লেখাপড়া করে যে...

সরস্বতী নদীর শান্ত স্রোতে মন্ত্র খুলে রাখলেন পুরোহিত।

গুনে গুনে তিনবার ডুব দিয়ে উপবীত দিলেন

বিসর্জন। 

উঠে এলেন ভিজে বস্ত্রে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে

বললেন, ক্ষমা করো আমায়!

এক বছর পূর্ণ হল আমার পিতৃত্ব পাটে যাওয়ার…

এক বছর…


নদী থেকে খানিক দূরেই আয়োজন করা হয়েছে

দেবী সরস্বতীর আরাধনা

বাজছে বাদ্য। ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েরা হলুদ রোদ্দুর

হয়ে এসে বসেছে মূর্তির সামনে। 

সমস্ত উপাচার সজ্জিত। 

কেবল পুরুতমশাই কেন যে আসছেন না!


আরে এই তো পুরুত! চলুন চলুন! হাতে খড়ি

বাকি যে কত!

পাড়ার ছোকরার দল ধরে নিয়ে এল পুরোহিতকে।

পুরোহিত কেঁদে পড়লেন...আমি পারব না!

আমি হাতে খড়ি দিতে পারব না!


আকাশ বাণী হল তৎক্ষণাৎ…

শিক্ষা...এই শিক্ষা আনে চেতনা

চেতনা আনে দৃষ্টির স্বচ্ছতা

বন্ধ হয় কানামাছি, লুকোচুরি

বন্ধ হয় ভোল বদল…

বন্ধ হয় বিদ্যা আগে নাকি ভিক্ষে'র তর্ক,

ডামাডোল…

জেগে উঠতে চায় মনুষ্যত্বের পাখনা!

সর্বনাশ! সর্বনাশ! ঘোর সর্বনাশ!

তার চেয়ে অমাবস্যা শ্রেয়।


ছোকরারা অবাক হয়। চোখ তুলে প্রশ্ন করে

তবে শিক্ষার প্রয়োজন নেই? 

হাতে খড়ি হবে না আজ?


আকাশ বাণী পুনরায়, মায়ের পদতলে কে আছে বসে?

হাঁস...হাঁস! ডিম দেয়, সাঁতার কাটে…

হলুদ রোদ্দুরেরা উত্তর দেয়।

আকাশ বাণীতে অট্টহাসি…


পুরোহিত কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার ছেলের

হাতে খড়ি আমিই দিয়েছিলাম।

ও মায়ের বীনা হতে চেয়েছিল!

ওই মূর্তির পায়ের নিচে জমা করেছিল ওর

অংক, ইংরেজি, বাংলা…

আমার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণ করেছিল পুষ্পাঞ্জলি


তারপর? তারপর কী হল?

এবার প্রশ্নটা দেবীর সামনে রাখা সমস্ত উপাচারের

ওরাও জানতে চায় দেবীকে তাদের শ্রদ্ধা উৎসর্গ

করার আগে…


ছেলেটা ট্রেনের তলায় মাথা রাখল একদিন। লিখে গেল...লেখাপড়া করে যে/গাড়ি চাপা পড়ে সে।

বিদ্যে আর বুদ্ধি দিয়ে আকাশ বাণীর তরঙ্গের খোঁজ

পেয়েছিল সে…

তাই তাকে সরাতে এ দেশের রাজা সময় নেয় নি বেশি।


ছোকরারা মুখ তোলে আকাশে। 

আকাশ নিশ্চুপ।

ছোকরারা পুরোহিতের অশ্রু মুছিয়ে তাকে বুকে

চেপে ধরে। 

হলুদ রোদ্দুরেরা তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে

গালে কপালে চুমো দেয়


দেবীর পায়ের নিচ থেকে হাঁস উঠে গিয়ে নদীতে নামে

তুলে নিয়ে আসে পুরোহিতের মন্ত্র, পেন্সিল…


রোদ্দুরের রঙ হলুদ সবুজ কমলা লাল হয়ে ওঠে।

প্রজাপতির মতন।


ছোকরারা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে

শোনো! এ তরঙ্গের নাম আলো!

তোমরা যতই চাও নিভিয়ে দিতে

সূর্য ঠিক উঠবে! গনগনে আগুন হয়ে উঠবে!


প্রজাপতি রোদ্দুরে স্লেট ভিজিয়ে পুরোহিত

পুনরায় হাতে খড়ি দিচ্ছে হাজার হাজার অজ্ঞানতার…

লেখো অ… জ...জীবন…


মা সরস্বতীর বীণা যেন বেজে উঠল না পুরুতমশাই?

ছোকরারা আনন্দে লাফিয়ে উঠল!

আমরা পারব! আমরা পারবই!

অমাবস্যার সর্বনাশ হতে আমরাই পারব!

হলুদ সর্ষে ফুলের ক্ষেত দুলে দুলে গান বাঁধে

লেখাপড়া করে যে/ আলো আলো হয় সে!

লেখাপড়া করে যে/ আলো আলো হয় সে!

লেখাপড়া করে যে…

----------------

SUJATA MISHRA

No comments:

Post a Comment