চৈত্র মাসের বিকেল বুঝি হবে।
নদীর ঘাটে উপুড় হওয়া কালো,
মুসলমানী গা ধুতে যেই নামবে…
অমনি গল্প ভেসে এল।
আঁচল দিয়ে তুলে নিল মেয়ে,
খুশিতে মুখ ডগমগ।
"হাঁ, ঠিক বটে, ই'ও তো অজ্ঞান অখনো!"
ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলে গল্পখানা সে।
গল্প মানে নধর দেহখানি,
বোজা দু চোখ, কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া
অসুখ।
মুসলমানীর কান্না ছাপায় ঝড়ের গতিবেগে...
"ওরে, আমার ঘরে লালন আলি রে?
ওরে, লালন পাইছি আমি…"
দু চার দিনের পরে জ্ঞান এল সেই শরীরখানায়।
না এসে বা যায় কোথায়?
এত সেবা সে মায়ের…
জ্ঞান আসতেই চিবুক ধরে তার,
"হাঁ রে বাপ মনে নাই তো ত'র?
কুথা থাকে আসছিস?
তু কে বটিস?"
এদিক ওদিক চেয়ে সে পুরুষ বলে,
"সত্যিকারের কিছুই মনে পড়ছে না যে মা!"
"মা ডাকিলি? ওরে বাপ তু মা ডাকিলি?
আমি তোরে মনে পড়াই দিছি…
তুর নাম লালন বটি, তুর সোঙ্গী সাথীরাই তুকে
মরা মনে করি নদীতে ভাসায় চলি গেছে
ইরপর তু গাঁয়ে ফিরে যাবি সব মনে পৈরলে।
তুকে ঘরে লেবে না বাপ উরা।
বলবে, মোচলমানের পানি খেয়েছিস
যা ফিরে যা!
তু ফিরে কুত গান লিখবি…
সব লুকে কয় লালন কী জাত সুংসারে
লালন বোলে জাতের কী রূপ দ্যখলম না
এ নোজরে…
মনে পোড়ছে বাপধন?"
পুরুষটি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
ঘুমিয়ে পড়ে।
মুসলমানী তার দুহাত ধরে নাড়ায়, জাগায়
"ও বাপ...আমায় ভুলবিনি তো?
ও বাপ!"
মাস খানেক গল্পটা হু হু করে বেড়ে চলে
মুসনমানীর দাওয়ায়, শুশ্রষায়।
তারপর একদিন ঘুম ভেঙে উঠে সেই মায়ের
সেই লালন চিৎকার করে ওঠে,
"মনে পড়েছে!
মনে পড়েছে! ওহে...মুসলমানী! আমার মনে
পড়েছে!"
মুসলমানী বুকে জড়িয়ে ধরতে চায় তার গল্পকে।
সে তখন তার হাত ঝিনকে বলে,
"ব্যাটারা… আমায় ফাঁকি দিয়ে লাভের গুড় খাবি!
দাঁড়া, আমি আসছি!"
"তু লালন হবি না, বাপ?"
গল্প তখন মুসলমানী মা।
"লালন হবে তোর দাদু…
কত কষ্টে খালাস করলাম মালটাকে
আর আমার মাথায় মেরে ওরা...
আসছি আমি… আসছি!"
মুসলমানী বৃদ্ধ হাতে পায়ে হামাগুড়ি দেয়।
নদীর জলে কান পাতে।
চোখে তখন ভরপুর বর্ষা…
"দি'লি যদি, ফিরাই নিলি কেন রে মা?"
হাসতে হাসতে গেয়ে উঠল স্রোত,
"সব লোকে কয় লালন কোথায় সংসারে?
নদী বলে, মা তো আছে!
নদী বলে, মা তো আছে… জন্ম নেয় না
লালন রে!
সব লোকে কয়…।"
---------------------
Sujata Mishra
No comments:
Post a Comment