ব্রততী

এমন করে কোনো কবিতার বৃক্ষে আমার সমস্ত 
হুতাশ ঢেলে দিইনি কখনো…
এমন করে আর কোথাও ভাঙাচোরা হৃদয় 
স্থির হয়নি কান্নায়

এমন করে হেসে উঠিনি
এমন করে দুরন্ত সৃষ্টিতে বেড়াতে যাইনি
পাহাড়ে কিংবা নদীর সীমানায়…

এমন করে আমার আমিকে ভালোবাসিনি
এমন করে বাঁচতে শিখিনি কবিতায়…

যে তর্জনী সবুজে সবুজ জীবন দেখায় দিগন্তে
তাকে আমি ব্রততী তো নয়!
ছায়া বলে ডাকি।

যে আগুন স্বর পাঁজর সিদ্ধ করে তুলে নিয়ে 
আসে প্রতিবাদ
সে আগুনের নাম ব্রততী তো নয়!
আমি তাকে মায়া বলে ডাকি।
         –
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

কর্কট ও আবির

সামনের মোড় থেকে বাঁয়ে তিন হাত গেলেই
সতী মায়ের থান। 
রোজ সন্ধেয় সেখানে পুজো হয়।
সতী মায়ের শরীরে প্রবেশ করেন দেবী
লোকে সিকি আধলা ষোলো আনা দিয়ে
জেনে নেয় ভূত ভবিষ্যৎ…
তা দিয়েই শাকটা মুলোটা কিনে 
দিনানিপাত করে সতী মা।

কাল গিয়েছিলাম আমি
ভক্ত সকল চলে গিয়েছিল,
আলো নেভানো।
চুপিচুপি সতী মায়ের আঁচলে দশ টা টাকা
রেখে জিজ্ঞেস করলাম, বলো তো মা
তোমার এ অভাব শেষ কবে হবে?

তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা
সতী মা ফুলে ফুলে কাঁদছিল…
বললো, আমার মত দুর্ভাগা আর কেউ নেই
পৃথিবীতে…

আমি হাসলাম। 
কী ভাবছ? আমার যন্ত্রণা কেন বলিনি ওকে?
সাহস পেত? 
সাহস আমি পেয়েছি শোনো…
আজ সকালে খুব জোরে জোরে রবীন্দ্রনাথ পড়ছিলাম
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে
সামনের আস্তাকুঁড়ে দুটো কুকুর মুখোমুখি
ঝগড়া করছিল
পিঠে বস্তা নিয়ে কাগজ কুড়ানো লোকটা
কাজ থামিয়ে সেদিকে তাকিয়ে হেসে উঠল
লোকটা হাসল? 
তার খৈনির ছোপ ধরা দাঁতগুলোয় আমার তখন
চরম অবিশ্বাস
মনে হল, পাহাড় হাসছে
নদী হাসছে
হাসছে গোটা বিশ্ব
আমি ডেকে বললাম, শুনছ তোমার কে কে আছে আর?
সে বলল, কেউ তো নেই!
আমি বললাম, অভাব? খিদে?
সে এবার আরো জোরে হাসলো
বললো, ওগুলো তো সবার থাকে…
ধনী গরিব সবার…

কী শিক্ষা বলো তো!
ওই অক্ষর জ্ঞানহীন কাগজ কুড়ানো মানুষটি 
আমায় কত সহজ শিক্ষা
দিল বলো তো!

শেষ প্রহর এসেছে আমার।
আর বিষাদ নয়!
চোখ মোছো।
এ পৃথিবীতে এমন আরো হাজার কর্কট আছে
তাই বলে কি কান্না নিয়ে মরতে হবে?

হাসো বলছি!
খুব হাসো!
এই শোনো না একটা কথা…
এখন বসন্ত চলছে
খুব বেশি ঘি দিও না গায়ে

এক মুঠো আবির ঢেলে দিও।
—-------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

ওকে অত ধরতে নেই…

ছোট্ট মরিয়ম বন্ধুর কানে ফিসফিস করে বলল
তোদের যেমন ঠাকুর, আমাদের আল্লাহ।
তোরা যেমন আল্লাহ শুনতে পেলেও দেখতে 
পারিস না, তেমনি আমরাও তোদের ঠাকুর
দেখতে পেয়েও, শুনতে পেয়েও ধরতে পারি না।

বড় রাস্তার মোড়ে জড়ো হওয়া জনগন
মাইকে মেজাজে ঘোষণা করছে,
হোক হোক হোক প্রতিবাদ!
ধিক ধিক ধিক্কার!

মেহের আলি একসময় নেতা ছিল
রাজনীতি থেকে বেরিয়েই পাগল হল

হাসতে হাসতে বসে পড়ল দুয়ারে
এক মুঠো মাটি মুখের মধ্যে ঠেসে দিয়ে বলল,

আজকের নাটক-বগটুই
নির্দেশনায়- মুখোশ
অভিনয়ে- কচি শিশু, নারী, গোছানো বাড়ি

দাউদাউ আগুন জ্বলছে! জ্বলবে!
নিখুঁত অভিনয়।
মানুষ পোড়া গন্ধে ম ম করছে চারদিক…
এই কে আছিস! এদিকে আয়!
যাত্রা দেখবি না? আর্তনাদ ফ্রিতে…
টিকিট নিবি না? আয় আয় নিয়ে যা নিয়ে যা…

ধোঁয়া ওঠে রাত্রে মরিয়মের ঘরে
মা ঠাকুমার পাশে সিদ্ধ হচ্ছে সেও
জানে না কেন
জানে না এ মঞ্চে কে তাকে নামিয়ে দিল
জোর করে পোড়া লাশের অভিনয়ে…

বন্ধু তার বলেছিল, 
মরিয়ম! একটাই জীবন
সবাই মানুষ! তবে কেন এত হাহাকার?
কেন এত স্বার্থের লড়াই?
মেহের আলি কেন খায় মাটি?

উত্তর জানা হল না বাবাকে ছুঁয়ে তার…
কারণ যাত্রাপালার নাম বগটুই
অভিনয়ে-কচি শিশু, অবলা নারীর ঝলসানো মাংস
টিকিট বিক্রি হাজার হাজার
শেয়াল কুকুর কে নেই লাইনে!

ক্যামেরার আলো, ঝলকানি তেজ…
ধিক ধিক ধিক্কার!

ভিখারি কোথাকার? ইশারা বুঝিস না?
এই দেখ থোকা থোকা নোট
মরে যাবি নাকি ওরে একটা অসহায় ভোট?

মেহের আলি পাগল।
দুদিন পরে ভুলে যায় সব
মাটি চুষে খুঁজে পায় 
অন্য কোনো ইশারা…

চুপ কর! নোট পাবি, ভোট দিবি!
একটাই জীবন
যখন খুশি যেমন খুশি মর গে যাহ!

মেহের আলি ফিসফিস করে দুয়ারে দুয়ারে,
পালা! পালা! 
ছবি উঠিস না!
এই দেখ কালকের বগটুই কাগজ
আমার মত লাট খেয়ে ছিঁড়ে মরছে…
হা হা হা…

মেহের আলি পাগল।
ওকে অত ধরতে নেই!
—--------------–-–-–
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

'হারাইয়া ফেলি চকিতে'

–হারিয়ে যাবে?

–মধ্য বয়স

–হোক না তা! ক্ষতি কী?

–হারাবে কোথায়?

–সবুজ ঘাসে। শাল শিমুলে।

–রাখাল হবে?

–তুমি মাটি

–শিকড় ছুঁয়ে থাকতে পারবে?
যদি প্রবল ওঠে ঝড়

–ঝড়ের পরে নামবে বৃষ্টি
তোমায় নিয়ে করব স্নান

–কোকিলটা কী বলছে বলো তো দেখি

–বলছে হারিয়ে গেলেও আদর খুঁজো

–পারব না পারব না আমি কিছুতেই পারব না

–আজও পারবে না তুমি? 

–না! আমি যে রং হীন

–ওই দেখো আম গাছটা

–নতুন পাতা?

–আমার চোখে দেখতে পাচ্ছ?

–মাটি বড় ধূসর

–খেজুর গাছে 

–বাবুই ?

–তোমার গালে হাত দাও একবার

–ইসস কী বসেছে এটা?

–আহা তাড়িও না ওকে

–প্রজাপতি কি আমার গালে মধু পেল?

–না বসন্ত পেল।
দরজা খোলো এবার সখি! রঙের হাটে মিলতে দাও
মাটি রঙের শাড়ি পরেছ আজ, বেশ লাগছে

–রংহীন দের এগুলোই তো রঙ

–বাতাসের রঙ?

–শূন্য।

–না। আগুন। 

–সে তো অক্সিজেন থাকে, তাই!

–না। জ্বলন্ত হৃদয় থাকে।
চব্বিশ বছর ধরে হাত পেতে আছি। এই অশোক জানে। এই দখিনা বাতাস জানে, এই মাঠ ঘাট বাট জানে

–ভয়ের রঙ ঘন কালো

–আর আলোর রঙ যে জীবন! তার বেলা?

–বেশ। চলো হারাই

–কোনখানে?

–ঘাসে বাসে

–আমার যে দিন ফুরালো
এখন যে যেতে হবে বন্ধু!

–আমি যে তোমার চোখে রঙ দেখলাম আজ! কত রঙ… কন্টিকারী গাছে বসে আছে ছোট্ট ফড়িং!
শিমুলের পাশে লজ্জা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাধাচূড়া
এ বসন্তে আমি হারাতে চাই! শুনছ তুমি?
আমার অন্ধ বৈধব্য, আমার বোবা দু চোখ তোমার আলোয় ঝলমল করে উঠবে! কথা বলবে! আমার মধ্য বয়স তোমার শরীরে শীতের দ্বিপ্রহর হবে, বসন্তের কোকিল…
ঊষার মত, সন্ধ্যার মত তোমার কোলে আবির ছড়াবো…শুনছ তুমি? শুনতে পাচ্ছ? কোথায় গেলে তুমি? আর একবার এস! আর একবার… আর একবার…

"হারাই-হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে ॥

কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।"
-------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)




রামধনু মাস

এমনি একটা দিনে
মা বকে দেন খুব…
জানলা দিয়ে তাকিয়ে কেন
পড়া বাদে অন্য কোথায় ডুব ?

জড়িয়ে ধরি আমি মাকে
বলো তো মা, এটা কী মাস?

মা বললেন, কেন চৈত্র চলছে! 

উঁহু! হল না! এটা রামধনু মাস।

মা হয়ে যান অবাক ভীষণ
কী করে তা হয়!

প্রজাপতি রঙ দেখবে তুমি?
মিথ্যে কিন্তু নয়!

শাল পলাশে আবির দেখো
হলুদ রোদ্দুর 
সবুজ সুখ ঝুলছে আমে 
মাটির বুকে সুর!

মাছরাঙা ওই দেখো দেখো
নীল, নীলাকাশ
শিশু ঊষা বলেছে আমায়
এ ভালোবাসা-মাস।

বন বেগুনে স্নেহ আছে, 
পথের ধুলোয় আলো
যেমন করে সন্ধে দীপে
শ্রদ্ধা তুমি ঢালো

মনের রঙ জানো মাগো?
বলোতো কী দেখি?

খুব হয়েছিস দিদিমণি
তুইই বল, শিখি।

মনের রঙ সারাবছর 
থাকতে চায় সাদা
মনের সঙ্গে জানলা গুলো
এক বৃন্তে বাঁধা।

মা বললেন, ঠিক বলেছিস
সবকিছু নয় পড়া
রামধনু মাস চিনতে হবে
ভালোবাসায় ভরা।

আয় রে সোনা চাঁদের কণা
আয়রে বুকে তুই
তুই আমার প্রজাপতি
চুমোয় তোকে ছুঁই।
—---------------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

সময় বড় কম

অ কোকিল কোকিল
তোমার সুরটা আমায় দেবে গো?
আচ্ছা আচ্ছা রাগ করে না
সবদিন তো না,
শুধু একদিন দা…ও!

দেখ দেখ চারদিক কেমন আগুন স্নান
শাল, পলাশ আর ঐদিকের ওই যে বৃক্ষ
ওটা কৃষ্ণচূড়া
ওরা সব আমার বন্ধু তো!
আমি বললেই ওরা তোমায় খেলতে নেবে
দুলতে দুলতে নামতাও শেখাবে
শুধু তোমার সুর টা একবার আমায় দাও!

সে বসন্তেও আগুন ছিল ফাগুন মাসে
বাবার ফেরার কথাও ছিল 
খুকু তোর জন্য টুকটুকে লাল জুতো নিয়েছি
আর কী চাস, বল আমায়?
আমি বললাম, তুমি তাড়াতাড়ি এস বাবা
আর কিছুই যে চাই না!

এল তো ঠিকই
বসন্তের লাল জড়িয়ে শহীদ এল।
আমার বাবার বুকের উপর শুধুই লাল!
শুধুই আগুন!
মা বললো, ও! এত আগুন কেন? 
বসন্ত এসেছে বুঝি? 
তোর বাবার গায়ে বসেছে?
কিন্তু এ যদি বসন্ত, তবে কোকিল ডাকে কই?

বাড়ির পাশের সব আগুন গাছ কেটে ফেলেছে
জ্যেঠু।
মাকে রোজ ডাক্তারে দেখে যায়
মা রোজ একই কথা বলে।
যাহ! ও আমার বসন্তই নয়!
বসন্ত হলে কোকিল ডাকত না?

এত দূর থেকে তোমার ডাক
যায় না মায়ের কাছে
তাই চাইছি দু হাত পেতে
দাও না কোকিল একটিবার
আমি মাকে তোমার গান শুনিয়ে বলে আসি
মা…মাগো! বসন্ত কোনোদিন হারায় না!
প্রতি বছরের শেষ দুটো মাস
সে আসে, তোমায় ভালোবাসে।
এই দেখ কোকিলের সুর এনেছি!

কী বললে, দেবে?
দাও দাও বন্ধু আমার একটুকু গান দাও!
হ্যাঁ হ্যাঁ আমার বাবার সমাধিতে গিয়েও
শুনিয়ে আসব, বাবা! দেখো মায়ের জন্য
কোকিল নিয়ে যাচ্ছি!

চুপিচুপি বাবাকে বলা শেষ কথাটা আমি
শুনে নিয়েছিলাম যে!
শুনছ! আমি না গানটা আবার শুরু করতে চাই
এবার এসে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেবে?
বাবা হেসেছিল। বলেছিল, 
বসন্তের কোকিল হবে খুকুর মা?

আমি যাই বন্ধু! মাকে কোকিল গান দিয়ে আসি।
তুমি কিন্তু কোত্থাও যেও না…
এই যাব আর আসব!
ডাক্তারকাকু জ্যেঠুকে বলে গেছেন
সময় বড় কম…
___________
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

একলা বোশেখ

একলা বোশেখ একলা তো নয়
সঙ্গে আছে মেঘ রোদ্দুর
ঝঞ্ঝা বিকেল, আমের মুকুল
ধুলো ওড়ানো অলস পথ
পাখির ঠোঁটে ঝুলছে খড়

একলা বোশেখ একলা তো নয়
সঙ্গে আছে মেঘ রোদ্দুর।

ওই যে লোক ক্ষেতের মধ্যে
ঘাম আদরে ভেজায় মাটি
ওই যে বৃক্ষ ঝিমিয়ে নিচ্ছে 
ওই যে কাক, কোকিল ডিমে
দিচ্ছে তা…

একলা বোশেখ একলা তো নয়
সঙ্গে আছে মেঘ রোদ্দুর।

শোঁ শোঁ করে ওঠে ঝড়
শিকড় ছাড়ে গাছ
ছিটকে পড়ে লতা
মাটির বুকে আছাড় খায়
ঘর ভাঙা সে কৃষক…
সবুজ শাড়ি চাষীর স্ত্রী 
হাত রাখে হাতে
শক্ত কাঁধের কান্নায়।
…এ যে কালবৈশাখী
থিতিয়ে গেলে আবার আমরা মাটি মাখব,
ঘর বাঁধবো…

একলা বোশেখ একলা কোথায় থাকে ?
মেঘের কোলে সোনা রোদ্দুর ভালোবাসা আঁকে।

একলা বোশেখ একলা কোথায় থাকে?
ক্লান্ত পথিক বটের ছায়ায় জীবন ছবি আঁকে।

একলা বোশেখ একলা কোথায় থাকে?
দুঃখ রাতের হৃদয়গুলো রবি ঠাকুর আঁকে।
—---------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

সমাধান

" ওঁ দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু !"

কে যেন দিচ্ছে কানে ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আমার গায়ে কারা যে দলে মেজে ঘি মাখাচ্ছিল।
চোখের উপর পাতা তো, তাই দেখতে পাচ্ছি না

ওই তো আমার মা কাঁদছে!
বলছে, ছেলেটাকে পুলিশে দে রে তোরা
ওকে শাস্তি দে!
আমার মেয়েটাকে শেষ করে দিল!
আমার মেয়েটা আর রইল না…!

“ওঁ কৃত্বা তু দুষ্কৃতং কর্মং জানতা বাপ্য জানতা ।
মৃত্যুকাল বশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্বমাগতম্
ধর্মাধর্ম সমাযুক্তং লোভ মোহ সমাবৃতম্
দহেয়ং সর্বগাত্রানি দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু!”

আমি জেনে বা না জেনে যতই পাপ দুষ্কর্ম করি
হে অগ্নিদেব দগ্ধ আমায় করো, ভাসাও মৃত্যুতরী… 

জ্যেঠুমনি আমায় দিয়েও বলিয়ে নিলেন।
ঠোঁট নড়ল না, শ্বাস পড়ল না কিন্তু
চিবুক পর্যন্ত মায়া জড়িয়ে ধরল।

কেন করলাম এ?
তাকে বাদ দিয়েও তো আমার বিশ্ব ভরা
ঘাসের উপর শিশির দেখতে ভালো লাগে বেশ
রোদ্দুরে ভিজতেও
আকাশের গায়ে ফুটে ওঠে তারাদের ঘর বাড়ি

কেন জ্যেঠুমনি এত কাঁদছ কেন?
আমি তো নিজের জন্যই এ পথে এলাম।

আমার শরীরে ঘি মাখানো শেষ হল।
চুল্লিও প্রস্তুত
সুযোগ বুঝে এই ভিড়ের মধ্যে একজন 
আমার ঠোঁটে হাত ছুঁইয়ে দিল

আমার নীল ঠোঁট নীল আকাশ হতে পারত

আমি তখন দশম শ্রেণি
আমি তখন আবেগ ভারী
বন্ধু মানেই আমার তখন
একমাত্র ঘর বাড়ি…

আহ সাদা কাপড় তুলো না আর
বড় লজ্জা গো!

প্রথম প্রেমকে একটা গোলাপ দিয়েছিলাম।
সে আমায় জুঁই
বলেছিল, তোমার গায়ে জুঁইয়ের গন্ধ যে!
মানুষ আবার ফুল! যাহ মিথ্যে কথা
সে মুখ চেপে বলত, এগুলো গোলাপের পাপড়ি।

ও মা! এত কেঁদো না মা
আমি বুঝতে পারিনি
প্রবল রাগে এ কাজ করেছি আমি

সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে
হাসতে হাসতে জোড়া মানিক
পেরিয়ে যাচ্ছে আমার পাশ দিয়ে…

আমি বললাম, আমি সব বলে দেব
সঙ্গের জন বললো, কী বলবে? কাকে বলবে?
ঈশ্বর কে। আমি কান্না ধুয়ে বললাম
ওরা দুজন হো হো করে উঠল,
তাহলে তো মরতে হবে তোমায়!
নইলে ঈশ্বর আর কোথায়?

আমার বুকে মাংস নয়, জুঁইই ছিল।
দুমড়ে মুচড়ে গড়িয়ে গেল গা থেকে

বেড়া চাঁপার ফুল থেকে মধু বের করে
জিভের উপর উপুড় করেছিল সে ভালোবাসা

চুল্লি যে ঢোকালো।
ভিতরে গনগনে আগুন।
ডোম দরজা দিল টেনে
ও বোতাম টা টিপলেই
আমি জ্বলে যাবো
আমি হারিয়ে যাবো…

মাগো, আর এ ভুল হবে না কোনদিন
আমায় বাঁচাও মা!
বাঁচাও!

কী বলতো তুই? সকাল আটটা অবধি স্বপ্ন দেখছিস?
চমকে উঠে চোখ রগড়ে 
মায়ের কথায় চুমো দিলাম আমি। 

মাগো, আমি আর কখনো এমন করব না বিশ্বাস করো।
মা হেসে বললো, 
মৃত্যু কিন্ত সমাধান নয়।
তোমার জন্য যে, সময়েই আসবে। 

তাহলে কি সত্যিই আমি আত্মহত্যা করেছিলাম?
নাহ, তা তো নয়…
একই বিছানায় একইভাবে আছি শুয়ে!

তবে কি ঈশ্বর এসেছিলেন স্বপ্নে?
ও মা আমি সত্যি বলছি আর এমন করবো না

মৃত্যু কিন্তু সমাধান নয়…
মস্ত জীবন করতে পারি জয়

মন্ত্রটা শিখিয়ে আসি আমার বন্ধুদের!
আমি আসছি মা…আ…আ
—--------––--
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

বিষাদ-বিলাস

আমার বড় ক্লান্তি মনে, বিষাদ সবসময়
অন্ধকারকে দুচোখ বুজে আরো অন্ধ করে দিই।

একদিন ভাবলাম, বেরিয়ে দেখি আমার দুঃখ
আর কোথায়…

আমি গাছের কাছে গেলাম। 
বললাম, তুমি আমায় ফল দেবে একখানা
গাছ শাখা নাড়িয়ে রাগ মুখে বলল,
কেন দেব? দেবই বা কোথায়?
তোমার তো ভরপুর দুঃখ
ওই নিয়েই থাকো আজীবন!

আমি কাঁদলাম। বললাম, তবে আমার শ্বাসবায়ু!
তার কী হবে? মরে যাবে তো!
গাছ আর উত্তর দিল না।

আমি ছুটতে ছুটতে গিয়ে পড়লাম নদীতে
আমায় একটু ভিজিয়ে দেবে গো?
স্নান দেবে? স্রোত?
নদী সেতার বাজানো বন্ধ রাখল দু এক মুহূর্ত
তারপর বলল, তোমার চোখে তো দুঃখের সমুদ্র গো
আমার এ ছোট্ট শরীর তোমায় কী বা স্নান
দিতে পারে? 
না না তুমি বরং ওই দুখ-সাগরেই মরো!

আমি বুক ফাটা আর্তনাদ নিয়ে গেলাম
পাহাড়ের কাছে, তোমার বুকের ভিতর তো
টসটসে জল…আমি বড় তৃষিত
একটু পান করতে দেবে?
গমগম করে উঠল পাহাড়ের কণ্ঠ,
খবরদার! কোনো দুঃখের ঠাঁই নাই এখানে!
আমরা সবাই আনন্দ বুনি সারাদিন

আমি চুপ করে আমার একলা উঠোনের
হাতল ভাঙা চেয়ারটায় বসলাম।
একটা কাক উড়ছিল
মুখে তার কী যেন আগলানো
কিন্তু এই যাহ! পড়ে গেল টুকরোখানা

কাকটা এসে আমার পাশে বসল।
বলল, তুমি এত কাঁদছ কেন?

আমি বললাম তোমার খাবার যে পড়ে গেল!
কাক বলল, আবার খুঁজব! আবার পাবো,
পাবোই!

আমি বিস্মিত হলাম।
কাক বলল, শোনো তুমি বড় দুঃখ বিলাসী
তাই সবকিছুতেই দুঃখ খোঁজো।
যেখানে আমার খাবার পড়ল
ওখানেও কিছু প্রাণী আছে
আমি না খেলেই বা কী
কেউ তো খাবে!
আমি কিন্তু হাসছি দেখো মানুষ!
হো হো হো করে সে কী অট্টহাসি কাকের!

কাকটা উড়ে গেল। 
আমি ওর মত করে হাসতে শুরু করলাম
হো হো হো

আমার চোখে হাসির সাগর
আমার শরীর জুড়ে খুশি
গা থেকে কখন খুলে পড়ে গেছে বিষাদ।

একে একে ডাক পাঠালো গাছ, নদী, পাহাড়…

আমি আর দুঃখ ভাবার সময়ই পাই না!
—--------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

কু ঝিক ঝিক ঝিক

কু ঝিক ঝিক ঝিক 
চলছে দেখো খেলনাগাড়ি
এঁকে বেঁকে রাস্তা দিয়ে
মেঘ কুয়াশার ছন্দ বাড়ি

ফুল ফুল গাছ হাসে,গায়
হই অবাক খুশি আমি
স্ফটিক নদী সুর বাঁধছে
ভালোবাসার নাম'ই..

মেঘের জামা পরে মেয়ে
এল আমার কাছে

লেপচা তুমি? পড়াশোনা?

না, আমার পান্তা আছে।

এই শোনো! ও মেয়ে শুনে যাও!
বন্ধু হবে আমার?

দেরি করাস না বাবু…
আমি ওদের অধিকার।

ছুটলাম তার পিছু পিছু
বাড়িয়ে দিলাম হাত,
সে বললে, উৎরাই সামলে!
নইলে কুপোকাত।

ফের বিকেলে এল মেয়ে
মুচকি হাসি মুখে
বললো, জানো এ নদীতে
ব্যথাগুলোও থাকে সুখে।

বলেই আবার ফিরে গেল 
ঝমঝমিয়ে এল বর্ষা!

কেউ আমায় ভালোবাসে না
মা বাবাই শুধু ভরসা😥😥😥

মা ডাকলেন খোকা! নেমে আয়
বাবা বললেন সাবধানে
ঝর্ণা তখন গান ধরেছে
ভালোবাসা এইখানে

ভোরের বেলা সূর্য দেখতে
যেই গিয়েছি আমি
ছুট্টে এল সেই মেয়েটা
চলো বন্ধুতেই থামি। 

কাল সকালে ফিরবে তুমি
আমি পাহাড়ি গাছ
যা রে বন্ধু মনের মত
মানুষ হয়ে বাঁচ!

এই যে দেখ আমার গলায়
ছোট্ট মালা আছে
তোমায় দিলাম রাখো
যদি ভুলে যাও পাছে!

কিন্তু তোমায় খুঁজে পাব 
কী করে? যাও গো বলে!
ও বন্ধু আমিও বড় একলা
যেও না আমায় ছেড়ে!

ঠিক বসন্তে এইখানে
এই ঝর্ণা তলায়
পাহাড় থেকে মেঘ নামবে
আমার মাথা গলায়…

আমার চোখে পাহাড়িয়া গান
এ পাহাড় ভালোবাসে আমায়।

ভাবছো পাহাড় বুঝি খটখটে?
নিজে কেঁদে তবেই আমায় দেয় স্নান।
—---------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

পোষ্য পাহাড়

কী রে বাঁশি এনেছিস? বাজা তো দেখি
আমার হৃদয়খানে…
দার্জিলিঙে সুর তো আছেই! 
ওই শোন চা বাগানের গন্ধ টানে

গান গাইছে নদী? তা কাছেই।
চল তোকে সব দেখাবো ঘুরে
নুড়ি স্মৃতি সাঁতার সব রয়েছে
সারা নদীর বুক জুড়ে।

ওই দেখ কাঞ্চনজঙ্ঘা! দেখেছিস?
ওই দেখ বরফের গাছ, সাদা
রাত বাড়লে ঠান্ডা চাঁদ
মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকিস দাদা!

আরে আরে টাইগার হিলে চল
লাল সূর্য, কবিতা কবিতা পারা

এ সূর্য কথা বলে জানিস?
কিন্তু শুনতে জানে যারা…

এই শোন না, ফুল কুড়াবি?
তাহলে তোকে নিয়ে যাবো বনে
ঝর্ণা দেখবি বাজনা বাজায় কেমন
স্বচ্ছ নদী গাইবে সুরে মনে।


আঁকা বাঁকা পথ পেড়োচ্ছিস দাদা
জীবন যেন হয়না বাঁকা তোর
এখন চল অন্যত্র অন্য খানে 
ওই দেখ কত পাখি, মধ্যিখানে ভোর।

কাঁদিস না! ফিরতে তো হবেই তোকে
ওই দেখ তোদের গাড়ি…
কী বললি আমার বাড়ি? আমার
মাটি মা, আর আমি; আমার বাড়ি

আমায় শহরে যেতে বলছিস? হো হো
ওরে আমিই তো মস্ত এ পাহাড়
উপরটা খটখটে ঠিক, ভিতরে অমৃত
পাহাড় তুলে পোষ্য করবে এমন সাধ্য কার?
-–--------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

মৃত্যুকে যে চায় বাহু পাশে

মৃত্যুকে যে চায় বাহু পাশে
ঘৃণা যার প্রতি বিন্দু শ্বাসে

নিয়তিকে নিয়ত ডাকে…
মৃত্যু ভয় পায় তাকে

জীবন ভালোবেসে
যে প্রাণ সালোকসংশ্লেষে…

ক্ষয়ে যায়, ক্ষয়ে যায় জয়
মৃত্যু তার আপনার হয়
—--------–-
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

সখা হে! বঁধু হে!

শরীর রেখেছি সাজিয়ে।
তোমার কোনো অ-সুখ নেই 
ভাঙন নেই
ব্যথা নেই, অনাদর…

পরম প্রিয় সত্য হে!
ঈশ্বর হে আমার…
হৃদয় রেখেছি সাজিয়ে
তিমির রাত্রি বেঁধেছি খোঁপায়
রজনীগন্ধা দাও ঢেলে

চুম্বন করো আমায়!
নীল বড় প্রিয় আমার
গালে, ঠোঁটে রেখে দাও 
আকাশ
চোখের পাতায় রাখো মেঘ
স্তব্ধ করো বুকের কাঁপন,
ভয়…

মাটি রাখো আমার কান্নায়
বায়ুতে ভাসিয়ে দাও 
আমার জন্ম জন্ম আয়ু…

মৃত্যু! 
সখা হে!
বঁধুয়া…!
—----------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

তাদের মৃত্যুর নাম দীর্ঘশ্বাস

নদীকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন ক্লান্ত তুমি?

সে বলল হয়েছি বৃদ্ধ। 

সন্ধেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার রোদ্দুর

কোথায় গেল?

সে বলল, বৃদ্ধ হয়েছি। 

ভেঙে পড়ল অশোকের ডাল

জিজ্ঞেস করলাম, তুমিও বৃদ্ধ হয়েছ?

হো হো করে হেসে উঠল ঝড়

বলল, বৃদ্ধ হওয়ার আগে যারা ভেঙে যায়

তাদের মৃত্যুর নাম দীর্ঘশ্বাস।

—--------------------

SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

মায়ে ঝি'য়ে

সেই মেয়েটার গরিব চাঁদ

পথের ধুলায় কাঁদে

মনের মধ্যে ছোট্ট আশা

মা তবু তার বাঁধে…


ওই যে দেখো প্রজাপতি

মাছরাঙা ওই গাছে

ওদের সঙ্গে ধার নিয়ে নাও

রঙ যে ওদের কাছে!


শিমুল পলাশ কৃষ্ণচূড়া

রাত জোনাকির আলো!

দিনেও কত রোদ্দুর যে!

আদর ওতে ঢালো।


পদ্মপাতায় গান করছে

শিশির পুকুর ঘাটে

মায়ে ঝি'য়ে ওদের নিয়ে

বসব রঙের মাঠে।


উঠল খুকু খিলখিলিয়ে

চাঁদও মেশে তাতে

গরিব তো নয় সে এখন আর

রঙের রাজা রাতে!


পথের উপর রথ চড়ছে

দুটি খিদে মুখ,

মায়ের চোখে শ্রাবণ ধারা

মেয়ের স্বপন সুখ…


চাঁদের গায়ে মাছরাঙা রঙ

রোদ জোনাকি মিশে

মায়ে ঝিয়ে রঙ রাখছে

শুকনো দূর্বা শিষে।

____________

SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

রবীন্দ্রনাথ বাবু

নিজে খাইনে অন্যকে সেজে দি! অথচ তোমার হাতে স্পষ্ট প্রমাণ…

দাঁড়াও দাঁড়াও তবে কি তুমি সব্যসাচী? 'পথের দাবী'র সে আগুন? সে ক্ষুরধার দৃষ্টি?

না না তা কী করে হবে? ভিজে বিড়ালের মত চোখ, এক গাল দাড়ি গোঁফ…এই মানুষ! বলো তো কেন এসেছ থানায়?

কী চুরি করেছ? নাম কী তোমার?

অপূর্ব কোথায় গেল এইসময়? লোকটার রিপোর্টটা লিখে নিচ্ছে না কেন?

এই…এই তুমি কোনো কারণে নিজের বউ কে হত্যা করে মাথা নিয়ে আসোনি তো?

দেখি, দেখি থলে টা! কী আছে ওতে? বর্ণপরিচয়? হা হা হা… লেখাপড়া শুরু করেছ বুঝি এই বয়সে? ভালো ভালো!

তা থানায় কেন এসেছ? নাম কী? কিছু কি চুরি করেছ?

শোনো আমি কিন্তু ঘুষখোর পুলিশ নই। আমায় কোনো সবজি বা তেল খাইয়ে নিজের নাম মুছতে পারবে না।

এ বগলের থলেটায় কী এনেছিস রে হতভাগা? জোলো মাছ না নারকেল?

কী বললি…কী বললি? তোর নাম রবীন্দ্রনাথ? হা হা হা তা বটে। তাঁর মতনই দাড়ি বটে, দেখি দেখি হ্যাঁ কপাল খানাও এক।

কিন্তু থানায় কী চাস বল না বাপু!


কী বললি? কী বললি তুই? আমি গেছি হারিয়ে!

এই মানুষ কী বললে তুমি? আমি গেছি হারিয়ে!


টেবিলের উপর রেখে যাচ্ছ বর্ণপরিচয়! সহজ পাঠ!


কিন্তু আমি কেন হারালাম? কোথায় হারালাম? কবে হারালাম? পথ বেঁকে গেছে যেদিন? আলো নিভে গেছে যেদিন?

মুক্তি বন্দি হয়েছে যেদিন? 


অপূর্ব…! অপূর্ব…শিগগির এস! আমার জন্য মিসিং ডায়রি করতে হবে! আমাকে খুঁজতে হবে! 


কিন্ত সহজ পাঠে আমি ফিরবে কী করে বলে যান রবীন্দ্রনাথ বাবু! 


রবীন্দ্রনাথ বাবু! কোথায় চলে গেলেন…


বলে যান…কোথায় গেলে আমাকে ফিরে পাবো?

—--------–-–––-------–––

SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

হে পুরুষ!

 হে পুরুষ! আলো নিভিয়ে দাও।

সঙ্গম রাখো ঘাসে।

হৃদয়ে উপুড় করো ভালোবাসা

চোখে সম্ভ্রম 


হে পুরুষ! শিশিরেও রঙ দাও

বৃষ্টিতে স্নান

বজ্র হয়ে শাসন বাঁধো বুকে

ভীতি অতিক্রম


হে পুরুষ! নাও ছেড়ে দাও

লাঙল রাখো কাঁধে

ঘামে ঘামে লেখো সহন

মুক্তি সংসারে


হে পুরুষ! মাটিতে বোনো সুখ

শাখায় শাখায় আলো

প্রখর গ্রীষ্মে শান্ত নদী

রাত-প্রহরী দ্বারে।


এ পুরুষ! ওই যে ক্ষেতে

তোর লালসা ঝরে!

দিস পুড়িয়ে নরম শরীর

যৌনতার পরে…


পুরুষ! স্ত্রী কে মারিস?

এ অধিকার তোর?

পুরুষ! চটকে খাস

টকটকে লাল ভোর?


পুরুষ! কোকিল তাড়াস?

বসন্ত? গান?

পুরুষ! তোর কারণে হাহাকার?

স্বপ্ন খান খান?


নাহ রে পুরুষ! ওই যে দেখ

তপস্বী প্রেমের

ভালোবাসছে, কাঁদছে কাঁদছে

চাইছে নারী…


হে পুরুষ! এস! সঙ্গমের পরে

আমার গর্ভে এস

আমি তোমার ঘাস যেমন

মাও হতে পারি।

—--------–----–

SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

বাবুই, চড়াই

বাবুই পাখির আকাশ ছিল, ডানা ছিল, গানের মত ঘর ছিল। 

চড়াই বড় একলা! বিষাদের উপর শুয়ে ছিল।


একদিন চড়াই বাবুইয়ের ডানায় তার দুঃখ ঢেলে দিয়ে বলল, আমার পৃথিবী নেই, গান নেই, ঘর নেই।


বাবুইয়ের নরম মন গলে গেল। বাবুই চড়াইকে তার সুর দিল, স্বর দিল, ঘর দিল…


চড়াই গান পেয়ে বাবুইয়ের পাখায় পা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সুর পুঁতল মাটিতে…

শ্রেষ্ঠ সুরকার হল চড়াই। আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত চড়াই! 


বাবুই বলল, শোনো চড়াই আমি একটা গান লিখেছি। শুনবে?


চড়াই বলল, গান লিখেছ? ভাসিয়ে রাখো বাতাসে। আমি সময়ে শুনে নেব। 


বাবুই গান হারালো, মান হারালো, বন হারালো। 

ডানা কেটে রক্ত পড়লো তার। চড়াই শুধুই তার ঘর চায়, দানা চায়।

চড়াই কে ডাকে এস গল্প করি। 

চড়াই তখন রোদ্দুরে সোনা খুঁজতে ব্যস্ত।


বাবুই রক্তাক্ত ডানায় চড়াইয়ের পা ধরল একদিন।

বলল, একদিন তুমি ঠিক চিলেকোঠা খুঁজে পাবে দেখো! অনেক সোনা, অনেক দানা…


চড়াই তার ভুল বুঝতে পারলো। বাবুই কে ফিরিয়ে দিল তার মন। 


বাবুই কিছুদিন ক্ষত নিয়ে বসে রইল চড়াইয়ের ডাকের অপেক্ষায়, তারপর উড়ে গেল। 


চড়াইয়ের এতদিনে বোধ হল, 

বনে আর ধনে গাঁটছড়া বাঁধা যায় না।

—-----------------

SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA

প্রবল অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলাম সেদিন (দিদি নাম্বার ওয়ান)

প্রবল অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলাম সেদিন।

দুহাত তুলে চিৎকার করছিলাম বাঁচাও বাঁচাও

তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ছিলাম

তারপর মৃত্যু বুনছিলাম


হঠাৎ দেখি আমার পাশ দিয়ে ডুবে যেতে যেতে

উঠে দাঁড়াল একজন

আরো একজন তার কোমর অবধি অন্ধকারে

আরো একজন তার গলায় এসে দলা পাকিয়েছে

ভয়ংকর

আমি ওদের ডেকে বললাম, এই যে শুনছো!

আমার বড় যন্ত্রণা গো!

একটু তুলে দেবে?

ওরা হো হো করে হেসে উঠল। বলল, তবে আমাদের

গায়ে লেগে এসব কী?

ওরা হাসছে? এত'র পরেও?

তবে আমি কেন পারি না?


ওই তো দূর থেকে আলোর ঝলক আসছে চোখে

বাতাসে ভেসে আসছে গান

কত ফুল! কত আনন্দ!


নাহ! ওই আলোকে ছুঁতে হলে আমায় যে

অন্ধকার থেকে উঠতে হবে


আলোর দেবী সামনে এসে দাঁড়ালেন,

বললেন, 

এই তো আমি আছি!

আমার মঞ্চে অন্ধকার কেই সিঁড়ি বানিয়ে নেওয়ার

রোদ্দুর নামিয়ে আনি যে! 

তুমিও শিখে নিও, কেমন?

        —-

SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

বসন্ত

প্রথম যেদিন দেখি, 

তার জামাকাপড়ের রঙও ফিকে

ময়লা তুলতে দীর্ঘদিন ধোয়ার ফলেই হয়ত

এমন।


চোখে চোখ রেখে খুব খুঁজলাম

কিন্তু কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙ নেই তাতে।

রাস্তার এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে পৌঁছে সে আমায়

বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। 

আসলে চোখে দেখতে পাই না তো!


চোখে দেখতে পায় না সে, 

কিন্তু রংহীন কেন হবে?

খটকা লাগল।


পৌঁছে গেলাম হৃদয়ে আড়াআড়ি ভাবে।


যাত্রাপথ অবশ্য সহজ ছিল না।

দীর্ঘকাল ধরে মাটি প্রস্তুত করে, জল দিয়ে

আলো দিয়ে তবে না গাছের সালোকসংশ্লেষ!


হৃদয়ে পৌঁছে দেখলাম শ্বাসকষ্টের কারণ

তার ফেলে আসা চালচিত্র


বললাম, পেয়েছ সংবাদ?

সে বলল, কীসের?

বললাম, এখন যে বসন্ত চলছে!


তার কালো চোখ ফুলেও এক ছোট্ট প্রজাপতি

এসে বসল হঠাৎ


আমার হাত চেপে ধরল

আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালাম তাকে।

পোশাকে শালের লাল, গোধূলির হলুদ,

পুকুরের কলমি…


সাহসের সামনে দাঁড় করাতেই

সে বলল এই তো আলোর রঙ!

কী যেন…

কী যেন…

আমি বললাম রোদ্দুর!

মুখে হাসির এক পশলা ঢেউ খেলে গেল তার


কিন্তু পরক্ষণেই…

চোয়াল শক্ত!

বলল, মানুষটা বড় মারত!

একদিন বৃষ্টিতে আগুন ধরিয়ে

পুড়িয়ে দিল দু চোখ


কোমরের চারপাশে তার হাত গোল করে

ঘিরে রেখেছে আমায়

আমি তার গালে হাত দিতেই বিষাদ সরিয়ে হেসে ফেললে, এ তো শিমুল!

আর ঠোঁট?

জানি না! 

আমি স্পষ্ট ওর লজ্জার রঙে

বাতাবি ফুল দেখলাম।

নাকের ডগায় আমের মুকুল।


থোকায় থোকায় পলাশ এখন তার হৃদয় জুড়ে

যে রোদ্দুরকে মনে মনে চেয়েছিল এতদিন…

চোখ ভালো হতেই পেয়ে গেল তাকে।

রোদ্দুরের রঙ যে আলো!


আমার হাত ধরে রাস্তা পার করতে করতে 

সে চেনা খুশি আমার কানের কাছে কলকল

করে উঠল, খুব চেনা তোমার এ স্পর্শ

কিন্তু কে তুমি?


আমি বললাম, সুখে আছো?

খুব খুব খুব! 

উত্তেজনার রঙ হার মানিয়ে দেয়

ভোরের সূর্যকেও…


বললাম, অনেক অনেক ধন্যবাদ। আসলে চোখে

দেখতে পাই না তো…


সে বললে, আহা রে! 


এগিয়ে গেলাম আমি।


তারপর সে ছুটে এল পিছু পিছু। 


শুনছ! এত চেনা তুমি! 

তোমার নাম টা বলে যাও!


হেসে বললাম, বসন্ত। 

—----------

SUJATA MISHRA


লক্ষ্মীছাড়া

 বাতাবি ফুল, আমের মুকুল

শাল পলাশের রঙের হাট 

রাঙা ধুলোয় লুটিয়ে ছেলে

যুদ্ধে যাবে তেপান্তরের মাঠ…


কুমড়ো মাচায় ফুল ফোটে নি

লাউয়ের ডগা মোচড়ানো

লুটানো ছেলের বাপটা শহীদ

বসন্ত, তুমি তা কি জানো?


এক পলাশী দুয়ার ধরে

এক ভর পোয়াতি সন্ধে

বসন্ত, তুই রাধার রঙে

আর একটু মন দে…


বৃষ্টি পড়ে বাতাস ওড়ে

আদুল প্রেমে পড়লে ঝুপ

নিজেকে পোড়ায় গন্ধ লুকায়

বসন্ত, ওর নাম কূপ?


গঙ্গা নামছে প্রবল বেগে

শিবের জটায় বন্দি তা

শাল পলাশেও ফুল ফুটেছে

কচি ঘাসে মাড়িয়ে যা…


গল্পগুলোর আলগা সুতো

বাঁধছি না তাই শক্ত করে

বসন্ত তুই কি চিনিস তাকে

প্রেমের জন্য যে মরে?


ওই দেখো ফুটছে গোলাপ

সূর্য উঠছে মিষ্টি ভোরে

এ বসন্তেই কাক ঠকবে

কোকিল নেবে তার ঘরে।


বাতাবি ফুলের সুবাস যত

মেঘের আনাগোনায়

বসন্ত, তুমি কান্না শুনছ?

লক্ষ্মীছাড়া শোনায়…


গত দোলে রঙ চুবিয়ে

ঢেলেছিল ওর প্রেমিক

মুছে দিয়েছে পরক্ষণেই

ইরেজার ছিল ঠিক…


সেই মেয়েটা লক্ষ্মী ছাড়া

আমিও বৃদ্ধ জীর্ণ মালি

তবুও কিন্তু তোমার গায়ে

ফাগুন চৈত আগুন ঢালি।


লক্ষ্মী ছাড়ার নাম রেখেছি

ঝর্ণা পর্ণা আমার বাগে

ও আমায় বসন্ত বলে 

হাসিতে রাশিতে জোয়ার ফাগে।

—--------------

SUJATA MISHRA

মেয়ের মতন মেয়েই না হয় হোক

ঠাম্মা বলল, কুলের বাতি চাই,

       মা বলল, মেয়েই আমার খোকা!

বাবা বলল, শর্ট হেয়ার, শার্ট প্যান্ট,

       ছেলের মতই বুদ্ধি মেয়ের চোখা।


পিসি বলে, দাপিয়ে চলতে নেই,

       মেয়েদের যে আগল অন্তঃপুর!

আমি তখন আমার বুকের ঘরে

       সোনার রঙে আঁকছি রোদ্দুর।


মাসি বলল, রাঁধতে পারিস তুই?

    সেলাই, ফোঁড়াই এসব শেখাও চাই!

আমার মনে তখন খুশির আলো,

     আনন্দেতে দু-হাত তুলে গাই।


মা বলল, দেখিয়ে দে তো সোনা!

     মেয়ে হলেও তুই'ই আমার ছেলে!

আমি তখন লম্বা বেণী বেঁধে

      প্রশ্ন লিখি স্বপ্ন গুলো ফেলে…


মেয়ে হলে হতে হবে ছেলে?

       ছেলে হলে মেয়ে কেন নয়?

মেয়ে হলে নিভল কুলের বাতি?

       ছেলে হলেই সর্বত্র জয়?


আমি হব আমার মত মাগো!

      ফুল পাখি বা আগুন, ফাগুন চোখ…।

তোমার খুকু, মেয়েই বরং থাক।

     মেয়ের মতন মেয়েই না হয় হোক!


ভূমির মতন সৃষ্টিশীলা হোক!

     মাটির মতন মেয়েই না হয় হোক!

  —--------------

SUJATA MISHRA

উৎসর্গ পত্র

মামন দি'ই ই ই!...

মামন দি!

দাঁড়াও আরও একবার ডেকে নিই

মামন দি'ই ই ই!...


আমার পাঁজরের নীচে হৃদয়

উপরে বর্ম


হৃদয়ে তুমি

বর্মে কর্তব্য


চোখের নিচে কান্না

উপরে আগুন


প্রশ্বাসের পাশে

স্মৃতিরা আসে…


মামন দি'ই…!


জঙ্গলের ভিতরেও কেমন পলাশ ফুটেছে

শালের পা অবধি ডুবে বিকেলের রঙ

ফুলের রেনু 

ফাল্গুনী হাওয়া…


এমনই এক বসন্তে হলুদ খামে ভরা 

প্রজাপতি-চিঠি এসেছিল ডাকে।

কোণের দিকে সিঁদুর লাগানো


মামন দি

তুমি আমার থেকে ঠিক দুই বছর তিন মাসের বড়।


চিঠির ভাঁজ থেকে তখন ঝমঝমিয়ে বর্ষা নেমেছে


আমি কাঁচা আল মাড়িয়ে 

কনকচাঁপা ফুল কুড়িয়ে

তোমার কোঁচড়ে দিলাম।

তুমি চোখ নামালে।


ছুটতে ছুটতে গিয়ে বললাম, 

মামনদিকে বিয়ে করতে চাই!


তোমার বাবার চোখে আগ্নেয়গিরি

স্পর্ধা? শুষ্ক মরু হয়ে বসন্ত পেতে চাস?


মামন দি

ভারতবর্ষে মধ্য শিক্ষিত হওয়া মহাপাপ

ভারতবর্ষে শুষ্ক ভাগ্য নিয়ে জন্মানো অপরাধ!


তোমার সিঁথি চিরে বসন্ত নেমে আসার কিছু পরে

আমার গায়ে উঠল শক্ত পোশাক

হাতে রাইফেল

মাথায় স্বদেশপ্রেম

উৎসর্গপত্রে জীবন…


গতকাল আমার একলা দুপুরে 

ঘন মেঘ থেকে কান্না ঝরে পড়ল

আমি মুখ তুলে তাকাতেই প্রবল বিস্ময়!

তোমার শুভ্র মুখ, সিক্ত বুক!

উত্তাল ঢেউ!

নিস্তব্ধ বৃষ্টির আয়োজন


ভেজা পাহাড়ে স্নাত পায়রা সংবাদ রেখে গেল

তোমার আলোরা বড় ভঙ্গুর হয়ে এসেছে!

বিকল স্নায়ু 

তুমি গানের গায়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন রেখেছ মামন দি!



আজ আমার বুকে বিদ্ধ হচ্ছে জয়!

শত্রু শিবিরের পাশ থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছি 

শরীরটাকে…

হাতের মুঠিতে ধরে রেখেছি ঘাস


মুঠো খুললেই গড়িয়ে পড়বে

ছড়িয়ে পড়বে

প্রতি ঘাসের সবুজে আমি তোমায় লিখে রেখেছি

মামন দি!

লিখেছি…

আমার স্নায়ুতে মরু নয়! বসন্ত ফোটে।

রাত্রি নয়! সূর্য ওঠে…


মামন দি'ই ই ই…

তুমি বাঁচবে!


তোমার আত্মঘাতী গানের পাশে আমার হলুদ রোদ

তোমাকে জড়িয়ে ধরবে

তোমার পায়ে বেঁধে দেবে পায়েল।

আমার স্নায়ু, আমার আয়ু…

হৃদয়ে আলো…


মামন দি!

ও মামন দি!


আমার উৎসর্গপত্র টা যত্নে রেখো। 


দুই বছর তিন মাস বাদ দিলে 

সব স্পর্ধা কিন্তু

মরু নয়, কী বলো মামন দি!

—--------–----

SUJATA MISHRA