ঠাকুর দালানের মধ্যিখানে চেয়ারে রাখা হত
সুভাষ বোসের ছবি।
ঠাকুরদা এসে কপালে হাত ছুঁইয়ে বলতেন
'বন্দেমাতরম!'
আমি, বিশু, নন্দিনী, রাজু ঘিরে থাকতাম।
বাবা পতাকা উত্তোলন করতেন।
আমরাও ছবিতে ফুল মালা দিয়ে বলতাম,
'ভারত মাতা কী… জয়!'
জিজ্ঞেস করতাম,
আচ্ছা ঠাকুরদা এই সুভাষ কে?
ঠাকুরদা বলতেন, 'বড় হও বুঝবে।'
বছর বছর তেইশ জানুয়ারি আসত।
বিস্কুট লজেন্স খেতে খেতে আমরা একদিন
ঠাকুরদার মুখে শুনলাম,
ঠাকুরদার ছোট কাকা
দেশের স্বাধীনতার জন্য হারিয়ে গেছেন
নির্ভয় চিত্তে লড়াই করে গেছেন নিরুদ্দেশের আগে
অবধি।
কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেছেন, 'আমি হরিদাস পাল
নই… আমি সুভাষ আগুন!'
ঠাকুরদা বললেন, 'বুঝলে দাদুভাই! আমার ছোট কাকা ছিলেন সুভাষ বোস!'
তবে যে তুমি বললে তাঁর নাম হরিদাস পাল?
ঠাকুরদা কপালে দু হাত তুলে প্রণাম করে বললেন
'বড় হও, বুঝবে।'
বড় ঝড় চারিদিকে!
ঠাকুর দালান, ঠাকুরদা তছনছ হয়ে গেল একদিন।
ঠাকুরদার ছবি দেওয়ালে টাঙিয়ে ধুপ দিল মা।
ভেঙে গেল মানুষ, ভেঙে গেল হৃদয়।
সভ্যতা উন্নয়নের সিঁড়িতে উঠতে লাগল
তরতর করে…
ধান ক্ষেতে পড়ে রইল কমলা মাসির একমাত্র
মেয়ের দেহ…
বেকার ছেলেটা গাছের সঙ্গে পেঁচিয়ে নিল গলা
কমলা মাসি পাগল হল।
বেকারের মা স্তব্ধ হয়ে গেল।
ঝড়! প্রবল ঝড়! প্রগতির ঝড়!
আমি, বিশু, নন্দিনী, রাজু ছিঁড়ে ফেললাম
ভয়।
এগিয়ে গেলাম ক্ষেতের অন্ধকারে
খপাখপ কোপ মারলাম হিংস্র জিভে
কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে এলাম
কমলা মাসির পায়ে
বেকারের চিঠি আর সমস্ত সার্টিফিকেট নিয়ে হাজির হলাম টেবিলে টেবিলে
ততক্ষণে টেবিলের নীচ দিয়ে বাড়ানো হাত এসে
পৌঁছেছে আমাদের কাছে।
আমরা এক টানে ভেঙে ফেললাম সে হাত
বললাম, হোক যোগ্যতার পরীক্ষা হোক!
দলে দলে বেকারের মা আওয়াজ তুলল,
'হোক হোক যোগ্যতার পরীক্ষা হোক!'
অসুখে ছুটে গেলাম বুক ভরা বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে
খিদেয় খাদ্য, তৃষ্ণায় জল…
তেইশে জানুয়ারি আমাদের ভাঙা চোরা উঠোনে
পতাকা তুললেন বাবা।
ফটো ফ্রেম থেকে এক বাক্স লজেন্স নিয়ে
নেমে এলেন ঠাকুরদা
বললেন, 'এই যে তুই, তুই খোকা তুই
বিশু, নন্দিনী, রাজু…
তোরাই তো সুভাষ বোস!
তোরাই নেতাজী! স্পর্ধা আর আগুন!
আজাদ হিন্দ বাহিনী তোরাই!
ওই দেখ ভারত মাতা তোদের কপালে
জয় টিকা এঁকে দিচ্ছেন!
বল, বন্দেমাতরম! বন্দেমাতরম!'
আমার তিরিশ বছরের জিজ্ঞাসায়
ভ্রু কুঞ্চিত হয়…
তবে যে বলতে তোমার ছোটকাকা হরিদাস পাল
আসলে সুভাষ বোস?
ঠাকুরদা একগাল হাসিতে বলেন
বড় হও, বুঝবে!
নাও, এখন লজেন্স খাও।
------------–
SUJATA MISHRA
No comments:
Post a Comment