঁও মেলে না…'
ও মা মা…তারপর কী হল?
ফটিক ছুটি পেল?
ও মা মা…

বাড়ির চক্ষুশূল আমি। সিলিন্ডার বাস্ট।
আমার সারা শরীর আগুনের জ্বরে পুড়ছে
আমার ছেলে পড়ার ঘর থেকে চিৎকার করছে
ও মা মা…
বলো না গল্পটা!

শাশুড়ি হাসছে।
ননদ হাসছে।
স্বামী শ্রাদ্ধের হিসেব কষছে…

'এক বাঁও মেলে না
দু বাঁও মেলে না…'
ও মা! তোমার দিকে তাকানো যায় না!
কী ভয়ংকর হয়েছ তুমি?
আমার খুব ভয় করছে মা!

হাসপাতালে বিছানার সঙ্গে মিশে আছে আমার
পোড়া মাংসেরা…

আমার ছয় বছরের ছেলে আমার দিক থেকে
মুখ ফিরিয়ে ওর বাবার বুকে লুকিয়ে আছে।

আমি ক্রমাগত বিড়বিড় করছি
'এক বাঁও মেলে না…'

এখান থেকে কিছুদিন পরে আমাকে
মানসিক হাসপাতালে যেতে হবে ডাক্তারের নির্দেশে।

আমার ছেলে চলে যাওয়ার আগে চোখ ঢেকে আমায় বললো,
এবার তোমার ছুটি হবে তো, মা?

আমি ঝুলে যাওয়া সিদ্ধ ঠোঁট নেড়ে নেড়ে ক্রমাগত বিড়বিড় করি,
দূর বোকা! মায়েদের কি ছুটি হয় বাবা?
—-------–--––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

'চরণ ধরিতে দিও গো আমারে…'

কবি-বাগেশ্রী আর কতক্ষণ? এ নাদ তোমার অন্তঃসলিলা ফল্গুকে আরো গভীরে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে যে!

পূজারিণী-ওই যে দেখো! খসে গেল তারা। ওর গা থেকে খসে গেল আলো। প্রদোষকালে ও গাইছিল,
'চরণ ধরিতে দিও গো আমারে…'

কবি-আমার যাবার সময় হল। 

পূজারিণী-মূর্তিখানি আর একটু বাকি যে! দাও সময়।

কবি-তবে ওই তারার জন্য তোমার আঁচল বিছিয়ে দাও! তোমার ক্রোড়ে রজনীগন্ধা হয়ে ফুটে উঠুক। জ্যোৎস্না হয়ে উথলে উঠুক। স্নেহ হোক।

পূজারিণী-মায়া ফিরিয়েছি আগেই

কবি-তাই তো এসেছি আমি। যে মাটির মূর্তি তুমি গড়ছ আজ! ধুলার ফুল রেখেছ সাজিতে… যজ্ঞের আয়োজনে রেখেছ অরনি… এ পুজো আমি চাইনা!
তোমার হৃদয় খুঁড়ে ক্ষমা আনো! ক্ষম অতীত প্রখরতায়…শুষ্ক নদী, মরুভূমির ত্রাসে।

পূজারিণী-মূর্তিখানি প্রায় শেষ। এ মধ্যরাতে পূজার বাদ্যে গান ছাড়া আমার আর দেবার কিছুই নাই। মন্ত্রে মন্ত্রে অশ্রু কেবল… গ্রহণ করো আমায়! ঋণী করো!

কবি-অমৃতলোক থেকে তোমার আবাহনে দ্রুত এসেছি ছুটে। তোমার দুয়ার ধরে অপেক্ষা করেছি তোমার গহন নিদ্রার। স্বপ্নে তোমার আত্মার সামনে স্থির হয়ে আছি বসে। তুমি আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা করছ, অঞ্জলি দিচ্ছ অথচ পুরাতন গ্লানিতে ক্ষমা দিতে পারছ না? যে তারা খসে পড়ছে আলোহীন, তাকে ভালোবেসে বাসা দিতে পারছ না?

পূজারিণী-কবি! অন্তরে ঘৃণা বড়! শুধু তোমাকেই জড়িয়ে ছিলাম আমি। দাবানল পাঁজরে পাঁজরে। সে আর ফিরে আসেনি। এসেছে তার পত্র। এই দেখ, বুকের ভিতরে ভাঁজ করে রেখেছি আজও। প্রবল জ্বরে বাষ্প হতে চেয়েছি আমি! পারিনি। গর্ভে তখন এক পৃথিবী প্রাণ…

কবি-তবে! এই জন্য তো বলছি তোমায়। সে তোমার অমৃতলোক। সে সন্তান কোথায়? 

পূজারিণী-আমায় ছেড়ে গেছে। বলে গেছে, পিতাহীন অরণ্য যাপন যুক্তিহীন। সে নিজে পিতা হয়েছে। শহরে সোহাগে সহজে আছে। তারপর প্রদীপ জ্বালাই নি আর কোনোদিন 

কবি-আজ তবে আমায় ডাকলে কেন?

পূজারিণী-শেষ অর্ঘ্য নিবেদন করব তোমায়

কবি-কী সে?

পূজারিণী-আমার প্রাণের পুজো। 

কবি-এ পুজো আমি নেব কেমন করে?

পূজারিণী-মধ্যরাতের কৃষ্ণ মেঘ ঝুলে আসবে আমার পুজোর পরে। পাঁজরে পাঁজরে যে দাবানল পুড়িয়ে দেবে আমার বুক মুখ চোখ শোক
তুমি আমার হোমানল গ্রহণ করবে কবি!

কবি-আমি কিন্তু হার মানিনি। চোখের জলে বিদায় দিয়েছিলাম আপন মৃত্যুকে বারবার…

পূজারিণী-আমিও দিয়েছি, নিজেকে। 

কবি-আমি তোমার ভালোবাসায় সম্পুর্ন সিক্ত। 

পূজারিণী-তবে নাও। এই দেখ আমার ক্রোড়ে খসে পড়া তারা খানি। ওকেও হারতে দেব না। শিখিয়ে দেব জীবনের বন্দীশ। ওই যে আমার সন্তান নিজ পুত্রের মুখে চুমো দিয়ে সুখ ছুঁয়ে নিচ্ছে। ক্ষমা করেছি ওদের।
প্রবাসে সুখী পরিবার তাকে তো কবেই …
আমায় গ্রহণ করো কবি!

কবি-বেশ। তবে তাই হোক। সময় হল শেষ। প্রত্যুষেই রওনা দিতে হবে ভৈরবীতে।

পূজারিণী-কবি! ধন্য আমি! আমি ধন্য! তুমি আমায় গ্রহণ করেছ! আমার শরীর ধোঁয়া হয়ে মেঘ হয়ে বৃষ্টি হোক। ক্ষমা হয়ে ঝরে পড়ুক এ বিশ্বের ঘাসে, বাসে, অবহেলায়…
শুধু আমার এ স্বপ্ন শেষ না হোক কোনদিন! এ নিদ্রা শেষ না হোক কোনোদিন! এ মন্ত্র উচ্চারিত হোক আমার রাত্রির প্রহরে প্রহরে…
'চরণ ধরিতে দিও গো আমারে, নিও না… '
—-------------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

আমি সেই সালোকসংশ্লেষ

আমি সেই শিশু 
পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা ফ্যানের বাটি
দুখিনি মায়ের চোখের নিচে পেতে বলেছিলাম,
তোমার চোখে এত তো জল
একটু এতে দাও না ফেলে!
আলোনা ফ্যান কি খাওয়া যায়, মা?

আমি সেই কিশোরী
যার মা পাড়ার বড়লোকের সামনে
হাত জোড় করে বলেছিল, মেয়েটা বড় পড়তে চায়…
একটা বই দেবেন ওকে?

অত্যাচারী জন্মদাতা মাত্র বারো বছরে বিয়ে দিতে
চেয়েছিল আমার
আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অন্ধকারে
স্বপ্নে দেখেছিলাম একটা উড়োজাহাজ
আকাশ থেকে হাত বাড়িয়ে আমার দিকে
এক বাক্স বই ছুঁড়ে দিয়ে বলছে
এই নাও ইচ্ছে দিলাম তোমায়
তুমি পড়ো…

ঘুম ভাঙতেই খিদের জ্বালা, রক্তাক্ত মা।
জন্মদাতার জ্বলন্ত সুখটান।

আমি সেই তরুণী
মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে আমার ছেঁড়া খাতায়
শব্দে এঁকেছিলাম
নখ দাঁত বের করা এক ভয়ংকর
প্রবল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হো হো করে
হেসে উঠে বলেছিল, মেয়েদের এত শখ কীসের?

ছবিটার নাম দিয়েছিলাম পুরুষ।

আমি সেই সদ্য উনিশ
ফুলশয্যার খাটে যে তার স্বামীকে
জিজ্ঞেস করেছিলাম, বদলে দেবে আমার ছবিটা?
ভালোবাসবে?

লোকটা হেসেছিল। ঠিক আমার ছবিটার মত হাসি

আমার চোখের সামনে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছিল
বুকের ভিতরের পাঁজরগুলো ঠকঠক করে কেঁপে
উঠেছিল
আমার আঁকা ছবিটা লোকটার মুখে বসে গিয়েছিল
পরক্ষণেই
দাঁত নখ বের করে সে বলেছিল,
বউ মানে পায়ের জুতো, জানিস না?

আমি সেই গৃহবধূ
যাকে পিটিয়ে ব্যবসার লোকসানের কষ্ট 
মেটানো যায়
যাকে ইচ্ছেমত কামড়ে আঁচড়ে রক্তাক্ত করে
অধিকার ফলানো যায়
যার দিকে তর্জনী স্থির করে বলা যায়
মেয়েছেলের এত শখ কীসের?

আমি সেই নারী
দীর্ঘ বছর সহ্য করে করেও
ছবিটার আরো
বীভৎস রূপ আঁকার পরেও 
একদিন বাঁধ ভেঙে ফেলি

এক ধাক্কায় আমার সমস্ত কলংকের ভয়কে
দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে আসি
রাস্তায়…

আমি সেই মূর্তি
যার দিকে হাসি ছোঁড়ে পাড়া
অমঙ্গল ছায়া বাড়িয়ে মায়া দিতে চায় 
ওদিকে যেও না! ও এক ঘর ছাড়া নারী…
মর্মে ক্রুশ বিদ্ধ হয় সুখী দাম্পত্যের সাবধান বাণী

জন্মদাতা থুক্কার ছোঁড়ে মায়ের দিকে
সব তোর গর্ভের দোষ! আয় তো দেখি হাত'টা
ভাঙি। বুক থেঁতলাই… 

থেঁতলে দেওয়ার আগেই মায়ের হাত ধরলাম আমি
মায়ের বুকে আমার বুক দিয়ে আগল দিলাম।
বললাম, আমাদের সূর্য উঠবে।
উঠবেই, দেখো!

আমার কোনো ঘর নেই
আমার কোনো কান্নাও নেই

বৃষ্টির জল খেতে খেতে আমার মা বলে,
এইতো বেশ স্বাদ! আলোনা খাওয়া যায়।


আমি সেই সালোকসংশ্লেষ
যার নিচে বসে আমার এক পৃথিবী মা 
প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়।
—-------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

মনির জন্মদিন

মনির জন্মদিন


বৈশাখে আজ রোদ্দুরটা মাটির সুর বাঁধে

দুঃখেরা সব মরু তৃষায় কপাল কুটে কাঁদে


বৃক্ষ যেমন কুসুম ফোটায়, আলো বাঁধে ফলে,

আমার মনির হৃদয় জুড়ে খুশির প্রদীপ জ্বলে।


আমার মনি সুখের রানী। ধনী তার মন

এমন করে ভালোবাসতে জানে কোন জন?


মরতে চেয়ে ইচ্ছেগুলো আবার ওঠে জেগে,

আঁধার শেষে সূর্য ওঠে, ভরসা রঙিন মেঘে।


তুমি আমার বন্ধু মনি! তুমি জীবন বীণ!

এক পৃথিবী আলো তুমি! শুভ জন্মদিন!

—-------––––----------

SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

এই আমার মত…

করবো টা কী?
শব্দ গাঁথা ধিক্কার আর ঘৃণা ছাড়া

পারবো তা কি…
এক ছুট্টে এগিয়ে গিয়ে ধর্ষকের ওই
শিশ্নটাকে পুড়িয়ে দিতে?

শরীরের সব রক্ত হু হু করে বেরিয়ে আসে
যে মেয়েটির
দৌড়ে গিয়ে 
বুক দিয়ে আগলে রাখতে পারবো তাকে?

চামড়া পোড়া গন্ধটাকে ধর্ষকের ওই 
জিভে লোভে গুঁজে দিতে পারবো তা কি?

উফফ! করবো টা কী?
শব্দে বেঁধে চাবুক ছাড়া…
উল্টে পাল্টে স্নায়ু ছিঁড়ে আয়ু রেখে
পারবো তাকে ছড়িয়ে দিতে?

আট হোক বা আশি
ধর্ষিতা, ধর্ষিতাই…

এসব এত ভাবতে নেই।
কানকে এঁটে ঘুমিয়ে থাকতে হয়।

যাদের হৃদয় চিরে তবুও আওয়াজ ঢোকে
ভেজা চোখে মনে পড়ে
আত্মজকে…

তারাই বা আর করবে টা কী?

এই আমার মত থুতুর দলা 
বাগিয়ে ছুঁড়ুক শব্দ দিয়ে…

এই আমার মত থুতুর দলা
বাগিয়ে ছুঁড়ুক…

এই আমার মত…
       —
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

সহজ পাঠের বই

জন্মদিন! জন্মদিন! আজ ঠাকুরের জন্মদিন!
আমি বললাম, কী মজা! পায়েস হবে তবে!
মা হাসলেন। না তো বাবা! গান দিয়ে আজ
প্রাণের ঠাকুর ছোঁবে।

আমি যখন একলা থাকি, একলা থাকি কই?
দাদা এনেছে রবি ঠাকুর। সহজ পাঠের বই।

মায়ের কণ্ঠে বসেন ঠাকুর, সুরের মায়াজালে
আমি বললাম, কী মজা! ঠাকুর মানে ছুটি!
বাবা হাসলেন। ঠাকুর মানে মনের মধ্যে
আনন্দ লুটোপুটি।

আমি যখন একলা থাকি, একলা থাকি কই?
রবি ঠাকুর বুকে থাকেন। সহজ পাঠের বই।
—--------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

বৈশাখের পঁচিশ

এখনো ছাই ওড়ে
এখনো পোড়া গন্ধে নাকে চাপা দেয় ইতিহাস
মুহুর্মুহু গুলির শব্দ, রক্তের বন্যা
হত্যা লীলা…
আপনার তেজদীপ্ত তর্জনী গর্জন করে ওঠে,
…উপাধির নেই প্রয়োজন! 

এক বাঁও মেলে না
দু বাঁও মেলে না…
ফটিক এখন বড় হয়েছে
শ্রম দিয়ে জলের অঙ্ক কষে।
ডিঙি বাঁধা তার রাজগঞ্জের ঘাটে।
ধান তোলে, স্নান এলিয়ে দেয় স্রোতে
ফটিকের মা আপনাকে অনুরোধ করে বলে,
আমার ছুটি লিখুন কবি! আমার ছুটি! 

আপনার ভিক্ষুক এক কণাও তুলে দেয় না
রাজ ভিখারীকে
পথে প্রান্তরে বউ বাচ্চা পালে।
ষষ্ঠীর দান বছর বছরে…

খোঁকির বাবা কাবুলিওয়ালার কাছে মিনিকে
আর পাঠান না…
শিশু চোর ভেবে প্রথমেই তুলে দেন প্রশাসনে

আপনার সাধারণ মেয়ে প্রবাসী প্রেমে পত্র
লেখার আগেই ধর্ষিতা হয়। 
পেট্রোলের গন্ধে শ্বাপদও ধারে কাছে
ঘেঁষে না

যুদ্ধের ময়দানে আগুন নেভার আগেই
আবার জ্বলে ওঠে

আপনার আনন্দযজ্ঞের চারপাশে হুতাশের
আহ্বান…

কিন্তু কবি 
ও কী দেখছি আজ!
ওই যে পাকা ধানক্ষেতের উপরে সাদা মেঘ
ঝুলে আছে
তার মধ্যে ঠিক অমন এক তর্জনী
উত্থিত ঊর্ধে…
পোড়া ছাইয়ের জঙ্গল থেকে এক হয়ে
বেরিয়ে আসছে কোপাই আর পদ্মা!

জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রাচীর আরো উন্নত হচ্ছে!
বন্দুকের গুলির থেকেও অনেক উচ্চ…
ভিতরে মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে আপনার তর্জনীর
পাশে পাশে…
'আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি…'

ওহো! একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম কবি!
আজ বৈশাখের পঁচিশ। আপনার পুনর্জন্ম!
–––---------––––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

'হে নূতন…'

সন্ন্যাসিনীর শান্ত চোখ ধীরে ধীরে ভোর ছাড়ালো।
বেলা বাড়লো। 

হঠাৎ তাঁকে ঘিরে হই হই কলরব!
অট্টরোল…
নারী! নারী! নারী!

শান্ত চোখে আগুন জ্বলে উঠল
ধ্যানগম্ভীর বৃক্ষের চারপাশে 

রক্ত বর্ণ মাটি আগুনে স্নান শুরু করল

কলরব থমকে গেল
ত্রাস ফুটে উঠল দ্বিপ্রহরে

সন্ন্যাসিনীর গেরুয়া বসনে অনুতাপ ছুঁতে এল
তুমি মাতা! ক্ষমা করো! ক্ষমা করো!

দগ্ধ ধুলো বাতাসে বাতাসে ঘুরে চরণে হাত রাখলো
তাঁর…
শাখায় শাখায় চাতকের আহ্বান
বাঁশবনে পথিকের প্রশ্বাস

ধীরে ধীরে নিভে এল ক্রোধ
বৃষ্টি নেমে এল অগ্নি বর্ষণের পরে।

অন্তঃসত্ত্বা ধানক্ষেতের বুকে নৃত্য-সুখ 

সন্ন্যাসিনীর বন্ধ চোখ। অবারিত ক্রোড়।
কচি মুকুল টুপ করে এসে পড়ল তাতে।

সব পাখি গৃহে ফিরবার পালা হয়ে এল
সব কাঁধ নিশ্চিন্ত নিদ্রায়

সন্ন্যাসিনী তাঁর হাতখানি বাড়িয়ে দিলেন 
নভোনীলের দিকে…
সিক্ত মাটির তিলক পরিয়ে দিলেন আকাশের
ললাটে।
করজোড়ে বললেন,
'রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং,
তেন মাং পাহি নিত্যম্।'

বৃক্ষের পাশে চারা।
চারার ঠোঁটে গান…
'হে নূতন…'
–––---------––––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

ভাত

ওদিকে যেও না! ওদিকে গেলে মানুষের মাথা,
গলা, ঘুম মাড়িয়ে যেতে হবে!

কে বলল কথাটা? কে?

এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম।
কেউ তো নেই! 

বুকে হাত দিয়ে দেখি এ স্বর 
আমারই তেল চুকচুকে মুখের 

আমি থামালাম তাকে
থামো থামো! পাশ কাটিয়ে যেতে জানি আমি

ঝাঁ চকচকে শপিং মল। আলোয় ভেসে যাচ্ছে
চারিদিক।
রাত ভেঙে ভেঙে গাড়িগুলো হুশ হুশ
ছুটে যাচ্ছে রাজপথে।

আমি ফুটপাতে উঠলাম। হো হো করে হেসে উঠল
আমার ভিতরের মুখটা
এটা ফুটপাত কে বলল? বলো ফুটো-পাত

আমি পাত্তাই দিলাম না এবার ওকে।
না শোনার ভান করে এগিয়ে চললাম সামনের
দিকে

ছড়ানো ছিটানো মানুষ
উল্টানো ভাতের পোড়া হাঁড়ি
বাঁদিক ঘেঁষে বিজ্ঞাপন…
ভোট দিলে উন্নয়ন
ফাটা ঠোঁটে কোমল ক্রিম
হারিয়ে গেছে ধনীর দুলাল
খুঁজে দিলে টাকা

বিজ্ঞাপনে হেলান দিয়ে ক্ষুধার্ত ঘুম
উপবাসী ফুটো-পাত ঈশ্বর খুঁজতে
বিজ্ঞাপন টা যে কোথায় দেবে!

এগিয়ে চলেছি। রাত বাড়ছে। আমার 
পাশ কাটানোও। 
শর্ট কার্টে যেতে হলে এটুকু সহ্য করতে হয় বৈকি

ক্ষুদ্র মানুষ, বৃদ্ধ মানুষ, ছিন্ন মানুষ, ভিন্ন মানুষ
সব এক পাতায় জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে

নেবেন একে? নিয়ে যান না!
ওহো! বুকে হাত দিয়ে থামাতে যাই আবার
আমার তেল চুকচুকে মুখকে
না তো! তার কোনো আওয়াজ নেই
তবে কে বলল এ কথা?

পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে দেখি
ছোট্ট কচি আঙুল গুলো পাশে এসে হাত
ধরেছে আমার।
কে ও?

মায়ের কণ্ঠ কেঁপে উঠল
এ আমার ছেলে
আমার একলার…
আস্তাকুঁড়ে হয়েছিল।
বুকের দুধ ফুরিয়েছে
কলের জলও
তাই আজ ওকে ছেড়ে দেব বলে জেগে আছি এখনো
ভেবেছিলাম রাস্তায় নামিয়ে দেব
যদি ওর টলোমলো চলায় টলে যায় একবার
এ পৃথিবীর বিবেক…

আমি কোলে তুললাম সে গভীর দুটি চোখের
ক্ষুদ্র প্রাণ টিকে
বললাম, যদি কেউ জানতে পারে?
সে হাসল, বলল এমন আমাদের কত হারিয়ে যায়!
খোঁজ রাখে কে?

বললাম বেশ তবে তাই হোক। 
যদি কখনো আসি এ পথে আবার দেখা হবে।

ছেলের নাম রাখবো মিলিয়ে। বলো,
তোমার নাম যেন কী? 

সে মুখ নিচু করে বলল, আমি এখনো কুমারী।
নাম মেরী।

তবে ছেলের নাম যীশু না রেখে 
ভাত রাখতেও পারেন…
—-----------------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

'এসেছে রবির কর…'

অবসর নেওয়া মাস্টারমশাই বিছানায় শুয়ে
ভাবলেন, এভাবে চলবে না।
সন্ধে নামলে স্টেশনের ধারে ধারের 
অন্ধকার উপড়ে ফেললেন
ঘুম থেকে তুলে পথের হাতে তুলে দিলেন
একরাশ আলো।

বিজু বলে ওঠে, মাস্টার মশাই!
এ কার ছবি এনেছ আজ?
জুলি, মাধু ঝুঁকে পড়ল
ছবিটার দিকে

মাস্টার মশাই ছবিটা কপালে ঠেকিয়ে
বললেন, এটা বৈশাখ জানিস তো?
আজ পঁচিশেই তোদের মত
আলোদের কানে কানে গান ঢেলে দিতে
এসেছিলেন…

ইনি রবীন্দ্রনাথ।

মাধুর ভ্রু কুঞ্চিত,
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কে?

প্রতি সন্ধেয় তোরা এই পথে বসে 
যার কথা দুলে দুলে পড়িস
কাগজ কুড়াতে কুড়াতে যার সুর গুনগুন করিস
মনখারাপ হলে আমার নাতনি সুধা তোদের 
যে হাসি শুনিয়ে যায়
তাই রবীন্দ্রনাথ
মাস্টার মশাই এইটুকু বলেই চোখ বুজলেন।

তার পথ ছাত্রেরা চঞ্চল হয়ে উঠল।

রঘু এতক্ষণ চুপ ছিল। এবার উঠে দাঁড়িয়ে
বলল, আমি জানি মাস্টার মশাই!
আমি চিনি ওনাকে

মাস্টার মশাই চোখ খুললেন।
তাঁর ঠোঁটে আনন্দ উপচে পড়ল।
তুই চিনিস? বল তো? 
বল তো, উনি কোথায় থাকেন?

কেন… বুকে থাকেন।
এইখানে…

হাত দিয়ে বুকের বাঁ দিক দেখালো রঘু।

সমস্বরে পথ-ছাত্রেরা বলে উঠল,
তুমি তো সে!
তুমি আমাদের রবীন্দ্রনাথ, মাস্টার মশাই!
তুমিই…
সারাদিন ভিক্ষের পরে সন্ধের দুলে দুলে পড়া,
তোমার নিজের হাতে রান্না ভাত, ডাল
আর গান গুলো…

তুমি আমাদের রবীন্দ্রনাথ, মাস্টার মশাই!
তুমি আমাদের বৈশাখ…

মাস্টার মশাই চোখ মেললেন আকাশে
মেঘের বুক অবধি শ্বেত গুম্ফ
ঘাড়ে নেমে এসেছে কেশ রাশি…
ঢিলেঢালা কাপ্তান… হাতে আলো।
মুঠো মুঠো আলো
কোথাও কোনো অন্ধকার নেই!

সুধা এসে ভাত ডাল আর পায়েসের উপর 
রসগোল্লা ঢেলে দিল সবার পাতে আজ
খিলখিলিয়ে উঠে বলল, 
'ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি
এসেছে রবির কর…'
—------------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

বজ্র-চাষী

হে সুন্দরী বঙ্গ আমার! লতায় পাতায় হাসি
মাটির ঘরে মাটির বুকে স্বপ্ন রাশি রাশি। 
হাওয়ার সঙ্গে ভাতের থালায় জ্যোৎস্না গলে পরে
মেয়ে আমার রাজকন্যে, ভিক্ষু রাজার ঘরে।

দমকা বাতাস এল হঠাৎ! 
মেয়ে চুরি হয়ে গেল।
আমি প্রবল ঝড়েই ছুটলাম দিকবিদিক
চিৎকার করলাম, খুকু…কোথায় তুই?
আমার ঠোঁটে ভয় ঠেকালো মানুষ
চুপ! আমাদের ঘুম ভেঙে যাচ্ছে দেখছিস না? 
একদম চুপ!

আমি আইনের দরজায় গিয়ে আমার রুগ্ন
শরীর ফেলে দিলাম। 
গড়িয়ে পড়লাম পায়ে
ভিতর থেকে আইন বিরক্ত হয়ে বলল
আহ! এখনো সকাল হয়নি
সকালে আসিস…

সূর্য উঠতেই ঘাটে মাঠে বাটে সরগরম পাড়া
বুড়োর ঘরে দরজা নেই কেন? ঠিক হয়েছে!
আরে ও মেয়ে কেউ নেয়নি
ওই তো খেঁদি পেঁচি চেহারা
কোনো হা ভাতের সঙ্গে নিশ্চয়ই পালিয়েছে

আমার চোখে শুকনো সময় অঝোর বয়ে যায়
পড়শীরা সব সন্ধে বেলায় পোড়া লাশটা পায়

ভেসে যাচ্ছিল ভাগ্যিস তারা অনেক কষ্টে…

হে সুন্দরী বঙ্গ আমার! লতায় পাতায় হাসি
আমি ভিক্ষু, কাঠ গুঁজে দি মুখে… 
আমার মেয়ে বাসি

এরপর আমার ঘরের দেওয়াল দিই ভেঙে
শুধুই মাটি, সূর্য, শিকড়, আলো
আমার অস্থি রাখি খুলে খুলে

আগল-বিহীন কন্যে আনি জড়ো করে করে
বলি, এই নাও আমার হাড়
বজ্র গড় এতে

ওরা বিস্মিত হয়।
ভয় পায়, না না তা কেন?
আমাদের জন্য আপনি মৃত্যু বরণ করবেন কেন?

আমি আমার কণ্ঠে তেজ মেশাই
সেই জোয়ান বয়সের তেজ
আমার দেশ মায়ের শিকল খোলার সময়
যে তেজে জ্বলে উঠেছিলাম
বলেছিলাম, প্রাণ থাকতে আর নয়!
সেই তেজ

'মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতি
মোহামোহা চ ভবতী মহাসুরী…'

দেবী যেমন, মায়া তেমন, মেধায় তুইই সেরা
মহতী অসুরশক্তি তুই! …
আগুন দিয়ে নিজের পাশে লাগিয়ে দে না বেড়া!

আমার কুঁড়ে সম্পূর্ণ ভেঙে গেল
মাটিতে আগল হয়ে রইল আমার কন্যে হাজার হাজার
জিভ গুলো ভয় পেল
লুকিয়ে ফেলল লোভ

ঘুমেরা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল
ভয় পেও না তুমি! আমরাও জেগে আছি
প্রয়োজনে ডেকো
আইন বললো, না না আগে আমায় ডেকো

আমার মেয়েরা হাসল
ছুঁড়ে ফেললো ওদের 
চিৎকার করে বলে উঠল
শোনো! আমরাও এখন বজ্র হতে পারি

নম নম নম বঙ্গ আমার হাসি রাশি রাশি
লাশ হবে না কন্যে আমার কোনো…
আমি বজ্র চাষী!
—---------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)