প্রেমিক

কাকটা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে ভেসে গেল।

আবর্জনার স্তূপে কেউ এক কাঠি আগুন ফেলে

গেছে বিকেলবেলা

পচা গন্ধটা আর আসছে না

পোড়া গন্ধ আসছে। 

বাতাস ভরে ভরে প্রশ্বাসে প্রশ্বাসে আনন্দ

ঢেলে দিচ্ছে ফুসফুসে, হৃদয়ে।


এই তো তোমার চিঠি!

দেখি কী জানতে চাইছ এবার…


হুঁ, ঠিক ধরেছি আবার সেই প্রশ্ন…

কেন ভালোবাসি তোমায়...


শৈশবে অভাব, যৌবনে ঘুন

শত ছিন্ন মন

একলা চলার পা

পিচ্ছিল কলতলা, ভাঙা পেয়ালায়

কপাল ভাঙা রক্ত…

কেউ নেই! কিছু নেই!

 

তুমি চির সত্য, ভালোবাসি তাই।


কাকটা রোজ আসে। 

তোমার চিঠি আসে, প্রশ্ন আসে…

হে জীবন! মৃত্যু যন্ত্রণার জেনেও এত চাও কেন?


আমি চোখ বুজে মাটিতে শুই।

তোমার প্রশ্ন শেষ হলেই তুমি আসবে, আমি জানি।

আমার বুকের উপর শুয়ে আমাকে আদর করবে।

খামচে খামচে আমার ভালোবাসা বের করে

শুষে নেবে রস…

চুমো খেয়ে বসাবে ক্রোড়ে।


আমি অসাড় হব

আমার হাঁটু, হাঁটু থেকে কোমর, নিতম্ব

উরু, ঘুন, ব্যথা, শোক সব কিছু বাতাস হবে।

এক কাঠি আগুন লুকানো বাতাস...


তোমায় যারা ভালোবাসতে শিখিয়েছে

তাদেরও চোখে তোমায় এঁকে দিয়ে আসব তারপর।


এ চিঠিতে কী লিখেছ এসব?

ভালোবাসা দিন? বসন্ত? 

কোকিল আসবে?


কাকটা কই? আজ রোদ্দুরে ভিজছে!

ডাকছে না তো!


গান লিখব? মাটির গান?

কিন্তু ঘুন যে বড় আমার যৌবনে!


শৈশব থেকে ফের? 

বেশ। 

আরে ওই তো… বাবা আসছে! নতুন জামা…

মা'ও তো! আ...গরম ভাত…স্নেহ...আদর...


থাক! এভাবে শেখাতে হবে না আর!


তোমায় ভালোবাসার আগে ওই স্বপ্নই আমার

প্রেমিক ছিল।

---------------

SUJATA MISHRA

চমচমে প্রেম

একটা মোটে চাইছি আমি

ও গিন্নি দাও!

রসে ভরা লর্ড চমচম আহা! আহা!

ডাকছে দেখো! 

হাত নাড়িয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে, ভ্রু নাচিয়ে…

বলছে, আয় খোকা আয়!

আয় খোকা আয়…


না মানে খোকা, বুড়ো ওই একই হল আর কি!


অমন মুখ ভাঙানোর কী আছে, শুনি?


ও গিন্নি...গিন্নি! তুমি পান খেয়েছ? ঠোঁট টুকটুক লাল

দাঁত নেই তো কী হয়েছে! গোলাপ দুটো গাল


না না ...মিথ্যে নয়কো, ভনিতাও নয়

ভালোবাসা গিন্নি ভালোবাসা! না বুঝলে হয়?


বাব্বা, কত লজ্জা ঘিরল তোমার চোখে!

সেই ফুলশয্যার রাতের মত…


তোমার মনে আছে গিন্নি?

ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এল জানলার পাশে

ঘরের আলো গেল নিভে

তুমি আমি মুখোমুখি দুইজন

তোমার হাতে আমার হাত

আমার হাতে তোমার

রজনীগন্ধার গন্ধ ম ম করছিল ঘরখানায়

আর কী ছিল বলো তো?


বা রে ভুলে গেছ? 

ঠিক এই রকম এক থালা চমচম

টেবিলের উপর কে যেন রেখে গিয়েছিল

আমি তো গপাগপ খাচ্ছি!

রস টম্বুর চমচম ওহো!

চিবিয়ে চুষে জিভের মধ্যে আগলে সামলে

চমচম খেয়েই যাচ্ছি…

আহা হা... আহা হা! কী তার স্বাদ!


এই যা! ও গিন্নি রেগে যাচ্ছ কেন?


আচ্ছা আচ্ছা যেও না

শুনে যাও…

আজ আমার মনের ভিতর বড় প্রেম জেগেছে


সেই যে সমুদ্রে আমাদের হানিমুন,

তোমার মনে আছে?


চাঁদনী রাতে সমুদ্র যেন নীল পরী

সেজেছে রুপোলি অলংকারে।

সৈকত জুড়ে পেতে রাখা জ্যোৎস্না।


তোমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে 

তোমায় জিজ্ঞেস করলাম, ভালোবাসো?

তুমি কী করেছিলে, মনে আছে গিন্নি?

আমার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে চোখ বন্ধ করে

বলেছিলে, শুধু তোমাকে…


দেখি দেখি মুখখানা, ইস একেবারে আমার নতুন বউ গো আজ!


এই তারপর... তারপর কী হল বলো তো!

আমি তোমাকে আমার কোলে টেনে নিলাম।


ব্যাগ থেকে বের করলাম কৌটো

আহ কী মিষ্টি ছিল সেদিন চমচম গুলো!

আমি চিবিয়ে চুষে জিভের মধ্যে রেখে সুখে

খাচ্ছি তো খাচ্ছি...খাচ্ছি…


এই রে! যাহ! আবার চমচমে চলে গেছি!


ও গিন্নি একটা মোটে দাও না তবে!

একটা খেলে কী আর হবে?

নব্বই তো হল এবার, সময় নেহাত কত ছোটো?

আরে গিন্নি কর কী? কর কী? কাঁদে না সোনা! ওঠো!


থালা বাড়ালে? দিচ্ছ হাতে? আহা হা... আহা হা

একটা গোটা? 

দাঁড়াও দাঁড়াও দু চোখ বুজে হৃদয় দিয়ে আগলে

সামলে আরাম করে খাই।


খুব রেগেছ বুঝতে পারছি… 

শোনো না শোনো

বিদ্যাসাগর মশাই মেয়েদের জন্য কী করেছেন জানো?

বলি শোনো তবে মন দিয়ে, 

বিধবা বিয়ে…


এই রে… ক্ষেপেছে গিন্নি! রণচন্ডী! 

মাথায় সিঁদুর রক্ত জবা, হাতে খড়্গ তার!

চোখে আগুন ভীষণ তেজে! গলায় মুন্ড হার…


আর হবে না, এই কান ধরছি। ওঠবস?


হায় হায় চমচমটা নিয়েই নিল কেড়ে।


যা রে লোভ! পালা শিগগির!

আর তো কোনো উপায় নাই...

খোকা হোক, বুড়ো হোক

ভালোবাসা, ভালোবাসাই!

------------------

SUJATA MISHRA

পঞ্চাশে মা

বাবা মায়ের বিয়ের কোনো ছবি নেই, গল্প আছে। এক বাইশের বর বারো বছরের কিশোরীকে বিয়ে করে আনছে ভিড়ে ঠাসাঠাসি বাসে…


গল্পে ছেদ। 


ভ্যাঁ করে শুরু কান্না, তবে আমি কোথায় ছিলাম? বাবা হেসে বলত, আরে চুপ কর! ছিলি, ছিলি তুই তোর মাকে জড়িয়ে বসে ছিলি।


আজও আছি। পৃথিবী জড়িয়ে, লেপ্টে আছি। প্রহরী হয়ে আছি!



বারো বছর থেকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল মানুষটা, এখনো সে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধক্ষেত্র বর্ধিত হচ্ছে...বাড়ছে শত্রু। 

কিন্তু তাতে মানুষটার ভ্রুক্ষেপ নেই। 


মানুষটা যে মা!


'খবরদার! এক পা কাছে আসিস যদি আর…' দুজন আছি ডাইনে বাঁয়ে। টুকরো শব্দও পড়ে যদি এ পবিত্র রাজ্যে…


জেনে রাখিস আজ দেশলাই, কাল দাবানল হতে পারি!


পঞ্চাশ বর্ষ!

তবু রাত্রি গভীর এখনো…

আমিও অন্ধকারে সাঁতার কেটে কেটে 'মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূর...' 


ভোরের স্টেশনে এসে তবে থামব! 

যুদ্ধ থামবে। সূর্য উঠবে। মাটি হাসবে। 


আমি বলব, ভাগ্যিস মা সঙ্গে ছিল!

-----------------------

SUJATA MISHRA

আরে সামলে!

এই দেখ! খাচ্ছি হোঁচট…

হাতটা ধরো!


বাতের ব্যথা, ডায়াবেটিস আমার।

তোমার আবার হাই প্রেসার

এক মাথা চকচকে টাক!


এই, মনে আছে? 

তোমার কী সুন্দর কোঁকড়ানো চুল ছিল!

আমি বলতাম, ঢেউ। 

বিলি কেটে বলতাম, নিরিবিলি অরণ্য।

তুমি বলতে, 

মেয়েরা ছেলেদের এমন করে বলে না গিন্নি!

ছেলেরা মেয়েদের বলে।


ইস! আদরের অধিকার বুঝি শুধু ছেলেদের?


ওই দেখো! তুমিই যে পড়ে যাচ্ছ এবার!

ধুতি সামলে…


এই ফুচকা খাবে? টক মিশিয়ে ঝাল ঝাল...

ওমনি, না? কেউ দেখলো তো বয়েই গেল!

এখন যে বড় লজ্জা দেখি!

ও পেটের ব্যামো! ফের চালাকি?

চলবে না ওসব মশাই!


বয়স? বয়স আবার কী?

না হয় চামড়া গেছে ঝুলে

দাঁত গেছে পড়ে

মন কি গেছে মরে?


মাটির ঘরে চির। কুমড়ো মাচাও শুকিয়েছে।

আমরাও এ মুহূর্তে ধসে যেতে পারি

হাত ছেড়ে ছিঁড়ে যেতে পারি 

একা বিছানায় অপেক্ষা হতেও পারি…


আরে কী ভাবছো? 

চলো চলো! 

ফুচকা ঘিরে প্রজাপতিদের দলে ভিড়তে হবে যে!

আহ, পড়ে যেও না!

ধুতি সামলে!

---------------

SUJATA MISHRA

স্বরলিপি

তোমার বাম চোখের পাতা কাঁপছে

কী বলছে আমি জানি, শুনবে?

ও বলছে, এত ভালোবাসো কেন আমায়?


বা রে! ভালোবাসার দাওয়ায় বসে ভালোবাসা

ভালোবাসব না, তাই কি হয় বলো?


ওই দেখ, বাম ভ্রু হেসে উঠল তোমার 

আমি বুঝি! বুঝি… 

ও হেসে আমার হাত ছুঁতে চাইছে।

মনের উপর রাখতে চাইছে নিঝুম শান্তি


কী বলছ? ডান চোখের ভাষা?

হ্যাঁ তাও শুনছি…

তোমার ডান চোখ আর ডান ভ্রুতে জিজ্ঞাসা,

কী করে তোমায় বুঝি আমি?

কী করে ঠিক ঠিক তুলে আনি তোমার প্রিয়

কলমি শাক, চাল কুমড়ো, মিষ্টি আলু!


কী করে তোমার নাভির গভীরে সমুদ্র খুঁজে পাই!


কী করে বা তোমার পর্বতের মধ্যে আমার রামধনু

এঁকে রাখি!


কী করে বা চিৎকার করে বলি, ভালোবাসা ভালোবাসতে জানে!


এই এত প্রশ্ন যে জমা রেখেছ ওদের ইশারায়,

ওরা তো ক্লান্ত হয়ে যাবে!

তার চেয়ে এস ফুল ফুল খেলি।


তোমার চুলে এই গুঁজে দিলাম মাধবী

তুমি রজনীগন্ধা থেকে শুরু কর!

আমি গোলাপ, তুমি হাস্নুহানা

আমি শিশির ভেজা ভোর

তুমি পা ফেলে এগিয়ে যাওয়া রোদ্দুর…


তোমার মনে আছে, আমার দিকে ঘৃণা

ছুঁড়েছিলে কেমন একদিন? বলেছিলে এমন

একজন, যে কিনা…

আহা কথা চেপে ধরছ কেন আমার?

থাক বলছি না তবে আর।


কিন্তু এরপর যদি কোনোদিন আবার 

বাবুই কোয়েল পাপিয়া আসে

তোমার ঘুম ভাঙায়

তোমার ঠোঁটে রাখে গান

তোমার চোখে রাখে রঙ

তুমি কী বলবে তাদের?


বলবে কি, যা পাখি তোরা অন্য কোথা যা!

 

এই দেখ, আমার দিকে তাকাও।

আমার বুকের দিকে…

এবার তুমি বলো তো, কী বলছে আমার স্পন্দন?


হ্যাঁ একদম ঠিক! 

বলছে, জোয়ারের মত আছড়ে পড়ো এ শুষ্ক 

বন্দরে…

ভালোবাসো, ভালোবাসো, ভালোবাসো খুব…


আরে আরে...ওই দেখো তিনটে শালিখ নেমে আসছে

ঝগড়া করতে করতে!

বলছে, মূক বধির মানুষ কী করে এমন কথা

বুনতে পারে? 

সব মিথ্যে! সমস্তটাই ছলনা!


ওগো, হাত ধরো আমার। 

চলো আমরা দুই দোয়েলে  

ওদের ঝগড়া থামিয়ে 

হৃদয়ের স্বরলিপি চিনিয়ে দিই। 

----------------

SUJATA MISHRA

সন্ধান চাই শিরদাঁড়ার!

কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে মেঘ হয়ে নামতে নামতে 

হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে যে মাটিতে,

সে মাটির নাম ভারত বর্ষ।

মাটি থেকে সূর্য পুনরায় বৃষ্টি শুষে নেয় তাপে, 

মেঘ হয়ে তা জমা হয় কাঞ্চনজঙ্ঘায়

সোনালী আলোয় চামর দোলায় ছন্দ

কুড়িয়ে কুড়িয়ে গল্প লেখে খামখেয়ালি এক লোক

সে গল্পের নাম ভারতবর্ষ।

প্রখর গ্রীষ্মে খাঁ খাঁ মাঠ পেরোতে পেরোতে

তৃষ্ণার্ত পথিক যখন দিশা হারিয়ে ফেলে,

জলসত্ৰ নিয়ে এগিয়ে আসে কেউ।

বাতাসা দুখানা আর মাটির গেলাসে শীতল জল

পথিক বুকে হাত রেখে বলে, আহঃ, বাঁচলুম!

একদিন শীতের দুপুরে এ পথিকই 

কেটে ফেলেছিল এ মাঠের

সমস্ত ছায়া, সব মায়া, সব শিকড় …

সে পথিকের নাম ভারতবর্ষ।

মিলনে মিলনে বসে মেলা।

বাঁশিতে হাসিতে মেতে ওঠে পাড়া

ঈশ্বর কিনে মাথায় ঠেকায় অপুত্রক জননী

হাঁড়ি কাঠে পুরুষ ছাগ বলি হয় একের পর এক

রক্তে তিলক কাটে পুরোহিত

মা...মাগো! আরও চাস? আরও পাবি!

এক রত্তি প্রশ্ন করে মুখ লুকিয়ে,

মৃত্যুতে এত উৎসব কেন?

সে উৎসবের নাম ভারতবর্ষ।

এক নয় দুই নয় একশত কোটির জয়ধ্বনি

নেতা আমলা মন্ত্রী নির্বাচন

জোড় হাত করে আঙুলের ছাপ চেয়ে নেওয়া...

ভোট! ভোট! ভোট দিন!

এ আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার!

তারপর সিংহাসন উড়ে চলে

বরফের উপর সোনালী রোদ্দুর

নাকি সোনার নিচে চাপা পড়া শুকনো মুখ…

খুঁজে খুঁজে সত্যি জানতে চায় শিরদাঁড়া

তারপর তার খুব জ্বর আসে

ঘর ভাসে

বন্যা হয়…

সে বন্যার নাম ভারতবর্ষ।

মেহের আলির প্রাণঘাতী রোগ

গা ছুঁয়ে বসে আছে রাম।

একটু আগেই রামের রক্ত ঢুকেছে মেহের আলিতে

তার ছেলে বলেছে, চাচা! বড় মেহেরবানি আপনার!

রাম বলেছে, ঈশ্বর আছেন বাছা 

তোমার বাবার কিছু হবে না!

বুক পেতেছে সুখ। 

দুহাতে জড়িয়ে নিয়েছে মেহের আর রাম

সে সুখের নাম ভারতবর্ষ।

দিগন্ত থেকে দিগন্তে কালো মেঘের ঘনঘটা!

চুরমার মন্দির! ভেঙেছে মসজিদ!

গির্জাও তছনছ

একশত কোটির ক্রুর পদধ্বনি!

দাঙ্গা প্রবল! ঝড়, তুফান, বজ্রপাত!

উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা

নিয়ে ছুটে আসছে এক বিশালাকায় মানচিত্র…

চিৎকার করে বলছে, ওরে থাম থাম

আমায় কাটিস না! আমায় ভাঙিস না!

ওরে তোরা শান্ত হ!

হুঙ্কার ছাড়ছে তার মরুভূমি…

দামামা আরো আরো প্রবল!

ভয়ংকর!

মানচিত্রের ঠিক মাঝখানটিতে বসে আছে

বড় রাস্তার পাশের ফুটপাত।

পেটে তার ভীষণ খিদে 

হাড়ে হাড়ে ঠকঠকে শীত…

কিন্তু কোলে তার ঝিলমিল করছে এক টুকরো প্রাণ

ছেঁড়া আঁচলে ঢেকে সে মা তার সবটুকু উত্তাপ

ঢেলে দিচ্ছে বাছাকে।

পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে বলছে,

আয় আয় চাঁদমামা… টিপ দিয়ে যা।

মানচিত্রের মাঝখানে বসে থাকা 

এ পরম সত্যের নাম মা।

জ্যোৎস্না কুড়িয়ে কুড়িয়ে পোড়া রুটি খুঁজে আনতে চাওয়া লোকটা ছায়া কাটে না…

বরং জলসত্ৰ বানানোর স্বপ্ন দেখে প্রখর দাবদাহে।

সে লোকটা পথিক নয়, পিতা।

ডাস্টবিন থেকে পাওয়া ভাতের টুকরোগুলোর

গায়ে স্নেহের গান লিখে সন্তানের ঠোঁটে ভরে দেয়

যে স্ফূর্তির ফুটপাত।

আমাদের সে গানের নাম ভারতবর্ষ।

আমাদের সে স্বপ্নের নাম ভারতবর্ষ।

আমাদের সে 'সন্ধান চাই' শিরদাঁড়ার নাম ভারতবর্ষ!

-----------------

SUJATA MISHRA

ভূতের রাজা দিল বর

'ভূতের রাজা দিল বর'

তুই আমি; এক ঘর এক ঘর


'ভূতের রাজা দিল বর'

তুই আমার; এখনো নিজের বর


কত দিন হয়ে গেল মনে আছে তোর?

ছাদে আর চাঁদে হয়ে যেত ভোর

লম্বা লম্বা কথা, বিরতি স্বল্প শ্বাস

তুই বলতিস, পুরুষে আর ভয় পাস?


'ভূতের রাজা দিল বর'

তুই আমি, পোড়া ঘর, ছেঁড়া ঘর।

-------–-------

SUJATA MISHRA

'বড় হও, বুঝবে!'

ঠাকুর দালানের মধ্যিখানে চেয়ারে রাখা হত

সুভাষ বোসের ছবি। 

ঠাকুরদা এসে কপালে হাত ছুঁইয়ে বলতেন

'বন্দেমাতরম!'


আমি, বিশু, নন্দিনী, রাজু ঘিরে থাকতাম।

বাবা পতাকা উত্তোলন করতেন।

আমরাও ছবিতে ফুল মালা দিয়ে বলতাম,

'ভারত মাতা কী… জয়!'


জিজ্ঞেস করতাম, 

আচ্ছা ঠাকুরদা এই সুভাষ কে?

ঠাকুরদা বলতেন, 'বড় হও বুঝবে।'


বছর বছর তেইশ জানুয়ারি আসত।

বিস্কুট লজেন্স খেতে খেতে আমরা একদিন

ঠাকুরদার মুখে শুনলাম,

ঠাকুরদার ছোট কাকা

দেশের স্বাধীনতার জন্য হারিয়ে গেছেন

নির্ভয় চিত্তে লড়াই করে গেছেন নিরুদ্দেশের আগে

অবধি।

কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেছেন, 'আমি হরিদাস পাল

নই… আমি সুভাষ আগুন!'

ঠাকুরদা বললেন, 'বুঝলে দাদুভাই! আমার ছোট কাকা ছিলেন সুভাষ বোস!'


তবে যে তুমি বললে তাঁর নাম হরিদাস পাল?

ঠাকুরদা কপালে দু হাত তুলে প্রণাম করে বললেন

'বড় হও, বুঝবে।'


বড় ঝড় চারিদিকে!

ঠাকুর দালান, ঠাকুরদা তছনছ হয়ে গেল একদিন।

ঠাকুরদার ছবি দেওয়ালে টাঙিয়ে ধুপ দিল মা।

ভেঙে গেল মানুষ, ভেঙে গেল হৃদয়।

সভ্যতা উন্নয়নের সিঁড়িতে উঠতে লাগল

তরতর করে…


ধান ক্ষেতে পড়ে রইল কমলা মাসির একমাত্র

মেয়ের দেহ…

বেকার ছেলেটা গাছের সঙ্গে পেঁচিয়ে নিল গলা


কমলা মাসি পাগল হল।

বেকারের মা স্তব্ধ হয়ে গেল।


ঝড়! প্রবল ঝড়! প্রগতির ঝড়!


আমি, বিশু, নন্দিনী, রাজু ছিঁড়ে ফেললাম 

ভয়।

এগিয়ে গেলাম ক্ষেতের অন্ধকারে

খপাখপ কোপ মারলাম হিংস্র জিভে

কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে এলাম

কমলা মাসির পায়ে

বেকারের চিঠি আর সমস্ত সার্টিফিকেট নিয়ে হাজির হলাম টেবিলে টেবিলে

ততক্ষণে টেবিলের নীচ দিয়ে বাড়ানো হাত এসে

পৌঁছেছে আমাদের কাছে।

আমরা এক টানে ভেঙে ফেললাম সে হাত

বললাম, হোক যোগ্যতার পরীক্ষা হোক!

দলে দলে বেকারের মা আওয়াজ তুলল,

'হোক হোক যোগ্যতার পরীক্ষা হোক!'


অসুখে ছুটে গেলাম বুক ভরা বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে

খিদেয় খাদ্য, তৃষ্ণায় জল…


তেইশে জানুয়ারি আমাদের ভাঙা চোরা উঠোনে

পতাকা তুললেন বাবা।


ফটো ফ্রেম থেকে এক বাক্স লজেন্স নিয়ে

নেমে এলেন ঠাকুরদা

বললেন, 'এই যে তুই, তুই খোকা তুই

বিশু, নন্দিনী, রাজু…

তোরাই তো সুভাষ বোস!

তোরাই নেতাজী! স্পর্ধা আর আগুন!

আজাদ হিন্দ বাহিনী তোরাই!


ওই দেখ ভারত মাতা তোদের কপালে 

জয় টিকা এঁকে দিচ্ছেন!

বল, বন্দেমাতরম! বন্দেমাতরম!'


আমার তিরিশ বছরের জিজ্ঞাসায়

ভ্রু কুঞ্চিত হয়…

তবে যে বলতে তোমার ছোটকাকা হরিদাস পাল

আসলে সুভাষ বোস?

ঠাকুরদা একগাল হাসিতে বলেন

বড় হও, বুঝবে!

নাও, এখন লজেন্স খাও।

------------–

SUJATA MISHRA