কেন আমি…?

বাইরে প্রবল বজ্রপাত!

আমার ঘরের আয়নাটা মাঝামাঝি চিরে গেল।


প্রতিদিন নির্জনে যে আয়নায় আমি 

খুলে দিতাম আমার হাসি

ধীরে ধীরে মায়া জড়িয়ে যে আয়না 

আল্পনা আঁকত আমার শরীরে, আমার যৌবনে!

যে আয়নায় সমর্পণ করতাম 

আমার আদর

সে হঠাৎ ভেঙে গেল।


সশব্দে ঝনঝন করে উঠল নিষেধ…

ওতে মুখ দেখো না! 

ভাঙা আয়নায় মুখ দেখতে নেই।


আমি কাঁদলাম। 

জিজ্ঞেস করলাম, 

কেন আমার?

কেন আমিই…?


তারপর রাত্রি এল।

ভয়ঙ্কর দুঃসহ!

আমার শরীর দুমড়ে মুচড়ে গেল একাকীত্বের ব্যথায়

গভীর জঙ্গলের মত রাত্রি ঘন মেঘে ঢাকা

কোথাও এতটুকু আলো নেই!

আনন্দ নেই! 

আমার ঘরে আমি ভিন্ন

একটাও জীবিত নেই…


দৃষ্টি জ্বেলে কোনোরকমে 

ভাঙা আয়নাটার সামনে দাঁড়ালাম।


বিস্মিত হলাম!

দুইদিকে দুই আমি!

আমার পাশে আমি।

মধ্যে তিরতিরে নদী


নীল রঙকে দিলাম কপালে ঢেলে

দুই ভ্রুর মধ্যে লালের গোল একখানা


আমার পাশে আমি

আমার পাশে আমি


আয়নায় আমার প্রসূতি কপাল

গর্ভনাড়ি ছিঁড়ে জন্ম দিল

সূর্য।


চারিদিকে এত আবর্জনা!

ভাঙা টেবিল, চেয়ার, অন্ধকার…


আমার পাশে আমি!

আমার পাশে আমি!


আমার শরীর জুড়ে পাখি ফুল আলো

যৌবন, সুগন্ধি…


আমি হাসলাম।

আমি কাঁদলাম।

এ সুখ কেন শুধুই আমার?


আমি নারী


আমার পাশে আমি

আমার পাশে আমি…


কেন আমিই কেবল পারি?

—-------------------------

SUJATA MISHRA

ওরা সংখ্যা!

পুড়ছে সংখ্যা

মরছে সংখ্যা

লড়ছে সংখ্যা

বাতানুকূল ঘরে নামগুলো দুশ্চিন্তায় ঘামছে

যান্ত্রিক সংবাদের চোখে চোখ রাখছে

জুতা ঠুকে উঠে দাঁড়াচ্ছে

আওয়াজ তীক্ষ্ণ…

যুদ্ধ চাই!

যুদ্ধ চাই!

আরো আরো ভয়ংকর বীভৎস প্রবল

যুদ্ধ চাই!


সংখ্যারা পুড়ছে

সংখ্যারা মরছে

সংখ্যারা লড়ছে


যুদ্ধ চলছে।


ওদের কোনো নাম নেই

মুষ্ঠি বজ্র 

চিবুক কঠিন

আগুন চোখ


অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে গাইছে দেশাত্মবোধ

ধুলো উড়িয়ে, আয়ু ফুরিয়ে 

ওরা আদমশুমারি।


সংখ্যাদের ঘর আছে

ভালোবাসার আঁচে

ফুলের মত শিশু 

টাটকা সবজি, ফল…

আলো

ঘরের ভিতর কান্না আছে

প্রশ্ন আছে,

যুদ্ধ কেন হয় বাবা?

সংখ্যারা উত্তর জানে না

সংখ্যারা নিষেধ মানে না

…যেও না শোনো! খাবার ফেলে

যেতে নেই যে…


ন্যাটো, পুতিন ভাষা হলেও

সংখ্যারা নিশ্চুপ।


ওরা সংখ্যা।

দুশো... চারশো... লক্ষ...কোটি...

সংবাদপত্রের পাতায় পুড়তে পুড়তে যুদ্ধ হতে জানে

শুকিয়ে আসা শিশুর অপেক্ষার উত্তর জানে না।

—----------------

SUJATA MISHRA

আনিস একটা অপ-মৃত্যু

একটা মৃত্যু। ভয়ংকর এবং শান্ত।

দুটো চোখ আধ খোলা

দাঁত বেরিয়ে একটা… দুটো… ঠিক ছ'টা

বুকের মাঝখান দিয়ে রক্তস্রাব 

থমকেছে খানিক আগেই


কয়েকটা পিঁপড়ের মুখে ডিম

বৃষ্টি আসবে বোধহয়

আহারের চেয়ে বাৎসল্য বেশি ওদের এই সময়


একটা মৃত্যু। চোখ আধ বোজা, ঠোঁট থেঁতলানো

যেও না ওদিকে! ওটা রাজনীতি

পড়শীর স্ত্রীর সতর্কবার্তা স্বামীর উঁকি দেওয়া চোখে


একটা মৃত্যু। 

বুকের উপর, মুখের উপর

তাক করা ক্যামেরা…

মোবাইল পাওয়া যায় নি! অথবা 

পাওয়া গেছে ঝোপঝাড়ে

বিতর্ক চলছে চলবে!

রহস্য ম ম করছে

ঘিনঘিনে মাছি মৃত্যুর কাঁধ কামড়ে ধরেছে

মৃত্যু নির্লিপ্ত। জিভ উলটানো।


পৃথিবীর দাওয়ায় বসে উদাস দৃষ্টি এক।

পরণে শত ছিন্ন শাড়ি। 

আর ফাঁকে ফাঁকে ঘা

দগদগে ঘা

কোনোটা ছুরির আঘাতে, কোনোটা ফাঁসির দড়ির,

পেট্রোলে পোড়া, জর্জরিত বিষ কোনোটা…

উন্মুক্ত যন্ত্রণা

কুচিকুচি রোদ্দুর দাওয়ার এ ধারে ও ধারে

সে দৃষ্টির দেখার অবসর নেই।

নেই আদর করে কুড়িয়ে নেওয়ার হাত…


আঁচলে আরও এক ছিদ্র বাড়ল।

সে ছিদ্রের মধ্যে আরও এক ঘা

ছাদ থেকে পড়েছে একটু আগেই

ক্যামেরা বোঝাই হচ্ছে ঠাসাঠাসি করে

ঠোঁটে ঠোঁটে গলগলে স্রোত


কমছে রোদ্দুরের কুচি।

দুখিনি আঁচলের দেহে ঘা বেড়েই চলেছে…

সব আনিসের নামই সেখানে এক…

অপ-মৃত্যু।

—-------–----–---

SUJATA MISHRA

নারী

“যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।"

তোমাকে পুজিলে প্রসন্ন ঈশ্বর


তুমি প্রখর গ্রীষ্মে অসীম ছায়ার ঘর।



পূজারিণী তুমি! 

সংসার অর্ঘ্য সাজিয়ে রেখেছ নিজের চারিপাশে

শান্তির তিলক চন্দন পরিয়েছ আল্পনা আঁকা

লক্ষী দ্বারে।


সন্তানের মুখে এঁকে চলেছ নরম আদর, 

বুকে স্পর্ধা


তোমার পায়ে সময়ের বেড়ি, নারী!

তুমি বলো, এ শিকল নয় তো! যাপন।

তোমার মাথায় আঘাত নামলে 

তুমি বাগানে ছুটে যাও…

বৃষ্টি ডাকো! গান বাঁধো! হালকা হও।


তোমায় যারা শোষণে ডাকে!

স্তব্ধ থাকো। 


কেন মা? কেন থাকো?


তর্জনী তোলো নারী! চক্ষু বাড়াও!

মাগো! আগুন ছোঁড়ো…

বলো, 

গৃহে নারী কোমল আঁচল, অন্তরে ধৈর্য্যের বর্ম

আমাকে দিয়েছ অবহেলা? ব্যর্থ তোমার সব কর্ম।


"যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।"

—---------------

SUJATA MISHRA

চিত্রাঙ্গদা

কোপাইয়ের জলে পা ডুবিয়ে বসেছিল সে।

আসার পথে চোখ আটকে গেল আমার 

চওড়া পিঠ, শ্যামলা গাল, চ্যাপ্টা নাক

জিজ্ঞেস করলুম, তুমি কি কৃষ্ণকলি?

সে ঘুরে তাকাল একবার। মুচকি হেসে বলল

খুঁজে নাও!


তারপরেই সে মেঘ নামিয়ে আনল তার পায়ের পাতায়

হাত বাড়িয়ে ফুল পাড়ল, গান বুনল।

আমি বললুম, খুব চিনেছি! গীতাঞ্জলি।


সে হাসল খানিক। কোথায় যেন পাথর গেল ভেঙে

মাটির উপর বাসা বুনল কেউ

কোন্ বনে কোন্ মল্লিকা এক বুক গন্ধ নিয়ে

ছুট দিল কোন্ সাহারায়…

বৃষ্টি এল ঝমঝমিয়ে।

বৃষ্টি এল দু চোখ ভরে

বৃষ্টি এল ঠোঁটের পরে


তারপর কত ডাকলাম! সে কিছুতেই সাড়া দিল না।

ঘাড় নেড়ে মুখ নিচু করে রইল।

বৃষ্টি ধোয়া টকটকে রঙ, চুলের ঢালে ঢেউ খেলছে

বসন্ত। 

প্রেমিক খুঁজতে ব্যস্ত মূক সে জন নদীর বুকে বুক মেলালো...


আমি তটস্থ হয়ে উঠি। বলি, অভিমান কোরো না

শুভা...এ বসন্তের বাতাস 

তোমার কণ্ঠে সুর বুনবে ঠিক একদিন দেখো!


মুখ ফেরালো সে। 

চোখে কী প্রচন্ড স্রোত!

জানু পর্যন্ত কোপাইয়ের ঢেউয়ে বয়ে যাচ্ছে তেজ

প্রতি শ্বাসে বুক ফুলে ছুঁয়ে যাচ্ছে নীল আকাশ

পরণে রণ সজ্জা

সোনাঝুরির পাতায় পাতায় বাজছে দুন্দুভি


কেঁপে উঠলুম সহসা

আমার নাকের ডগা লাল হল লজ্জায়

মুখ নামিয়ে বললুম, কী অভিপ্রায় চিত্রাঙ্গদা?


এবার সে খুশি হল খানিক মনে হল।

বলল, মদনকে ডাকব না। চাই না তার কোনো বর!

ছদ্মরূপ

কথা দাও! এ কঠিন করবে বরণ? 


সত্তর স্থান ত্যাগ করলুম। পালিয়েই এলুম বলা ভালো।

পিছে পিছে বড় জোর কৃষ্ণকলি,

এ অবধি কাব্যি চলে…


আগুনের পাশে পুরুষ হয়ে হেঁটে যাব

ইস...

ভাবতেই এবার ছোট হয়ে এল আমার পৌরুষ।


আড়ি অবিশ্যি পাতি মাঝে মাঝে কোপাইয়ের ধারে 

ধারে…

শুনতে পাই, সে জন… অনেক জন…

পূর্ণ হচ্ছে… বৃত্ত বুনছে…

আকাশ গাইছে…

আলো বাইছে


হো হো করে হেসে উঠে বলছে, 

সব অর্জুন কাপুরুষ!

সব অর্জুন কাপুরুষ!

সব অর্জুন...

––-----------

SUJATA MISHRA

আনন্দ

অন্ধকার চূর্ণ করে এগিয়ে চলেছে আমার দুই পা। চোখ চলে যাচ্ছে দূরে… 

বিস্তীর্ণ শান্ত নদী। শুয়ে আছে মাটি ধোয়া কাঠামো।

আমি বিস্মিত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই...কে তুমি? 


বাতাস কেটে কেটে উত্তর আসে, চিনে নাও!


ভীষণ চেনা স্বর! ভীষণ…


অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। মনে পড়ছে! আমার মনে পড়ছে!


এ স্বর ছিল আমার মায়ের। আঁচল, লাল টিপ, ঘাম, আটপৌরে শাড়ি… আমার শ্রান্ত কপাল মুছিয়ে বলছে, এক গ্লাস জল খা বাবা।


এ স্বর শুনেছি গোপালের মায়ের কণ্ঠে, আইনের পা ধরে বলছে, আমার গোপাল নির্দোষ স্যার!


এ স্বর শুনেছি নিষিদ্ধপল্লীর কুসুমের কণ্ঠে,

একবার আসুন না বাবু! আমার শরীরে আমার বাচ্চার ভাত রেখে যান...


এ স্বর শুনেছি স্বপ্নার বুকে, এ শুধুই মাংস তোমার কাছে? এর নীচে হৃদয় থাকে না? অভিমান?


এ স্বর শুনেছি উনিশশো সাতচল্লিশের চোদ্দই আগস্ট মধ্যরাতে…

আজ আমার শিকল ছেঁড়া গান, আমার আলোয় আলোর স্নান...


কাঠামোর শান্ত দৃষ্টি। ক্লেশ নেই, কায়া নেই। 


আমি তুলে আনলাম তাকে। বাকি অন্ধকার মিলে তার গায়ে মাটি মাখালাম। আলো দিলাম। বাতাস দিলাম। শাড়ি, ঘাম, আঁচল, উদ্বিগ্নতা, অভিমান, কুপি, অপেক্ষা সব দিলাম। 

থোকায় থোকায় ঝুলিয়ে দিলাম মানুষ তার হাতে।


অন্ধকার আরও ফিকে হতে লাগল। 


হঠাৎ কী এক শব্দে ভেঙে গেল আমার সবটুকু ঘুম!


উঠোনে নেমে এসে দেখলাম, সকাল হয়েছে। 


শব্দটা আমার অযত্নে লালিত এক গোলাপ গাছের। 

প্রথম ফুল ফুটেছে তার আজ। গায়ে এসে পড়েছে গোলাপি রোদ্দুর...


বাকি সব ক্লেদ খেয়ে গেল কাক। 

ফুলটির নাম রাখলাম আনন্দ। 

—------------

SUJATA MISHRA

ফিলিং দুঃখু

ভ্যালেন্টাইন বলে কথা!

পেঁচি ছিল সেজে

হাড়ের টক খুলির ঝাল

আঙুল নিল ভেজে


এদিকে আবার হয়েছে কী

গাছের কোটর ফাঁকে

বেম্ভদত্যির নেমন্তন্ন 

শাকচুন্নির ডাকে।


দেখল পেঁচি উঁকি দিয়ে

শাকচুন্নির হাসি

বেম্ভদত্যি বলছে তাকে

বড্ড ভালোবাসি!


পেঁচি কাঁদলো বিরহ কাঁটায়

ভ্যাঁ কেত্তন গাছে

শাকচুন্নি বেম্ভদত্যি

ভ্যালেন্টাইন নাচে।

-–------------------

SUJATA MISHRA

পোস্টম্যান

ডাকবাক্স থেকে চিঠি বের করে সে প্রত্যহ।

বিলিয়ে আসে মাটির ঠিকানায়।


শরতের শিউলি কখনো, শীতের ডাহুক রোদ্দুর,

হেমন্তের নবান্নের সুখ চিবুকে হাসি ফুটিয়ে

রেখে আসে ঠিক ঠিকানার দাওয়ায়।


কিন্তু যখন শ্রাবণ আসে

সীমান্তের প্রহরীর হারানো সংবাদ…

শাঁখা পরা দুই হাতে তুলে দিতে হয় তাকে

সে ভিজে ভিজে খাম

তখন তার কাছে কোনো ভাষা থাকে না বলার।

কেউ যে কখনো তাকে শেখায়নি!


হঠাৎ একদিন ডাকবাক্স উপচে পড়ে

হলুদ সুখ উড়ে বেড়ায় আশেপাশে…


প্রজাপতি গুনগুন স্বরে বলে, 

পোস্টম্যান! তোমার চিঠি এসেছে আজ!


কোন্ দূরের কোন্ সর্ষে ক্ষেতের গন্ধ মাখা

ভোর-আলতায় সুর চোবানো

নয়নতারার কলম দিয়ে

গুটি কয়েক ছবি আঁকা…

'মেঘ আছে তো কী?

আজ ফাল্গুন।'


বাতাসে বাতাসে খুশির বুদবুদ

ঘাসে ঘাসে ভালোবাসা


পোস্টম্যান শ্রাবণ কাঁধে পৌঁছে যায়

শাঁখা পরা হাতের মুঠোয়…

বৃষ্টি ঝরার আগেই খুঁজে পাওয়া ভাষায়

আশা ছড়ায়…

'কোকিল ফিরবে! 

মেঘ আছে তো কী? 

আজ ফাল্গুন!'

-----------------

SUJATA MISHRA

স্বর্ণ-শৈশব

এ কী দাদুন! এত বৃষ্টিতে ভিজছ কেন তুমি?

হাতে তোমার কী?

দাদুর মুখে ভীষণ হাসি স্নান করছে, গান করছে।

কাগজ আর স্বপ্ন বেঁধে 

নাও ভাসছে তার

দূরদেশে সেই অচিন দ্বীপের ঘরে...


ইল্যাটিং বিল্যাটিং সই লো

কীসের খবর পাইলো

রাজামশাই বলে গেছেন

মল্লিকা বালিকা চাইলো…


ও দাদুন! গোল গোল ঘুরে এ তুমি কী করছো?

কী সব বকছো আবোলতাবোল?

মল্লিকা তো ঠাম্মার নাম! ঠাম্মা তো মরে গেছে!


দাদু চেপে ধরলেন ছোট্ট নাতির মুখ

চুপ চুপ! আমি তো রাজা! মল্লিকা আমার রাণী

এক্ষুণি ওর সই ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবে

আমরা খেলবো...ছুটবো… ছুটেই যাবো!


নাতির কোমরে হাত। 

দাদু ছুটছে।

আরে দাদুন! আলমারির পিছনে কী করছো এখন?

ও মা দেখে যাও দাদুনের কী যেন হয়েছে!

দাদু এসে নাতির পিঠে জোর ঠেলে দেয়

ধাপ্পা! এই ছুঁয়েছি… তুই চোর।

কানামাছি ভোঁ ভোঁ

যাকে পাবি তাকে ছোঁ...


সাইক্রিয়াটিস্ট এলেন। সাইকোলজিস্ট। এন্যালাইসিস হল, 

মেডিসিনের এক্সপেরিমেন্ট হল।

সপ্তা দুয়েক পরে ভ্রু কুঞ্চিত ডাক্তারবাবু বললেন, এই বয়সে আলঝেইমার হতে পারে কিন্তু এ তো 

তা নয়!


দাদুর হাতে পেন্সিল, খাতায় ট্রেন ছুটছে

কু ঝিকঝিক …

এক পায়ে জুতো

মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছেন গো...ল!

অন্য পা'খানা লাফিয়ে লাফিয়ে বলছে

চু...কিতকিত কিতকিত…


নাতির চোখে বিস্ময়।

এইসব দাদুন করছে টা কী?

অনলাইন ক্লাস, গেমস বন্ধ হওয়ার জোগাড় তার!

বিরক্ত মা'ও।


বাবার মুখে ঝিলিক দিলো খুশি…

ছেলেকে কোলে তুলে বললেন,


গোগোল! ভেবে কী আর হবে?

এই জাল দুনিয়ায় এসেও

তোর দাদুন ফিরে গেছেন স্বর্ণ শৈশবে।


ইকির মিকির চামচিকি

চামে কাটা মজুমদার

ধেয়ে এলো দামোদর...

-----------------------

SUJATA MISHRA

শ্বেত শুভ্র আলোর দেবী

শ্বেত শুভ্র আলোর দেবী

গেলেন অন্য ঘরে

সুর ছড়ানো দিকবিদিক

বিসর্জনের ঝড়ে।


শেষের সময় শেষের পুজো

শব্দ ছন্দ তানে

দেবী রইলেন মাটির গায়ে

গান গন্ধের টানে।


আজকে যে তার যাবার দিন!

তাই তো গেলেন চলে।

রইল পড়ে বীণা'র তার

আকাশ প্রদীপ জ্বলে।


গান জড়ানো প্রাণ হারানো

ক্লান্ত তো নয় সুর!

মাঘও ওঠে কেঁদে কেঁদে

কাঠামো যাবে দূর!


দ্বেষ আর দেশে ঠেসে আছে

বে-সুর অ-সুর কর্ম

দেবী গেলেন শরীর ছেড়ে

রইল গানের বর্ম।


সরস্বতী গানবতী 

সুরকে ছুঁয়েই থেকো

ও পারের ওই বিষাদ গুলো

গান জড়িয়ে রেখো।

-----------------

SUJATA MISHRA

আ মরি মাতৃভাষা!

বিচারসভায় ঠিক হল, আমাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হবে।

সময়টা উনিশশো বাহান্ন'র বেশ আগে। ওদের কাছে আমার অপরাধ ছিল অমার্জনীয়! 


আমি লুকিয়ে শিক্ষা হয়েছিলাম। বালিকা বধূর খাতায় ভালোবাসছিলাম…

বৈধব্য নেমে এলো মেয়েটির সিঁথিতে। 


ওরা প্রকাশ্যে বললো, বলেছিলাম পড়াশুনা মেয়েদের পাপ!


জনান্তিকে বললো, মেয়েদের এত ভালোবাসা ছড়ালে ভয় দূর হয়ে যাবে! ওদের শাসন বয়কট করবে পৃথিবী…


আমার জন্য বিচারসভা বসল খুব তাড়াতাড়ি।


বিশাল গর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি। চারিদিকে উল্লাস। আমার দিকে লক্ষ্য স্থির। কে ছুঁড়বে আমার মুখে, বুকে, চোখে, সাহসে...সরগরম আলোচনা


হঠাৎ মূক ও বধির মানুষটা ছুটে এলো কোত্থেকে! সবার পায়ে ধরলো। বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদলো। মাথা ঠুকলো…উল্লাস বাড়লো।


আমার হাত ভেঙে গেল। পা, বুক, পাঁজর, কণ্ঠ…


ওরা চলে যাওয়ার পরে সেই গর্তের চারিদিকে আমায় জড়িয়ে রাখলো মূক ও বধির মানুষটা।


তারপর বাহান্ন এলো। মানুষটা তার অশ্রু মুছে আগুন হলো। আগুন থেকে জন্ম নিল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার…


তাদের ফুসফুসে ফোঁস! চোখে লাভা! বুকে টগবগে রক্ত!


আমি ভাঙা শরীরে হাঁটছিলাম। তোতা পাখির ঠোঁটে গান দিতে হবে! শাপলা তুলে প্রেমের হাতে দিয়ে বলতে হবে, ভালোবাসো...ভালোবাসো...  


গুলি এগিয়ে এলো আমার দিকে। এত সাহস তোর এখনো? এত নরম গায়ে এগোতে চাস? 

মৃত্যুই তোর শ্রেয়! 


গুলি আরো কাছে এলো…কাছে এলো…

আগুন গুলো জমাট বেঁধে ছুটে এলো সামনে।

খবরদার! টগবগে রক্ত আমার সামনে। ওরা গুলি ছুঁড়েই চললো।


ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল রফিক, সালাম...আরো কত শত তেজ!

ভয় পেলো ওরা! আশ্চর্য! সামান্য আমাকে বাঁচাতে

বলিদান! পিছোলো এক পা...দু পা…


ঠিক হলো, আমাকে রাখা হবে আমার স্থানে।


অলস দুপুরে মূক ছেলেটার স্বপ্নের রাজকন্যা বাগানের গাছে দোল খায়…তেঁতুল চোষে।

ছেলেটি চোখ দিয়ে গলগল করে আমায় ডেকে আনে। মেয়েটি হাসে, ভীষণ হাসে। 


স্নান সেরে ছেলেটির মা হাঁড়িতে চাল তোলে। বাপ'টা আগে মাতাল ছিলো, এখন ভালোবাসা শিখেছে। বউয়ের গলায় পুঁতির মালা পরিয়ে দেয় একখানা...বলে, চুমু দেবে?


আমি চুপ করে সে মায়ের আঁচলে লুকিয়ে থাকি তখন। আমার যে সময় সময় নাম বদলে যায়! 

এই এখন যেমন লজ্জা! 


এখন আর গুলি টুলি আসে না। একুশ আসে। 


সারাদিন আমার নাম হয়ে যায়... আ মরি মাতৃভাষা!

------------

SUJATA MISHRA

ভালোবাসা

এক সকালে চোখের পাতায় কুয়াশার দুধ জমল মেয়ের

আলতা ধুয়ে দিল শিশির। 

কলমি, মটর, কড়াইশুটি খুব কাঁদল তার দুঃখে

শুকনো মরিচ রোদ্দুরেও ভিজে স্নান

থামল মেয়ের ছুটন্ত দুই পা…

থামল না এক মা।

সকাল বেলা কোল ছেড়েছে পুত্র তার

শোক ঘিরেছে পাঁজর নীচে। 

পাড়ার চোখে চোখ রেখেছে মা...

পুত্রবধূ অপয়া কেন হবে? ওটা দুর্ঘটনা।

সন্ধে নিবিড় হয়। 

মেয়ের পায়ে মাটি গড়ে মা।

একটু একটু পাঠ…

অল্প অল্প মাটি

গড়তে গড়তে মেয়ের চোখে কুয়াশা যায় সরে।

পায়ের মাটি শক্ত ভীষণ হয়।

হাঁফ ছাড়েন সেই মা

বলেন, যা রে বেটা যা! এবার অরণ্য বোন তুই!

কলমি হাসে। মটর, কড়াইশুটি। 

শুকনো মরিচ সূর্য মাখে সুখে

এগোল সেই একলা মেয়ের নিভন্ত দুই পা

আলতা দিয়ে সাজিয়ে দিল মাটি, পুত্রহারা মা।

রাত্রি হল গভীর। নিঃশব্দ চারিপাশ।

একলা মায়ের দাওয়ায় এসে বসে প্রশ্ন।

মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করে,

তোমার পৃথিবীর নাম কী গো মা? 

কেমন তাকে দেখতে বলো না!

মায়ের হাতে অনেক বাকি কাজ…

একটু একটু সাহস নিয়ে একটা তারা কিংবা

যমুনা দাসী তা নয়ত অনাথ হারু

যদি ছুটতে শেখে…

দৌড় বানাতে বানাতেই মা উত্তর দেন,

আছে আছে! এই বুকেতেই বাসা

নামটা ভারী মিষ্টি! ভালোবাসা।

------------

SUJATA MISHRA