'অমৃতস্য পুত্রা…'

ঊষর ক্ষেতের পাশে শুষ্ক শরীরে শুয়ে পাগলিনী
প্রলাপে মত্ত।
দিগম্বরী সাজ তার। শয়ে শয়ে পিঁপড়ে তাকে ঘিরে।

গৃহস্থ বাড়ির বধুটি এ পাড়ায় আসছিল শিশু খুঁজতে তার…
বিস্মিত চোখে দেখল, ঊষর ক্ষেতের ঠিক মাঝামাঝি
এক খানা বৃষ্টির মেঘ ঝুলে আছে…
কচি চারা উঁকি দিয়ে আছে তার শিশুটির মত।

পাগলিনী র কাছে গিয়ে দেখে,
কেউ তাকে করেনি প্রসূতি
কেউ দেয় নি কালশিটে ক্ষত…
শুষ্ক ত্বকের নিচে এখনো লুকিয়ে ঘর
চোখের ভিতরে স্মৃতি…

বধূটি বাড়ি নিয়ে ফেরে শিশু আর পাগলিনী একসাথে
স্নান করিয়ে শাড়ি পরিয়ে আয়না রাখে তার সামনে

শিশুটি দেখতে পায় সে আয়নায় স্বপ্ন ফুটে উঠেছে
এক সুন্দর…
বৃষ্টি পড়ছে
ঊষর ক্ষেতে গান গেয়ে গেয়ে শ্রাবণ বুনছে কৃষক।
—-------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

আমরা যখন

আমরা যখন একসঙ্গে থাকি
সকাল কেটে নদী মাঠের বেলা
মেঘ রোদ্দুর আঁকি
ময়ূর ময়ূর করতে লাগি খেলা!

আমরা যখন একসঙ্গে থাকি
গা ধোয়ানো সুখ আছড়ে পড়ে
ভালোবেসে মাখি
আমাদের সেই একলা হওয়ার ঘরে…

আমি তার চুল ভিজিয়ে বলি
দূর নয় তো দূরে!
একটা ছোট্ট গলি
তারপরেতেই বাঁধা আমরা সুরে

ছুঁয়ে আসি বৃষ্টি বৃষ্টি ঘাট
চুমো নামের ঢেউ
আমাদের সেই মাতাল হাওয়ার মাঠ
যেখানে আর যায় না কেউ!

কেবল একটা কথা আঁকি
আমরা যখন একসঙ্গে থাকি
কোয়েল তিতির বাবুই শ্যামা ডাকি
ভালোবেসে ভালোবাসা মাখি…

পাহাড় থেকে ঝর্ণা গড়ায় খুব
আমি তাকে জড়িয়ে থাকি
একসঙ্গে বিরহে দিই ডুব
আমি তাকে কবিতা বলে ডাকি।
—--------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

ভালোবাসা

আধো ঘুম তখন তার, 
বললাম, করো হাঁ…
গ্রাস মুখে নিয়েই সে বলল, ভালোবাসো?

আলুথালু মুখ। হলুদ গুঁড়ো আর স্নেহ মেশানো আঁচল
বললাম, বিকেলে সিনেমার টিকিট কাটলাম,
তৈরি থেকো।

হলের ভিতরে ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে
জিজ্ঞেস করলাম, ভালোবাসো?

মায়ের চুল বাঁধছিল সেদিন।
ফুল ফুটেছিল আগেই
কবরীতে করবী এনে দিল গুঁজে
আমি পাশে এসে দাঁড়াতেই আমার দিকে হাত বাড়ালো।
মা হেসে উঠল। বলল, হ্যাঁ রে! বিয়ে কত বছরের হল
তোদের? পুরানো হয় না বুঝি আদর?
তার তিরতির করে ওঠা ঠোঁট বলল, পনের মা।

রাত্রে সে ভীষণ করল রাগ!
দৃষ্টিতে নিশ্চুপ।
বুকের মধ্যে মুখটা নিয়ে তখন খুব বলছি আমি
ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি
সে বলছে, চলবে না এ! 
বিদেশ তোমায় যেতেই হবে! 

অনেক বড় প্রমোশন আমার 
সে থাকবে অপেক্ষায় এমনই কথা
ভালোবাসাও থাকবে বিলক্ষণ
কিন্তু আমি না বলাতেই রাগ তার খুব…

চোখে তার জল দেখেছি।
প্রশ্ন রেখেছি আলিঙ্গনে, তবে দিতে চাও কেন যেতে?

শেষে টিকিটখানা দিলাম ছুঁড়ে ফেলে।
মা বলল, বেশ করেছিস।
সে হেসে বলল,
এমন বোকা আর কেউ থাকে?

বাহুর ঘরে তাকে টেনে নিই। 
বলি, ভালোবাসা বেঁধে যে রাখে!
—-----------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

গান রাখলাম চুম্বনে

শ্যাম - 'ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো-- তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো-- তোমার চরণমঞ্জীরে॥'

আহা রাই আমার! চরণে এত শোণিত? 
এই অভিসারে আমার যে গো হৃদয়ে বড় ক্ষত!

রাই - অশ্রু কেন চোখে তোমার প্রিয়? প্রেমে কি গো এত ব্যথা লাগে? এইটুকু ক্ষত এ আমার বড় আনন্দের! 

শ্যাম - দাও দাও পা দুখানি! কোলে তুলে আদর দিই, যত্ন দিই। 

রাই - ইস! প্রাণ আমার! তার চেয়ে বাঁশিতে তোলো মেঘ মল্লার…ঝমঝম করে বৃষ্টি আসুক। আমরা দুজন একসঙ্গে ভালোবাসতে বাসতে ভেসে যাই শ্রাবন দেশের ঘাটে। শুধিয়ে আসি সুধার পুকুর ঘাটে, তোমরা কি কেউ ভালোবাসতে পারো, আমার শ্যামের মত?

শ্যাম - গোকুল যে ছাড়তে হবে আমায়! মথুরা গমনের সময় হয়েছে। তোমার জন্য একটা গান বেঁধেছি। সেইটে তোমার মর্মে দেব ঢেলে। আমায় মনে পড়লে শুনো তাকে। আগল দিয়ে রেখো। শরীর মন সবটুকু বন্ধ করে যত্ন দিয়ে…

রাই - এমন করে বোলো না সখা! তোমায় ছাড়া কেমন করে থাকবো তবে প্রিয়? শাশুড়ি ননদ কাঁটা বিছায় পথে, স্বামী মুখ ভার করে…তবু ছুটে ছুটে আসি। তোমায় ছেড়ে থাকবো কেমন করে?

শ্যাম - প্রেমে বিরহ যে অবশ্যম্ভাবী প্রিয়ে! আমার গান খানি হৃদয়ে রেখো। তোমার যখনই মনখারাপ হবে, নিজের বুকে হাত দিয়ে আমায় ছুঁয়ে নিও।

রাই - কেমন করে আমার বুকে তোমায় পাবো?

শ্যাম - ভালোবাসলে শরীর জুড়ে যায় মনের সঙ্গে। মন শরীরে। দূরত্ব যতই সুদূর হোক, আশায় বাসা গড়ে তোলে ভালোবাসা ঠিক বুকের মাঝখানে। আমি যেমন তোমায় ছোঁবো অনুভবে, তেমনই তুমিও আমায় পাবে।

রাই - যেও না কানাই!

শ্যাম - এই তো উচিত তোমার দেবী? এত স্বার্থপর তো নয় ভালোবাসা! আঁচল খুলে দাও…

রাই - ‘‘জনম অবধি হাম রূপ নেহারিলু—
নয়ন না তিরপিত ভেল।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু
তবু হিয়া জুড়ন না গেল।"

যাও তবে। ফিরে এস ঠিক। যদি এক পৃথিবী বদল হয়ে যায়…যদি সহস্র বছর পার হয়ে যায়…যদি মেঘ রোদ সুর নতুন হয়ে যায়…ফিরে এসে আমার বুকে তোমার গান খানিকে ঠিক খুঁজে পাবে। 
আমার শরীরে তোমার ঘ্রাণ…
আমার কিন্তু মৃত্যু হবে না কানু!
সাবধানে এস…

শ্যাম - বিদায় দাও। কর্তব্য শেষ করেই ফিরে আসবো আমাদের এই হৃদয় পুরের বাসায়।
দেখো, বৃষ্টি নামলো।
এই গান রাখলাম চুম্বনে…
—-----------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

বিজয়া

অতি স্নেহে বাবা নাম রেখেছিলেন আগমনী।
মাস তিনেক পরেই বাবা মায়ের গাড়ি দুর্ঘটনায়
মৃত্যু…
আমার নাম হয়ে যায় অভাগী।

আমার বুদ্ধি হালকা ছিল। শরীর ছিল ভারী।
জেঠি মারতে মারতে হাত ব্যথা করে ছেড়ে দিয়ে
বলত, আবাগী মরে না বাপু! 

বই পত্তর ছুঁয়েও দেখিনি কোনোদিন
দেখিনি কেমন করে ভালোবাসা হয়
ছোটকার বন্ধু এসে আমার গালে টোকা দিয়ে
বলত, কী খুকু কেমন আছো?
বেশ লাগত আমার।

আমার বুদ্ধি বড় হালকা। কিন্তু হৃদয় ছিল ভারী।
কেঁপে কেঁপে উঠত সেই টোকায়।

রোজ রোজ এমন চলতে চলতে আমার শরীরে
গজিয়ে উঠল জেঠির সঙ্গে দেখতে যাওয়া
যাত্রা পালা…
একদিন ফাঁকা বুদ্ধির ঘরে কী এক বিস্ময়
প্রবেশ করল। কী এক আনন্দ…
জাপটে ধরে আঁচড়ে কামড়ে ভালোবেসে ভেসে
গেলাম। 
ছোটকার বন্ধু সেদিন আমার গালে স্নেহ রাখতে আসার সুযোগ পেয়ে
আর তাকে ছাড়িনি…

হালকা বুদ্ধি বলে কি শরীর বড় হতে নেই?
ছোটকা মাথায় ছুঁড়ল চ্যালা কাঠ…
জ্যাঠা বলল, বাড়ির কলঙ্ক। 
আজ দশমী। বিজয়ায় বিজয় করে দিয়ে আয়।

এসব অনেক জন্ম আগের কথা।
এখন আমি মাটি।
ছোটকার বন্ধু কুমোরটুলি।
আমায় গড়ে।
আগমনী থেকে বিজয়া হই।
আবার জলে ভেসে ভেসে ফিরে আসি কুমোরটুলিতে।

সব ভালোবাসা কী আর প্রতি জন্মে রক্ত মাংসে হয়?
—-------–------–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

বকুল বৈরাগী

এই বুঝি গনতন্ত্র? 
বকুল বৈরাগীর স্পর্ধা বড়! 
যেখানে দেওয়ালের ও কান থাকে, ও সেখানে
বাতাসে বাতাসে তুললো প্রশ্ন?
 
প্রশ্ন গিয়ে পৌঁছালো সরকারি দপ্তরে
তার আগে সুন্দরী বান্ধবীর মর্মে
এমন করে বলে কে বা? 
এতটুকুও বিবেচনা নাই? 
আমি বলে সামান্য এক নারী…
যদিও বস্তা ভরে কিছু কেমন টাকা রাখতে পারি

বকুল বৈরাগী চিৎকার করে উঠল
আমার ছেলেটা পাস করে বসেছিল
চাকরি হবে! চাকরি হবে!
একদিন মরে গেল…
শালা এই বুঝি গনতন্ত্র? 

বকুলের পাশে এসে দাঁড়ালো আরো ক্লান্ত মুখ
ক্ষুধার্ত চোখ। জিজ্ঞেস করলো, শাস্তি হবে না?

বৈরাগী উত্তর দিল, 
ওদের জন্য হাসপাতাল আছে
শাস্তি নেই…
প্রজন্মের পর প্রজন্ম হাঁ করে তোরা দাঁড়িয়ে থাক
খাবি খা
হাতে রইল হ্যারিকেন…

মন্ত্রীর সুন্দরীরা ছুটে এল বকুল বৈরাগীর কাছে
ছুটে পালিয়ে গেল পাশে দাঁড়ানো মুখ গুলো
ছো! তোর তো দেখি একটা জামাও নেই!
বকুলের গায়ে থুথু ছুড়লো সুন্দরীর নিরাপত্তারক্ষী

বকুল আকাশ ফাটিয়ে বলে উঠল,
জামা নেই, জুতো নেই, ঘর নেই, 
আমার শুধু একটা আস্ত শির দাঁড়া আছে।

ক দিন পরে সব ঠান্ডা।
সব স্রোত মিলিয়ে গেল।
মন্ত্রী আবার পেট ফুলিয়ে টাক ডুমাডুম 

শুধু বকুলকে আর পাওয়া গেল না ।
—---------–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

'কালো? তা সে…'

আমি সেই বাইশে শ্রাবণ চাই।
ঘাসের উপর নেমে আসবে মেঘ
গাছে গাছে বাতাস শুয়ে শোক রাখবে
গাছেরা নুয়ে পড়বে মাটিতে
কচি ধান গল্প বুনতে বুনতে কান্নায় ভাঙতে চাইবে
মনকেমনের পরাজয় গাঁথবে বিরহী…

চোখে কাজল এঁকে আমি দাঁড়াবো তাঁর কাছে।
তিনি মৃত্যু থেকে উঠে এসে আমার দিকে
তাকাবেন…
বলবেন, ' কালো? তা সে যতই কালো হোক… '

কালো বিড়ালটা রোজ মাছ খেয়ে যেত লুকিয়ে
শাশুড়ি মা খুন্তি ছোঁড়েন, ঘটি বাটি…
মর মর মর! 
দিন সাতেক হল বিড়াল টা আর আসেনা
কালো বউ দুপুরবেলা একটা উপন্যাস হয়ে যায়
শাশুড়ি মা ননদের সঙ্গে অ-সুখ ঢালেন তাতে
কালো বউ চুল ভিজিয়ে নেয় সে খটখটে দুপুরের
অ-সুখে…
তারপর স্বপ্ন দেখে।
আমি কি প্রবল স্বপ্ন দেখি!…

আমার একটা ঝর্ণা থাকবে
গা ডুবিয়ে তিরতিরে স্রোত হব আমি।
আমার একটা পাখি থাকবে
রং চুবিয়ে তাকেই রেখে যাবো সাদা ক্যানভাসে
আমার একটাই কবিতা থাকবে
'কালো? তা সে যতই কালো হোক…'

ময়না পাড়ার মাঠে দেখেছিলাম একদিন
একজন বেশ তাকাতো আমার দিকে
কিছুক্ষণ পরে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম
তুমিই কি সেই? তুমিই কি মেঘলা দিনের কবি? 
সে খুব হেসেছিল। বলেছিল, 
আমি সিধু কানহু তো নই যে সাঁওতাল পরগনা 
লিখবো! 

আমি সেই শ্রাবন চাই
সেই বাইশ…
সকাল থেকে অবিরাম বৃষ্টি পড়বে!
মন কেমন দিকে দিকে মেলবে শাখা
মেঘ আরো ঘন হবে 
আরো ঘন

তার থেকেও ঘন হয়ে উঠবে আমার চোখের কাজল
কবি মৃত্যু ছেড়ে উঠে বসবেন
আমার কানের কাছে মুখ রেখে বলবেন,
 'কালো? তা সে যতই কালো হোক…'

মিশকালো বিড়াল টা সত্যিই আর কখনো আসেনি।
—-------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

স্বয়ংসিদ্ধা

ন কর্তার শ্রাদ্ধ শান্তি চোকার পরে সুচরিতা সাদা মেঘের মত থান উড়িয়ে দিল আকাশে।
সকলে নিন্দে মন্দে বাতাসে ছ্যা ছ্যা ছড়িয়ে দিল…

সুচরিতা রামধনু রঙের শাড়িটা পরে গটগট করে
হেঁটে বেরোলো উঠোন, তুলসি তলা, আমবাগান…

ঘোমটা খুলে হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে ভিজে চোখের
জলের নাম দিল মুক্তি।

আমার নাম সুচরিতা, ন বউ নয়।
সব কর্তারা খাওয়ার টেবিলে বসে চমকে উঠেছিল নতুন বউয়ের কণ্ঠে…
মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত লোকটা তাকে সকলের সামনে ন বলেই ডেকে এসেছে।
আড়ালে গাল লাল করে ভয়ে সংকোচে ডাকতো সু…

ভালোবাসতো মাছ ভাতের পরে দিবানিদ্রা, ভরপুর মেদ আর থলথলে বুদ্ধি।
সুচরিতার আগুন মনের বনে লুকিয়ে চুরিয়ে উঁকি দিত রামধনু রঙের শাড়ি
খবরের কাগজ
বিপ্লব…

সতীদাহের আয়োজন হয়েছিল এক সময় তার নামে
তারও আগে রামচন্দ্রের সামনে অগ্নি পরীক্ষা
গুপ্ত কক্ষে লেখাপড়া
ঠোঁটের কোণে হাসি সুচরিতার
পিছন থেকে বড় মেজ সেজ বউ ডাকছে
ভালো করছিস না ন বউ! এমন বেহায়া হওয়া 
রুচিতে বাধবে একদিন দেখিস! 
ওরে তোর ছেলে মেয়েরা যে বড় হচ্ছে রে!

এক পৃথিবী আনন্দের আয়োজন।
মেঘে মেঘে মুহুর্মুহু ঘর বাঁধছে সুখ
ভালোবাসছে রামধনু, গোধূলি এসে মিলে যাচ্ছে 
সন্ধেয়…
মাটির উপর পা রেখে সুচরিতা চিঠি লিখল
গগন কে। 
মাসতুতো দেওর কে কোনোদিন সে ভাই বলেনি
ঠাকুরপো তো নয়ই…

গগন বলেছিল, তুমি স্বয়ংসিদ্ধা।
তোমায় বড় প্রয়োজন আগুন হতে!

ঝড় আসার আগে পৃথিবী গুম হয়ে যায়
সুচরিতাও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে
এক আকাশ আগুন মেঘের নিচে।

একটু পরেই সে ঝড় হয়ে উঠবে।
বড় বউ মেজ বউ সেজ ন বৌদের ঘাড় ধরে
স্বাধীনতায় দেবে মুখ গুঁজে
রঙ চেনাবে…
বেগুনি নীল আকাশী সবুজ…

ছেলে মেয়ে মানুষ করার আগে সব মা মানুষ করতে হবে তাকে!
—-----------––-
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

স্বাধীনতার জন্মদিন

আমার মা বাবাকে হত্যা করেছিল।
মাকে ধরে টানা হ্যাঁচড়া 
আইন আদালত …
যাবজ্জীবন কারাদন্ডের নির্দেশ।

আমি মায়ের গর্ভে বসে বুঝতে পেরেছিলাম হয়ত!
খুব কেঁদেছিলাম…
ভয় পেয়ে ডাক্তার মায়ের জরায়ু চিরে বের করে
এনেছিল আমায়
বলেছিল,
এই নাও তোমার জেল-পরী।

আমার মা বাবাকে হত্যা করেছিল। 

আমার খুব ইচ্ছে করতো খেলতে।
ও মা! খেলবো! বললেই মা আঙুল বাড়িয়ে দিত
ইকির মিকির চামচিকি…
মায়ের হাতে কোথাও কোনো হত্যা করার চিহ্ন দেখিনি কখনো
আদর দেখেছি, স্নেহ দেখেছি,
গোপন কালশিটে স্মৃতি দেখেছি।

রাত নামলেই মায়ের চোখে ভেসে উঠত, মদ্যপ বাবার অত্যাচার।
মায়ের কান্নায় গড়িয়ে পড়ত ঘন কালো মেঘ
আমি চুপচাপ শুয়ে মায়ের চোখের জল গুনতাম।

প্রত্যেক বছর স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় কারাগারে
পতাকা তুলে চকলেট দেয় হাতে।
আমি চকলেট ছুঁড়ে ফেলে দিই!
আমার মা আমার গালে ঠাস করে মারে চড় 
জেলার সাহেব আহাহা করে ওঠেন
ওর কী দোষ রে! জন্ম থেকেই নরকে…

জেলার সাহেব বলেছেন, তোর মায়ের সাজা
শেষের দিকে…
আমিও মায়ের সাথে চোদ্দ বছর পরে আকাশ দেখবো। 
বাতাস এসে আমার গায়ে হাত রাখবে।
মাটি বলবে, নিশ্চিন্তে পা রাখ। আয় বুকে…

আর আমি মাকে লুকিয়ে ঐরকম বাবা খুঁজে বেড়াবো।
মা তো বাবাকে মারতে চায়নি মোটে। 
আমি চোদ্দ বছরে চোদ্দ টা চড় গালে নিয়ে 
হত্যা করবো ওই সব মায়ের পরাধীনতা…
যারা ভয় পায়, জীবন পায় না।

তারপর আসবে পনেরই আগস্ট।
কারাগারের ভিতরে কিম্বা বাইরে পতাকা উড়বে
পতপত করে।
উড়বে সুখ।
কোনো মা সন্তান-গর্ভে প্রবেশ করবে না অন্ধকারে

আমি চিৎকার করে করে ঘোষণা করবো,
জন্মদিন! জন্মদিন! 
আজ স্বাধীনতার জন্মদিন!
—--------–---------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

'জন্ম নেব মাসীর ঘরে, মা গো…'

আমি খুঁজে চলেছি
আমি প্রবল ভাবে খুঁজে চলেছি
কণ্ঠে নীল দাগ, টগবগে হাসি
ফাঁসির মঞ্চে উদাত্ত স্বর…
'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি'

না আমি ক্ষুদিরামকে খুঁজছি না
খুঁজছি তার মাকে।

আমি এক কঠিন প্রাণ মাকে খুঁজছি
যে তার সন্তানের জন্মের পরে তার কানে 
মন্ত্র দেবে, বন্দেমাতরম! 
সাঁতার শেখাবে, ব্যায়াম শেখাবে
স্বপ্ন ভাগ করতে শেখাবে।
আঙুল তুলে দেখিয়ে দেবে ওই দেখো পথ
একা যাও। ছুঁয়ে এস আকাশ।

ফাঁসির মঞ্চে উঠলে সে মা ছুটে আসবে
পরনে শান্ত কান্নার রং, চিবুক দিয়ে গড়িয়ে আসা
গর্ব…
তোকে বিদ্যালয়ে প্রথম হতে বলিনি বাবা
দিয়েছিলাম প্রয়োজনে মৃত্যুতে প্রথম হওয়ার শিক্ষা।
আমার আঁচল পাতা রইল। তুই ফিরলেই আমি
আবার তোকে শিখিয়ে যাবো, জয় হিন্দ! জয় হিন্দ!
জয় হিন্দ!

আমি খুঁজে চলেছি
আমি প্রবল ভাবে খুঁজে চলেছি সেই মাকে।
সন্তান জন্মের পরেই যে উদগ্রীব হয়ে ফাঁসির দাগ
খুঁজবে …
নাম রাখবে ক্ষুদিরাম।

তাকে পেলে কী করবো?

আমার বাগানের শেষ গাছটা মৃত্যুর আগে একটা
ফুল দিয়েছিল। 
তার ইচ্ছে ছিল ভারত মাতার পায়ে রাখি তাকে…

আর একটা ক্ষুদিরামের মা পেলে আমি তার পায়ে
রাখতাম সেই ফুল…

আসলে কী হয়
ক্ষুদিরাম জন্মাতে চায়
তার মা জন্মায় না!
তার মা আর জন্মায় না!
—--------––-
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

বন্যা

নর নারীর বাঁধে বাঁধতে চাও আমায়? 
আকাশ আমায় বৃষ্টি দেয়
প্রবল ঝড় আমায় সাহস দেয়
বাঁধ ভাঙ্গার গান দেয় স্রোত
আমি দুকূল প্লাবিত করে ভাসিয়ে দিয়ে যাই
তোমাদের ঘেরাটোপ, নিয়ম নিষেধ
আমি বন্যা…
প্রচন্ড স্পর্ধার আর এক নাম!

ভাবছো শুধুই ভাঙি? 
গড়ি না কিছুই?

আমার অভিমান থেমে গেলে দেখো
তোমার জন্যই রেখে যাই নরম সরল মাটি
ইচ্ছেমত ফসল ফলাও। স্বপ্ন বাঁধো। চাঁদকে নামাও… 

বন্যার পরে আমার নাম দিয়ে দাও পলি।
—----------------––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

মেহের আলি

মেহের আলিকে হিড়হিড় করে নামানো হল পথে
প্রখর রোদ্দুরে ফেলে টিপে ধরা হল হাত পা
জিজ্ঞেস করা হল, বল! বল তুই এমন কেন করিস?
এর বাড়ির উঠোন থেকে তুলে আনিস চারা
ওর বাড়ির মরা দরজায় আসিস রেখে
যত্র তত্র বিছিয়ে রাখিস ছায়া
কেন করিস? বল শিগগির!

মেহের আলির ঠোঁটের কোণে হাসি।
কোনো উত্তর না পেয়ে তার শরীর কেটে ফেলা হল 
প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আলাদা করে ছড়িয়ে দেওয়া হল
বাতাস এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাদের।
মাটি বুক পেতে দিল।
ঝমঝম করে নেমে এল বৃষ্টি।
তারপর উঠল সূর্য
একটা মেহের আলি থেকে জন্ম নিল হাজার হাজার বৃক্ষ
আলো এসে বলে গেল উৎসব হবে উৎসব
ক্লান্ত প্রাণ এসে শান্ত মায়ায় গাইবে গান
গড়িয়ে পড়বে স্নেহ। লুটিয়ে পড়বে আনন্দ
ছিন্ন ভিন্ন হবে দূষণ, শোষণ। 
মেহের আলির পাগলা হাসি আকাশ ছুঁয়ে ফিরে এল
সে উৎসবের নাম কী হবে?
বনমহোৎসব? সবুজ গান? 
আরো অনেক জোরে হেসে উঠলো মেহের।

মেহের আলি পাগল। চোয়াল ভেঙে রক্ত চুঁইয়ে পড়লেও সে স্বপ্ন দেখতে পারে…
মৃতদেহে শ্বাস বসানোর অপরাধে 
মৃত হয়েও আওয়াজ দিয়ে শূন্য চিরতে পারে
উৎসব হবে! উৎসব!
শুনছো তোমরা…
–––---------–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

উৎসব

অরণ্য কেটে ফেলা হল।
প্যান্ডেল বাঁধা হল।
গলগল করে লোকজন ঢুকলো সেই প্যান্ডেলের ভিতর
সামনের চেয়ারে বসা বিশিষ্ট পরিবেশ প্রেমীর হাতে
তুলে দেওয়া হল মাইক্রোফোন…
বন্ধুগণ! আমাদের জীবনে বৃক্ষের গুরুত্ব অসীম
ঠিক ওই আকাশের মত…

কচি প্রাণ ছিল এক। খিলখিল করে হেসে উঠে
বললো, কিন্তু আকাশ তো নীল!
গাছ যে সবুজ রঙের গান গায়! আমি শুনেছি…

এত স্পর্ধা শিশুর!

মাইক্রোফোন চলতে শুরু করলো। লোকের কথায় 
কান দেবেন না। গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান।
উপস্থিত সম্মানিত অতিথিদের হাতে তুলে দেওয়া হল
মোসান্ডার চারা…

মাধবী ভালোবেসেছিল বাতাবিকে।
নাম রেখেছিল আলো
বাতাবি তাকে ঊষা বলে ডাকতো।

বনোমহৎসব করতে গিয়ে ও দুটোই গিয়ে পড়েছে
রাস্তার ওই পারে।
চেতনা হারানোর আগে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরেছে
প্রার্থনা করেছে, পরের জন্মে মানুষের বুকে জন্ম নেবে
নাম নেবে, বোধ
নইলে প্রতিশোধ…

ভাষণ শেষ। খাওয়া দাওয়া শেষ। অনুষ্ঠান শেষ।

শিশুটি ধীরে ধীরে প্যান্ডেল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

পায়ে পায়ে মাটি খুঁড়লো।
প্রবেশ করলো তার ভিতরে।
শিকড় গজালো। শাখা প্রশাখা
সূর্য এসে তাপ দিলো, বাতাস শ্বাস।
শিশুটার সারা শরীরের সব পাতায় শুরু হল
সালোকসংশ্লেষ…

গলগল করে লোকজন ছুটে এল।
পরিবেশ প্রেমীর মাইক্রোফোন ভেঙে গেল।
ফিসফিস করে বললো…
সে কী! শিশুটির এমন সাহস!
সভ্যতার উয়ন্নয়নের বিপরীতে যায়!

শিশুটির পিতা কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠলো
শুনুন!
একে বলে বৃক্ষরোপন!
একে বলে উৎসব!
—-------------–--
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

আহির ভৈরব ও কসাই

মাংসের গামলায় দু ফোঁটা জল পড়ে ছেলেটার চোখ থেকে
বিক্রি শেষ হলে দুটো হাত রগড়ে ধুয়ে নেয় সে।
তারপর মাটি থেকে তার গামছায় কুড়িয়ে নেয় বরষার হীরে
সজনে পাতা ছিঁড়ে নিয়ে বাড়ি ফেরে ছেলেটা।

রোজ সকালে কসাইয়ের ছেলেটা মুরগির দোকানে
এসে তাদের গায়ে হাত রাখে। 
কানের কাছে মুখ নামিয়ে শোনায় আহির ভৈরব
মুরগিরা শান্ত হয়। ঘুমিয়ে পড়ে। 
ছুরির আঘাতেও আর্তনাদ ওঠে না…
নীরব মাংসের গামলায় ছেলেটির অশ্রু পড়ে দু ফোঁটা

মল্লিকা বললো, তুই একটা কসাই। তোকে ভালোবাসবো আমি?
ছেলেটা নিশ্চুপ।
ফুসফুসে কিছুটা বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে গিয়েছিল সে মেয়েটির জন্য
আছড়ে ফেললো মাটিতে।

ছেলেটার বৃদ্ধ অথর্ব বাবা মারা গেল।
গোধূলি লগ্নে সুপাত্রে মল্লিকার বিয়ে
ছেলেটির দোকানের সব মুরগি যাবে সেই বিয়েতে
খাদ্য হয়ে…
ছেলেটি খাঁচার পাল্লা খুলে গড়িয়ে দিল সুর…
আরোহ অবরোহে ধুয়ে গেল তাদের আর্তনাদ।
মাংসের গামলার উপর ছেলেটা আলো রাখলো একমুঠো
লিখে দিল, গোধূলির পরে রাত্রি নামবে যখন
এ আলো মেখে নিও।

'আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে…'
মাটি চিরে চিরে ছেলেটার পায়ের ছাপ চলে গেল
দূরে…

এখানে উইয়ের ঢিবির নিচে একটা মাংসের দোকান ছিল
ছেলেটা সুর দিয়ে মুরগি ভিজিয়ে মাংস করতো।
একটুও আর্তনাদ হত না।
ওরাও ছেলেটাকে ভালোবাসতো।
শুধু আমিই…
মল্লিকার হাতে সত্তুরে লাঠি।
কথাগুলো শেষ করেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
—----------------––-
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)