আট দিনের পরে

-চলো কোথায় নিয়ে যাবে এবার।

-আমার হাতে বসো।

-ধোঁয়ার হাতে ধোঁয়া?

-মেঘের বুকে মেঘ।

-তাই তো ভাবি একলা কেন থাকি!

- এখনও অনেক যে রয়ে আছে বাকি!

-অনেক দিনের ইচ্ছে, আমার এই মরুদ্যান

নিয়ে কখনও লিখলে না, কবি!

- এবার লিখব। মরুদ্যান নিয়ে, আলো নিয়ে…

- কী দিয়ে লিখবে?

- বাতাস দিয়ে।

- দেখতে পাবে পৃথিবী?

- শুনতে পাবে।

- নিজের নিজের বুকে কান পাতলেই শুনবে। -সবার বুকেই মরুদ্যান থাকে?

-থাকে তো!

-আমার কপালে তোমার ঠোঁট এঁকে দাও।

- তোমার হৃদয় ছুঁয়ে আছে আমার হৃদয়।

- এই শোনো! ওই দেখ, আমাদের বইয়ের ঘরটায়

একটা মাকড়শা এর মধ্যেই...ওদের একটু নিষেধ দাও না!

- ভালো করে চেয়ে দেখ, একটা নয়, দুজন। ওরাই এখন থেকে ওখানে বসুক, ভালোবাসুক। 

-একজন আগে চলে গেলে তোমার মতই অপরজনকে ডেকে নিক এভাবেই…

এই শোনো! মেঘেদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে 

আবার নাওয়া খাওয়া ভুলো না!

- হা হা হা! এখন তো শুধু ভালোবাসা খাওয়া, বৃষ্টি নাওয়া…

একবার নীচের দিকে তাকাও। 

মানুষগুলো দেখতে পাচ্ছ? এবার ওদের ভিতরে তাকাও। ওদের স্বার্থ, হিংসা, মনখারাপ দেখতে তোমার কি আর চশমা লাগছে?

- ওই বাতাস এল। তুমি কবিতা বোনো। আমি তোমার ধোঁয়া পিঠে ঠেস দিয়ে বসি।

______________

Sujata Mishra

একশ মানিক


আপনার অপু হাসতে ভুলে গেছে মানিকবাবু!

ফেলুদা ভীষণ ব্যস্ত রাজনীতি সামলাতে।

প্রফেসর আটকে গেছেন ভার্চুয়ালে।

শেষ যে শিরদাঁড়া ঋজু সরলরেখা বরাবর

ছুটে যেতে পারত, তার নাম ছিল সত্যজিৎ রায়।



আপনার সুর বাজে মাঝে মধ্যে বেতার তরঙ্গে।

আম আঁটির ভেঁপু খুলে পুরাতন সুবাস

নিই যখন, আপনার প্রচ্ছদ ছুঁয়ে নিই কখনও

কখনও…


আপনার একটা ছবি আমাদের বাড়িতে আছে।

আমার জ্যাঠামশাই আপনার গুণগ্রাহী ছিলেন।

উনি বলতেন, অতি উচ্চতায় কেমন করে সোজা

চলতে হয়… তা শিখতে হয় মানিক বাবুর কাছে!


আমি একলা ঘরে আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে

থাকি,

আপনি ফটো ফ্রেম ছেড়ে নেমে এসে আমার কাঁধে

হাত রাখেন, বলেন…

পরিবর্তনই সভ্যতা! এমন মনখারাপ করছ কেন?

আমি চুপ থেকে আপনার পা ছুঁয়ে আপনাকে

ফটো ফ্রেমে ফেরত পাঠাই।

তারপর আমার বাঁকা শিরদাঁড়ায় ভর দিয়ে

হেঁটে যাই বক্র রেখায়।


এখন আমাদের বিছানায়, বালিশে, স্বভাবে

অভাবেও বিনোদন। সভ্যতার ঝড় প্রতি মুহূর্তে।

আপনার অপুর বড় বড় দুই চোখে কৌতুহল নেই মাত্র…

শাখা প্রশাখায় ভাঙন বড় তীব্র।

মানিকবাবু, আমরা ভালো নেই!


আমরা ছুটতে জানি!

আমরা চিৎকার করতে জানি!

আমরা ভয়ে কুঁকড়ে যেতে জানি!

আমরা দেশের বুকে দ্বেষের জন্ম দিতে জানি!



রাতের আকাশে রোজ একশ মানিক জ্বেলে রাখেন আপনি।

নকল আলো সরিয়ে আমরা তা দেখতে জানি না!

--------------

Sujata Mishra

সব লোকে কয়

চৈত্র মাসের বিকেল বুঝি হবে।

নদীর ঘাটে উপুড় হওয়া কালো,

মুসলমানী গা ধুতে যেই নামবে…

অমনি গল্প ভেসে এল।


আঁচল দিয়ে তুলে নিল মেয়ে,

খুশিতে মুখ ডগমগ।

"হাঁ, ঠিক বটে, ই'ও তো অজ্ঞান অখনো!"

ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলে গল্পখানা সে।

গল্প মানে নধর দেহখানি,

বোজা দু চোখ, কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া

অসুখ।

মুসলমানীর কান্না ছাপায় ঝড়ের গতিবেগে...

"ওরে, আমার ঘরে লালন আলি রে?

ওরে, লালন পাইছি আমি…"


দু চার দিনের পরে জ্ঞান এল সেই শরীরখানায়।

না এসে বা যায় কোথায়?

এত সেবা সে মায়ের…

জ্ঞান আসতেই চিবুক ধরে তার, 

"হাঁ রে বাপ মনে নাই তো ত'র?

কুথা থাকে আসছিস?

তু কে বটিস?"

এদিক ওদিক চেয়ে সে পুরুষ বলে, 

"সত্যিকারের কিছুই মনে পড়ছে না যে মা!"

"মা ডাকিলি? ওরে বাপ তু মা ডাকিলি?

আমি তোরে মনে পড়াই দিছি…

তুর নাম লালন বটি, তুর সোঙ্গী সাথীরাই তুকে

মরা মনে করি নদীতে ভাসায় চলি গেছে

ইরপর তু গাঁয়ে ফিরে যাবি সব মনে পৈরলে।

তুকে ঘরে লেবে না বাপ উরা।

বলবে, মোচলমানের পানি খেয়েছিস

যা ফিরে যা!

তু ফিরে কুত গান লিখবি…

সব লুকে কয় লালন কী জাত সুংসারে

লালন বোলে জাতের কী রূপ দ্যখলম না

এ নোজরে…

মনে পোড়ছে বাপধন?"


পুরুষটি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে

ঘুমিয়ে পড়ে।

মুসলমানী তার দুহাত ধরে নাড়ায়, জাগায়

"ও বাপ...আমায় ভুলবিনি তো?

ও বাপ!"


মাস খানেক গল্পটা হু হু করে বেড়ে চলে

মুসনমানীর দাওয়ায়, শুশ্রষায়।


তারপর একদিন ঘুম ভেঙে উঠে সেই মায়ের

সেই লালন চিৎকার করে ওঠে, 

"মনে পড়েছে!

মনে পড়েছে! ওহে...মুসলমানী! আমার মনে

পড়েছে!"


মুসলমানী বুকে জড়িয়ে ধরতে চায় তার গল্পকে।

সে তখন তার হাত ঝিনকে বলে, 

"ব্যাটারা… আমায় ফাঁকি দিয়ে লাভের গুড় খাবি!

দাঁড়া, আমি আসছি!"


"তু লালন হবি না, বাপ?"

গল্প তখন মুসলমানী মা।


"লালন হবে তোর দাদু…

কত কষ্টে খালাস করলাম মালটাকে

আর আমার মাথায় মেরে ওরা...

আসছি আমি… আসছি!"


মুসলমানী বৃদ্ধ হাতে পায়ে হামাগুড়ি দেয়।

নদীর জলে কান পাতে।

চোখে তখন ভরপুর বর্ষা…

"দি'লি যদি, ফিরাই নিলি কেন রে মা?"


হাসতে হাসতে গেয়ে উঠল স্রোত,

"সব লোকে কয় লালন কোথায় সংসারে?

নদী বলে, মা তো আছে!

নদী বলে, মা তো আছে… জন্ম নেয় না 

লালন রে!

সব লোকে কয়…।"

---------------------

Sujata Mishra

দেশ বাঁধে

এলোচুলের মেয়েটা চুল বাঁধেনি,

গাছ বাঁধছে গর্ভে…


নদীর ধারে গড়িয়ে পড়ছে রাত।

ছপাত ছপাত জল কেটে এগিয়ে এসে

বলছে, এই কন্যা! সন্ধে নামল

গা ধোওনি, বেণী বাঁধোনি! এলিয়ে আছো পা!

আচ্ছা তাই সই, কান্না ঝরাও তবে!


এলোচুলের মেয়েটা বৃষ্টি ভুলে

চোখে আগুন জ্বালে।


জল ভেসে যায় রাতের দুয়ার খুলে।

ঘুমিয়ে গেছে ছিন্ন মূল,

মাটির গর্ভে বুকের বীজ রেখে।

এলোচুলের মেয়েটা কাঁদতে জানে না,

চোখের থেকে ঠিকরে আসে তাপ,

আগ-স্যালুট দেয় ঘুমন্ত মূল তীরে।


সে মেয়েটা ঘাস বোনে, বাস বোনে।

ভাতে ফোটায় গনগনে খুব তেজ।

সে মেয়েটা গর্ভে বাঁধছে গাছ…

নাম রাখবে ঝড়।


রাত ভেঙে ভেসে যাবে জল।

এলোচুলের মেয়েটা বুকে বাঁধবে জোয়ার।

তুফান এসে বলে যাবে, কন্যা! তোমার পুত্র

বাপের মত বীর! 


এলোচুলের মেয়েটা তাই গান বাঁধে না আঁচলে,

দেশ বাঁধে…

--------------

Sujata Mishra


একাদশীর পত্র

প্রিয় 

    ঠাকুর, ছেলেবেলায় বীরেন কাকা লিখতে শিখিয়েছিল তাই তোমাকে এই চিঠি লিখতে পারছি নইলে কিছুতেই আমার কথা বোঝাতে পারতাম না হয়ত। জন্মেই তো মাকে খেয়েছি আর আমার বাবা যে কে, তা কেউই জানে না…


এর কাঁধে, তার ট্যাঁকে আমার ছেলেবেলা ভালোই কেটেছিল। দু পয়সার লজেন্চুস আর ভিক্ষের পাত্রে দয়া, মন্দ কী?

সন্ধে হলেই বীরেন কাকা স্লেটের উপর পেন্সিল ঠেকিয়ে লিখত, তোর নাম একাদশী…

বীরেন কাকা লিখত, লেখাপড়ায় তোর খুব ভালো মাথা, একদিন অনেক কিছু শিখবি… কিন্তু তোকে শেখাবে কে? আমি তো অত জানি না।


আমি ভিকারী মায়ের মূক বধির একাদশী। আমায় শেখাতে শেখাতে বীরেন কাকার স্লেটও একদিন ধোঁয়া হয়ে গেল। আমার ভাঙা প্লেটে ছিটকে এল করুণা আর ধিক্কার…


খুচরোগুলো কুড়িয়ে রাখতে রাখতে আমার বয়স হয়ে গেল কুড়ি বাইশ বত্রিশ…


 না গো ঠাকুর, আমার কোনো অভিযোগ নেই। শুধু একটা আর্জি…


ডাস্টবিনের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় কদিন আগে প্লাস্টিকে মোড়া এক প্রাণ দেখতে পেলাম, জানো?

খুব করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আনন্দে আমার চোখ মুখ ঠোঁট কেঁপে উঠল। চুমো খেলাম সেই প্রাণের হাসিতে। সে তখন আমার কোলের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে কী সুন্দর হাসছিল! আমি হৃদয় দিয়ে, দুচোখ দিয়ে সেই হাসি শুনছিলাম। আমার সারা শরীর নেচে উঠছিল...ওহ কী সুন্দর সেই সুর!

মনে হচ্ছিল, আমি বধির নই! আমি মূক নই!

আমি সব শুনতে পাচ্ছি, আদরের ভাষা বলতে পারছি...পৃথিবীর সব চাইতে সুখী তখন এই একাদশী।

বীরেন কাকা আমায় একটা বাঁশি দিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল...শুনতে না পেলেও এর সুর একদিন তুই ঠিক বুঝবি! আমি সেই বাঁশি নিয়ে কতরকম করে বাজালাম। ও হাসল, হাত পা ছুঁড়ল… আমার গলা জড়িয়ে ধরল।


তারপর কে যে কী খবর দিয়ে এল পুলিশকে!


ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল আমার কোল থেকে ওরা!

হেঁচকা টানে ছুঁড়ে ফেলে দিল আমার সুখ, ইশারায় বুঝিয়ে দিল, এ হয়না! নিয়ম নেই…


একাদশী খুব কাঁদছে ঠাকুর! একাদশীর বুক ফেটে যাচ্ছে! ওরা কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে তার পৃথিবী, তার সূর্য...


আমার একটা আর্জি আছে ঠাকুর…

না না আমি আমার কণ্ঠ, শ্রবণ কিছুই চাইনা…

আমি যে আমার ছিন্ন প্রাণের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি!


কেবল ওদের অক্ষম ইন্দ্রিয়গুলো সক্ষম করে দাও! ওরা যে দেখতেও পায়না, শুনতেও পায়না! কেবল ওদের চক্ষু কর্ণ দাও ঠাকুর! ওরা যেন আমার কান্না শুনতে পায়...আমার দীর্ণ হৃদয় দেখতে পায়! 


ঠাকুর, ওদের দৃষ্টিশক্তি দাও!

ঠাকুর, ওদের শ্রবণ শক্তি দাও!

একাদশীর কান্না যেন ওদের ইন্দ্রিয় ছুঁতে পারে!

ঠাকুর…

                                   ইতি

                                  একাদশী

----------------

Sujata Mishra


নিষিদ্ধ প্রেম

বেশ মিষ্টি গন্ধ দিচ্ছ তো আমায়!

কী, এত ভালোবাসা কেন আজ?

ও, আজ আমার গায়ের চাবুকের দাগগুলো

তোমায় খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে বুঝি!


এই চুপ চুপ! ওরা আসছে!

চুপ করো… চুপ করো!

গন্ধ বন্ধ করো তোমার!

নইলে ওরা আমার নীলের মত তোমাকেও

কুচি কুচি করে ফেলবে!

ওরা সর্বভূক! 

মাছ মাংস, রক্ত, কান্না...ওরা সব খায়!


কী হল! চুপ করে আছো যে?

ওরা অনেকক্ষন আগে চলে গেছে।

ও নীলের কথায় মনখারাপ হল তোমার?

না, না মনখারাপ তো নয়! 

ও এর নাম বুঝি দুঃখ? 

হুঁ, ঠিক ধরেছি...

এইতো তোমার গন্ধ ভেজা ভেজা লাগছে।

নীলকে তো তুমি চেনো না

তাও এত কষ্ট পাও?

আমারও যে বুকটা ফেটে যায় গো!

নীল খুব চিৎকার করেছিল জানো...

বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও!

আমিও আমার খাঁচা ভেঙে ছুটেছিলাম

এদিক সেদিক...কে আছো

আমার নীলকে বাঁচাও!

কেউ আসেনি। সবাই হেসেছে।

আমার দাদা আমার মাথায় রডের ঘা

দিয়ে সেদিন বলেছিল, তুই আমাদের

চোদ্দ পুরুষের পাপ, শালা পাগল!


আমি পাগল?

আমি আমার নীলকে ভালোবাসতাম,

আমি ওর সঙ্গে গল্প করতাম,

ওর কপালে ঠোঁট দিয়ে স্নেহ আঁকতাম...

ও আমায় শেখাত, কুড়ি হার্জের নীচের

শব্দ কেমন করে শুনতে হয়

কেমন করে আলো বুনে শ্বাস নিতে হয়

কেমন করে গন্ধ চিনে গাছ হতে হয়…।

আমি ওর শক্ত বুকে পিঠ রাখলেই

ও হেসে বলত, কি, পিঠ চুলকে দেব?



দাঁড়াও! দাঁড়াও ! থামো ওরা আবার আসছে

ওরা রোজ এসময় আমার খাবারে একটু একটু করে বিষ মিশিয়ে দিতে আসে।

ওরা আসছে! চুপ করো!

গন্ধ বন্ধ করো!

ওরা আসছে!


এই, কী দেখছ অমন করে?

আজ আকাশে কেমন চাঁদ উঠেছে

দেখেছ?

কী বলছ? জেনে শুনে আমি এ বিষ

কেন খাই?

তুমি বুঝি জানো না!

নীল চলে যাওয়ার পরে তুমিই তো আমার বন্ধু হলে!

তোমার কাছে যেতে পারি না জানি

তবু দূর থেকে তোমায় দেখতে পারি।

শুনতে পারি।

ভালোবাসতে পারি।


আমাকে বিষ দিতে দিতে ওরা একদিন

ক্লান্ত হয়ে যাবে

তবু ওরা তোমায় খুঁজে পাবে না!


ওরা আমায় পাগল বললেও তুমি তো জানো

আমি পাগল নই!

আসলে আমি সুস্থ, ওরা পাগল!

হ্যাঁ, ওরা পাগল! ওরা পাগল…

ওরা হানাহানি করে

স্বার্থ অর্থ বর্ণ বিদ্বেষে...

পাগল না হলে প্রকৃতির এত রূপ রস গন্ধ থাকতে

এসব তাচ্ছিল্য নিয়ে কেউ লড়াই করে?


চুপিচুপি একটা কথা বলি শোনো…

আমি কি ঠিক করেছি জানো?

ওরা যেদিন হারিয়ে যাবে ইঁট কাঠ আর স্বার্থের জঙ্গলে,

সেদিন তুমি আমি নীল মিলে

একটা নতুন পৃথিবী বানাবো।

সবুজ হবে তার রঙ

গন্ধ হবে আলো।

আর আমি হব পাঠশালার মাস্টারমশাই,

সবাইকে শেখাব…

কী করে কুড়ি হার্জের নীচের শব্দ শুনতে হয়…

কী করে গন্ধ শিখে ভালোবাসতে হয়…


এই, এই, চুপ করো! চুপ করো! সকাল হল!

ওরা চাবুক নিয়ে আসছে! 



তুমি কিন্তু সবুজ পৃথিবী ভুলো না বন্ধু…

-------------

Sujata Mishra

দ্বিতীয় জন্ম

 তার জন্মের সময় কোনো শাঁখ বাজেনি।

উলু ধ্বনিতে মুখরিত হয়নি কোনো শাশুড়ির

মুখ,

বরং গালিগালাজ উঠেছে আঁতুরের সামনে 

বাসনে কোসনে, অভিশাপে, আফসোসে।

তার এমন কোনো পিতা ছিল না,

যে তার মুখ দেখে বলবে, "আমার লক্ষ্মী!"

তার এমন কোনো পড়শী ছিল না 

যে গালি গালাজের মুখ আটকে দাঁড়াবে,

"বলি...মেয়েরা মানুষ নয়?"


তার এমন কোনো উপায় ছিল না,

সে যে পথে এসেছে …

সেই পথেই ফিরে যাবে!

তার মায়ের প্রতি ছিল শাসন,

"খবরদার যদি পরের বারেও মেয়ে হয়!

ঘাড় ধরে দূর করে দেব বাড়ি থেকে!"


বছর পাঁচেক পরে তার এমন কোনো দিন ছিল না,

যেদিন তার মায়ের সৌভাগ্যদায়ক 

অতি আদরের পুত্র

তার উপর চড়াও হয়ে গাল আঁচড়ে

চুল ছিঁড়ে পার্থক্য বুঝিয়ে দিত না।


অবশেষে তার পিতা বুঝলেন, মেয়ের বয়স হয়েছে যথেষ্ট। অতএব অর্ধ-বৃদ্ধ মদ্যপ পাত্রে বিবাহ বাঞ্ছনীয়।


তার জেদ এমন কম ছিল না, যে তার

পিতা জোর করে তাকে সেই বিবাহে বসায়।


সে ধিক্কার দিল পিতাকে।

সে ধিক্কার দিল অসহায় মায়ের নীরবতাকে।

সে ছুটল...

সে পালাল।

সে এক নারীজন্মের পরিবর্তন লিখতে চাইল।


হায়না পুরুষ, শেয়াল পুরুষ, খাদক পুরুষ

সব পেরিয়ে সে এসে পৌঁছাল 

অন্য পুরুষে।

কী বলিষ্ঠ তার বুকের পাটা!

জোর গলায় বলত তাকে, "এ ইঁট ভাটায় 

তোকে কাজ করতে দেব না রে আমি!

তোকে বিয়ে করে আমার রানী করে রাখব।"


তার সিঁথি রাঙিয়ে দিল সে পুরুষ।

সানাই বাজল, আলো জ্বলল। কত লোকের 

পাতে মাছ পড়ল…


তার শরীরে শরীর মেলাল পুরুষ।

সে জিজ্ঞেস করল, "কী চাস?"

তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ উত্তর দিল, "তোর মত লক্ষ্মী।"


তার লক্ষ্মী জন্ম নিল। শাঁখ বাজল, উলুধ্বনি উঠল।

উঠোনে গড়াগড়ি খেল রোদ।

তার সামনে মেয়েকে তুলে ধরল তার পুরুষ,

"দেখ দেখ এ ঠিক তোর জন্ম হয়েছে রে!"


সে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, "মরণ ছাড়াও

দ্বিতীয় জন্ম হয়!"

------------------

Sujata Mishra

শুরুর আগে সুর

অমিত একদিন মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করে ফেলল প্রাক-ইতিহাস। বিশাল এক গুহা।

কিন্তু গুহার ভিতরে কোথাও অন্ধকার নেই! মাটি সরিয়ে গুহার দ্বারে অমিত হাত বাড়াল। চিৎকার করে বলল, উঠে এস লাবণ্য! 


ধূপের গন্ধ, প্রদীপের শিখা একত্রিত হয়ে উত্তর ভেসে এল...পুজো করছি তো! 

বিস্মিত অমিত আরও খুঁড়ল, খুঁড়তে খুঁড়তে একেবারে গুহার দ্বারে পৌঁছে গেল। কপালের ভাঁজে প্রশ্ন, এই আদিমতায় যেখানে আগুনের জন্মই হয়নি, সেখানে রবীন্দ্রনাথ পুজো করছ তুমি, লাবণ্য? 


লাবণ্য মুচকি হাসল। সুর ভিজিয়ে কন্ঠে রাখল তার। তারপর চোখ বুজল। দু এক পশলা মাটির বৃষ্টি নেমে এল তার মাথায়। ধীরে ধীরে গান সরিয়ে উত্তর দিল, যাঁর জন্মের এত বছর পরেও

এমন করে জন্মদিন পালন করা হয়…

তাঁকে তাঁর জন্মের আগে আরাধনা করতে হবে না? সৃষ্টির সূচনা থেকেই আমি রবীন্দ্রনাথের বীজ পুঁতে দিলাম মাটিতে। পৃথিবীর আয়ু যত বাড়বে…

রবীন্দ্রনাথও বেড়ে যাবে। 


পুজো শেষ করে লাবণ্য অমিতের হাত ধরে উঠে এল শেষের কবিতায়।

---------------

Sujata Mishra

গর্বিত

আমি বিশ্বনাথ, ইরাবতীর গর্বিত স্বামী।

যে মানুষ নিজের গর্ভে সৃষ্টি করে অন্য

মানুষ… সে আমার কাছে ঈশ্বরী।


আমি বিশ্বনাথ, ঈশ্বরীর গর্বিত স্বামী।


যেদিন ইরা'কে তুলে নিয়ে গিয়েছিল 

আমারই মত আকার বিশিষ্ট পুরুষ,

খান খান করে দিয়েছিল যেদিন ওর শরীর,

উরু চিরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল বাণী;

নারী তা সে যতই কোমল হও

ছোট্ট শূন্যে ভরাট করো যন্ত্রণা…


হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা,

ভারত থেকে ইউরোপ, 

ইউরোপ থেকে আফ্রিকা,

আফ্রিকা পেরিয়ে আন্টারটিকা,

ইরাবতীরা ছটফট করে ওঠে,

কান্নায় ভেঙে পড়ে,

গনগনে আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে,

শ্বাস রোধ করে কন্ঠ ছাড়ে, 

কে নেবে এ ধর্ষণ-ফসলের দায়?

আমার মৃত্যু ভালো!


আমি বিশ্বনাথ,

হাত পেতে সামনে দাঁড়াই তার

আমায় দেবে গো মেয়ে?

সে বিস্মিত হয়। কী আছে বাকি আর?

গর্ভে যে জারজ…,

থমকে দিই কথা তার 

ছি! ও যে নতুন পৃথিবী!

আমায় দাও!


যে মানুষ গর্ভে নতুন মানুষ সৃষ্টি করে

সেই তো ঈশ্বরী!

আমি ঈশ্বরীর গর্বিত স্বামী।


ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছে আমাদের পুত্র।

নাম রেখেছি মানব।

পাঠ দিয়েছি...ন এ নারী,

ঈ এ ঈশ্বরী।

--------------

Sujata Mishra