অন্য প্রণাম

পাড়ার পুজো মণ্ডপে এবার দারুণ এক ঘটনা ঘটল।
সেজেগুজে নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পরে নবীন বাবু
প্রণাম করতে এলেন দশভূজার মূর্তিতে। চোখ বন্ধ করে প্রণাম শেষ করতেই মায়ের মুখে দেখলেন নিজের স্ত্রীর মুখ। তাঁর স্ত্রী! যাকে প্রতিদিন দু এক ঘা না দিলে নবীন বাবুর হাত নিশপিশ করে সেই বোকা মেয়ে মানুষ? বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে এলেন মন্ডপ থেকে। 

কিছু পরে এলেন বিনোদ বাবু। তিনি তাঁর মাকে রেখে এসেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। দশভূজার চরণে মাথা ঠেকাতেই মন্ডপ হয়ে গেল বৃদ্ধাশ্রম। তাঁর মা হাসছেন, পায়ের উপর বিনোদ বাবুর মাথা। মা বলছেন, ভালো থাক বাবা। ভালো থাক।
বিনোদ বাবুর চোখে জল, এক ছুটে বেরিয়ে আসেন মন্ডপ থেকে। স্ত্রীকে বলেন, তুমি চাও না চাও আমার মা আমার সঙ্গেই থাকবে।

অমিত ভুলে গেছে সীমা কে। বড়লোক বাবার মেয়ে যখন তার হবু পাত্রী তখন গরীবের সীমা কেন? মা দুর্গার মুখে তখন সীমার মুখ। অমিত ডেকে আনে তার বাবা মাকে। তারাও দেখে মা দুর্গার মুখে সীমা বসে আছে। চোখের ভিতর মায়ার ঘর। অমিত কি ভুল বুঝতে আর দেরি করে? সীমা যদি না আসতে চায় আর! তার বাবা মা ভাবে।

মন্ডপে ভিড় উপচে পড়ছে। এ কেমন কথা? সবাই তার অন্যায় দেখতে পাচ্ছে। তাদের পায়ে মাড়ানো ঘাস মাথায় নিয়ে বেরিয়ে আসছে মন্ডপ থেকে।

একটি ছোট্ট ছেলে তার বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে, ও বাবা! মা দুর্গার গায়ের শাড়িটা কেমন ছেঁড়া দেখো! ঠিক আমাদের আয়া মাসীর মতন…
এবার পুজোয় আয়া মাসীর নতুন শাড়ি হতে আর কি দেরি হয়? 

একটা কালশিটে মাখা মুখ ছুটে আসে হঠাৎ। মনে হয় দেবী মার কাছে এসে সে উগড়ে দেবে তার যন্ত্রণা, জিজ্ঞেস করবে কেন মা? কেন রক্তাক্ত হই প্রতিদিন? কেন এমন অবিচার তোমার? 
প্রবেশ করে মন্ডপে সে। দশভূজা তাকিয়ে আছেন তার দিকে। আচম্বিতে রক্ত ঝরা বধূটির কান্না থেমে যায়।
দেবী মার মূর্তিটা কেমন যেন তার মত দেখতে হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তার মত গালে গলায় রক্তের দাগ, কালশিটে। তবে এ কী! দেবীর চোখে তো কান্না নেই! এক ভয়ঙ্কর আগুন জ্বলছে যেন! দেবীর দশ হাত লুপ্ত হয়ে মাত্র দুই হাত, ঠিক তার মতই শাঁখা পলা পরা। দুই হাতে কী প্রবল এক আগুন ধরা! মনে হচ্ছে এখনি ভস্ম করে দেবে সবকিছু, সব অন্যায়! সব দুঃখ… 
বধূ টি নিজেকে এমন ভাবে কোনোদিন তো দেখেনি! 
নিমেষে বেরিয়ে আসে মন্ডপ থেকে। দুই হাতে বজ্র, চোখে আগুন… কিছু পরেই শুরু হবে সন্ধি পুজো। তার বাড়িতেও সাজগোজের আয়োজন চলছে। বধূটি ঘরে প্রবেশ করেই তার সে আগুন ছুঁড়ে দেয় অত্যাচারের প্রতি। ভয় পেয়ে যায় ওরা…ঢাকের শব্দে ওদের ভয় বেড়ে বেড়ে যায় আরো…ওরা কালশিটে মুখে দশভূজা দর্শন করে। দশ হাতে দশ অস্ত্র, চোখে তেজ, শ্বাস পড়ছে দ্রুত… 
ওরা ক্ষমা চায়
ওরা প্রণত হয় বধূটির পায়ে। 
ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় রক্তের দাগ। 
—-------------
SUKAN MITHI (SUJATA MISHRA)


No comments:

Post a Comment