অদৃশ্য আওতা

গণশা টা বড় বোকা 
নইলে কী আর মন্ত্রীমশাইয়ের পি এ কে হাতের কাছে পেয়ে ভরা হাটের মাঝে এমন করে
অমন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে?

পি এ বললে, আরে ওকে বকছ কেন? ওর কী বলার
আছে বলুক না! আমি শুনবো। 
মন্ত্রী মশাই জনদরদী মানুষ।
তার কানে পৌঁছে দিলেই তো হল, নাকি?

গণশা বলতে শুরু করলে আর থামে না
হ্যাঁ গো বাবু! আমি না হয় সোনার টুকরো।
সোনার ছেলে বিশু। মানে হল গিয়ে আজ্ঞে
আমরা পেলাম সংরক্ষণের আওতা…
পাশের বাড়ির ভোম্বল ও ব্যাটা একেবারে
সাধারণ…
তবু কথা হল যে আমরা যখনই চাকরির পরীক্ষা দেই
পাশ তো করি না!
মানছি আমার মাথাটা একটু মোটা 
তবু এত বছর ধরে হরহর করে সব পড়লাম
তো যেই পরীক্ষায় বসতে যাই
মাথার উপর কাক বসে। শকুন ওড়ে।
বলে, টাকা চাই। দিতে পারবি? 
হুশ করে তাড়িয়ে দিই ওদের।
কেন রে! টাকা কেন দেব?
পড়ে পড়ে আমরা বলে কত রাত জেগে কাটিয়েছি
মায়ের গয়না, বাবার জমি…

যাক গে যাক, আসল কথা হল যে
তারপর শুনি ও বাবা! 
অমুক মন্ত্রীর ছেলে তমুক সে তো পরিক্ষাতেই বসেনি
সেদিন…হ্যাঁ আমি ঠিক জানি
সে তো সেদিন আমার পাড়ার কুসুমের গায়ে স্বপ্ন
বুনছিল গঙ্গার ধারের হোটেলে…
কুসুম নিজে বলেছে আমায়!
সে দিব্য কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে বেরিয়ে গেল
চাকরি করতে! 

গণশা টা ভারী বোকা! বলতে শুরু করলে
আর থামে না!
মন্ত্রীর পি এ তখন যাবার জন্য ব্যস্ত বড়
গণশা বলে উঠলে, থামুন মশাই! আরো বাকি।

হাসপাতালে নিয়ে গেলাম বাবাকে।
হঠাৎ বাবার বুকে ব্যথা। 
পাড়ার ডাক্তার বললে, গণশা তোর বাবার
হার্ট এ্যাটাক হয়েছে রে! 
শিগগির হাসপাতালে নিয়ে যা!

বড় হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তার, নার্স। 
বলল, সিট তো নেই! সব ভর্তি
অন্য কোথাও যাও নিয়ে…
আমি তো অবাক
ওই তো সাদা চাদর পাতা বিছানা রেডি
মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসলে হাসপাতালের 
সিকিউরিটি
আরে, ওগুলো তোর আমার বাপের না রে ছেলে!
ওগুলো নেতা মন্ত্রী এম এল এ এম পি ওদের
বাপের জন্য…,

মন্ত্রীর পি এ ভীষণ ঘামছে।
অনেক কষ্টে এতক্ষণ শুনেছে সব
তারপর গণেশের কাঁধে হাত রেখে বললে,
শোনো। এত চিন্তা কোরো না। 
মন্ত্রী মশাই জনদরদী লোক। দেশের দশের
কথা ভেবেই চলেন দিনরাত।
তোমরা নিশ্চয়ই চাকরি পাবে! 
আজ চলি। মন্ত্রী মশাইকে সব জানাবো।
শিগগিরই ভালো খবর পাবে…

গণশা টা বড় বোকা। বলতে শুরু করলে আর
থামে না। 
ও আরো কত শত জানতো। 
নেতার ছেলে ধর্ষণ করে খুন করতে পারে।
নেতার ভাই হুমকি দিয়ে তোলা তুলতে পারে
নেতার মেয়ে না পড়েই কেমন ডাক্তার হয়ে যায়…

গণশা টা বড় বোকা! বলতে শুরু করলে আর
থামতে জানে না…

কিন্তু ওরা থামিয়ে দিতে জানে।

বড় রাস্তার পাশে ওর ঠোঁট চেরা, চোখ ওল্টানো,
জিভ বেরোনো দেহ টা খুবলে খুবলে খেয়ে যায়
শেয়াল…

মন্ত্রীর স্ত্রী ঝকঝকে কপাল নিয়ে এসে দাঁড়ায় 
মস্ত বড় চাকরির প্রথম সারিতে।

মন্ত্রী মশাই জনদরদী লোক।
দেশের দশের কথা ভেবেই চলেন দিনরাত…
–––----------–––
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

স্বাধীনতা, তোমার জন্য

স্বাধীনতা, শুধু তোমার জন্য আজও একা কাঁদে
বৃদ্ধ মালি। তার বাগানে ফুল ফোটার আগেই
কুঁড়ি ঝরে গেছে সব।

স্বাধীনতা, শুধু তোমার জন্য আজও উদভ্রান্তের মত
হাসে মা। নড়বড়ে কণ্ঠে বলে, আসবে সে আসবে
যেদিন বৃষ্টির ক্ষেতে রোদ্দুর গাইবে গান, যেদিন রামধনু রঙে লেখা হবে ভালোবাসার নাম সেদিন সে আসবে…

শিশুটিও বৃদ্ধ হয়েছে আগামীর হাতে তবু নাড়ির টান খুঁজে ফেরে স্বাধীনতা শুধু তোমার জন্য।

আঠারোর ক্ষুদিরাম, পনের ' র সুশীল স্বাধীনতা তোমার জন্য স্পর্ধার আগুন জ্বালে আজও ভারতবর্ষের স্বপ্নে রোজ…

চোখের নিচে এক সমুদ্র অভিমান নিয়ে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী আঁচল পেতে বসে আছে। স্বামী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরলে ফুলশয্যার বিছানায় আলোর চুমো দেবে। স্বাধীনতা তোমার জন্য অপেক্ষায় সে আজও…

বকুল গাছে নাম লিখেছিল ছেলেটা। স্বাধীনতা তোমার জন্য মেয়েটা আর ফেরেনি। গাছটা শাখা দুলিয়ে দুলিয়ে তাকে ডাকে। সে ফিরলে প্রথম ফুল ফোটাবে সে গাছ।

এসব কথা স্বাধীনতাকে বলছিল ভারতবর্ষ। স্বাধীনতা দেশের অরণ্য ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করল, আমি এবার ঠিক ফিরব! না যদি ফিরি তবে যেন…

কথা সম্পূর্ন হওয়ার আগেই অরণ্যে দাবানল লাগল।

পাহাড়কে সাক্ষী রেখে স্বাধীনতা বলল, এই পাহাড় দেখবে কেমন করে আমি হাসতে জানি, হাসাতে জানি…
পাহাড়ের পাঁজর শুকিয়ে গেল। বরফ ভেসে এসে বন্যায় দুকূল ছাপিয়ে গেল। 
বৃষ্টি নেমে এল। স্বাধীনতা বলল, আর ভুল হবে না। বৃষ্টির পায়ে পায়ে ঠিক ফিরব এইবার
বৃষ্টি থেমে গেল। এ বর্ষা বৃষ্টিহীন।

ভারতবর্ষ হামাগুড়ি দিতে দিতে উঠে এল জীবন্ত জীবাশ্মের উপর, নির্ভয় ঠোঁট রাখল তাতে…
মাঝি তবু বৈঠা টানে
পাল তুলে দেয় আকাশে। স্বাধীনতা! ওই দেখো
সীমান্তে প্রহরী দাঁড়িয়ে আজও
তুমি যতই দেরি করো না কেন
একদিন না একদিন তোমাকে ফিরতেই হবে! 
—------------------
SUKAN MITHI (SUJATA MISHRA)

আমার দুর্গা

আমার দুর্গা অগ্নি কন্যা,
আমার দুর্গা স্নেহ বৃষ্টি !
আমার দুর্গা বজ্র মুঠি,
আমার দুর্গা নিত্য নব সৃষ্টি।

পড়াশুনা করে চাকরি করবি?  
জেনে যাবি আমার দুর্বলতা? 
তার চেয়ে এই বেশ,
ছিন্ন করে দিই স্বপ্ন তোর!
যে হাতে তুই মশাল জ্বালাস, সেবাও করিস,
আয় ছিঁড়ে নিই তোর সে আগুন,
সেবার নরম হাত,
কবজি থেকে আঙুল।

ছটফট করবি তুই!
আমি আনন্দে পাগল হব!
ভিক্ষে খানিক চাইলে পাবি, আমার পদতলে থাক।
ওরে মেয়ে, বাড়ির বধূ, পঙ্গু হয়ে আমার পায়ে থাক!

আমার দুর্গা ধ্বংস তো নয় মোটে,
আমার দুর্গা এক হাতেও পথ জানে।
আর্ত পুজোয় ফুল তুলে দেয় সে,
স্বপ্ন দেখায় দৃঢ় চিবুকের গানে।

রেণু খাতুন, 
বয়স চব্বিশ,
চোখে আশার সুরমা পরা ফুটফুটে এক প্রাণ।
ভেবেছিল সরকারি চাকরিটা পেয়ে গেলে
বাড়ির কিছুটা মঙ্গল হবে।
শ্বশুর শাশুড়ির ওষুধ,
স্বামীর এত পরিশ্রম, 
একটু পাশে থাকতে পারবে …
হাল ধরতে পারবে…;
হাল তো সে ধরলোই! 
স্পর্ধার হাল।
যন্ত্রণা ভুলে এক হাতেই শিখে নিল পাঠ,
লিখে নিল হৃদয়ে, পারতেই হবে!
যে স্বামীকে ভালোবেসে হাতে রেখেছিল হাত,
এক কোপে তার স্বপ্নের সুরমা মুছিয়ে দিল সেই।

যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরুপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যই নমস্তস্যই…

আমার দুর্গা হার মানে নি,
আমার দুগা পথ চিনেছে ঠিক।
আমার দুর্গা এক বাহুতেই আলো
জ্বালতে শিখে নিক।

আমার দুর্গা এক বাহুতেই আলো জ্বালতে শিখে নিক।
—-----------------
SUKAN MITHI (SUJATA MISHRA)

স্বাধীনতা মানে

স্বাধীনতা মানে রক্ত ঝরা ইতিহাস

স্বাধীনতা মানে নতুন প্রাণের শ্বাস

স্বাধীনতা মানে আমার মায়ের দেশ

স্বাধীনতা মানে অত্যাচারের শেষ


স্বাধীনতা মানে নেতাজি, ক্ষুদিরাম 

স্বাধীনতা মানে আরো সহস্র নাম

স্বাধীনতা মানে কচি সবুজ ঘাসে

লুটোপুটি হাসি আর গান শুধু ভাসে

লুটোপুটি হাসি আর গান শুধু ভাসে।

—---------------

SUKAN MITHI (SUJATA MISHRA)

অন্য প্রণাম

পাড়ার পুজো মণ্ডপে এবার দারুণ এক ঘটনা ঘটল।
সেজেগুজে নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পরে নবীন বাবু
প্রণাম করতে এলেন দশভূজার মূর্তিতে। চোখ বন্ধ করে প্রণাম শেষ করতেই মায়ের মুখে দেখলেন নিজের স্ত্রীর মুখ। তাঁর স্ত্রী! যাকে প্রতিদিন দু এক ঘা না দিলে নবীন বাবুর হাত নিশপিশ করে সেই বোকা মেয়ে মানুষ? বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে এলেন মন্ডপ থেকে। 

কিছু পরে এলেন বিনোদ বাবু। তিনি তাঁর মাকে রেখে এসেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। দশভূজার চরণে মাথা ঠেকাতেই মন্ডপ হয়ে গেল বৃদ্ধাশ্রম। তাঁর মা হাসছেন, পায়ের উপর বিনোদ বাবুর মাথা। মা বলছেন, ভালো থাক বাবা। ভালো থাক।
বিনোদ বাবুর চোখে জল, এক ছুটে বেরিয়ে আসেন মন্ডপ থেকে। স্ত্রীকে বলেন, তুমি চাও না চাও আমার মা আমার সঙ্গেই থাকবে।

অমিত ভুলে গেছে সীমা কে। বড়লোক বাবার মেয়ে যখন তার হবু পাত্রী তখন গরীবের সীমা কেন? মা দুর্গার মুখে তখন সীমার মুখ। অমিত ডেকে আনে তার বাবা মাকে। তারাও দেখে মা দুর্গার মুখে সীমা বসে আছে। চোখের ভিতর মায়ার ঘর। অমিত কি ভুল বুঝতে আর দেরি করে? সীমা যদি না আসতে চায় আর! তার বাবা মা ভাবে।

মন্ডপে ভিড় উপচে পড়ছে। এ কেমন কথা? সবাই তার অন্যায় দেখতে পাচ্ছে। তাদের পায়ে মাড়ানো ঘাস মাথায় নিয়ে বেরিয়ে আসছে মন্ডপ থেকে।

একটি ছোট্ট ছেলে তার বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে, ও বাবা! মা দুর্গার গায়ের শাড়িটা কেমন ছেঁড়া দেখো! ঠিক আমাদের আয়া মাসীর মতন…
এবার পুজোয় আয়া মাসীর নতুন শাড়ি হতে আর কি দেরি হয়? 

একটা কালশিটে মাখা মুখ ছুটে আসে হঠাৎ। মনে হয় দেবী মার কাছে এসে সে উগড়ে দেবে তার যন্ত্রণা, জিজ্ঞেস করবে কেন মা? কেন রক্তাক্ত হই প্রতিদিন? কেন এমন অবিচার তোমার? 
প্রবেশ করে মন্ডপে সে। দশভূজা তাকিয়ে আছেন তার দিকে। আচম্বিতে রক্ত ঝরা বধূটির কান্না থেমে যায়।
দেবী মার মূর্তিটা কেমন যেন তার মত দেখতে হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তার মত গালে গলায় রক্তের দাগ, কালশিটে। তবে এ কী! দেবীর চোখে তো কান্না নেই! এক ভয়ঙ্কর আগুন জ্বলছে যেন! দেবীর দশ হাত লুপ্ত হয়ে মাত্র দুই হাত, ঠিক তার মতই শাঁখা পলা পরা। দুই হাতে কী প্রবল এক আগুন ধরা! মনে হচ্ছে এখনি ভস্ম করে দেবে সবকিছু, সব অন্যায়! সব দুঃখ… 
বধূ টি নিজেকে এমন ভাবে কোনোদিন তো দেখেনি! 
নিমেষে বেরিয়ে আসে মন্ডপ থেকে। দুই হাতে বজ্র, চোখে আগুন… কিছু পরেই শুরু হবে সন্ধি পুজো। তার বাড়িতেও সাজগোজের আয়োজন চলছে। বধূটি ঘরে প্রবেশ করেই তার সে আগুন ছুঁড়ে দেয় অত্যাচারের প্রতি। ভয় পেয়ে যায় ওরা…ঢাকের শব্দে ওদের ভয় বেড়ে বেড়ে যায় আরো…ওরা কালশিটে মুখে দশভূজা দর্শন করে। দশ হাতে দশ অস্ত্র, চোখে তেজ, শ্বাস পড়ছে দ্রুত… 
ওরা ক্ষমা চায়
ওরা প্রণত হয় বধূটির পায়ে। 
ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় রক্তের দাগ। 
—-------------
SUKAN MITHI (SUJATA MISHRA)


অন্য প্রণাম

পাড়ার পুজো মণ্ডপে এবার দারুণ এক ঘটনা ঘটল।
সেজেগুজে নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পরে নবীন বাবু
প্রণাম করতে এলেন দশভূজার মূর্তিতে। চোখ বন্ধ করে প্রণাম শেষ করতেই মায়ের মুখে দেখলেন নিজের স্ত্রীর মুখ। তাঁর স্ত্রী! যাকে প্রতিদিন দু এক ঘা না দিলে নবীন বাবুর হাত নিশপিশ করে সেই বোকা মেয়ে মানুষ? বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে এলেন মন্ডপ থেকে। 

কিছু পরে এলেন বিনোদ বাবু। তিনি তাঁর মাকে রেখে এসেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। দশভূজার চরণে মাথা ঠেকাতেই মন্ডপ হয়ে গেল বৃদ্ধাশ্রম। তাঁর মা হাসছেন, পায়ের উপর বিনোদ বাবুর মাথা। মা বলছেন, ভালো থাক বাবা। ভালো থাক।
বিনোদ বাবুর চোখে জল, এক ছুটে বেরিয়ে আসেন মন্ডপ থেকে। স্ত্রীকে বলেন, তুমি চাও না চাও আমার মা আমার সঙ্গেই থাকবে।

অমিত ভুলে গেছে সীমা কে। বড়লোক বাবার মেয়ে যখন তার হবু পাত্রী তখন গরীবের সীমা কেন? মা দুর্গার মুখে তখন সীমার মুখ। অমিত ডেকে আনে তার বাবা মাকে। তারাও দেখে মা দুর্গার মুখে সীমা বসে আছে। চোখের ভিতর মায়ার ঘর। অমিত কি ভুল বুঝতে আর দেরি করে? সীমা যদি না আসতে চায় আর! তার বাবা মা ভাবে।

মন্ডপে ভিড় উপচে পড়ছে। এ কেমন কথা? সবাই তার অন্যায় দেখতে পাচ্ছে। তাদের পায়ে মাড়ানো ঘাস মাথায় নিয়ে বেরিয়ে আসছে মন্ডপ থেকে।

একটি ছোট্ট ছেলে তার বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে, ও বাবা! মা দুর্গার গায়ের শাড়িটা কেমন ছেঁড়া দেখো! ঠিক আমাদের আয়া মাসীর মতন…
এবার পুজোয় আয়া মাসীর নতুন শাড়ি হতে আর কি দেরি হয়? 
—-------------
SUKAN MITHI (SUJATA MISHRA)

আমি সময়

সেই কোন্ যুগ থেকে যে আমি হেঁটে চলেছি
আমি নিজেও জানি না
শুধু জানি হাঁটতে হবে, ছুটতে হবে
কোথাও থেমে থাকা চলবে না।

আমি কে?
সময়। 
সময় কোথা আমার সময় কাটাবার?
সময় কোথায় আমার সময় হারানোর?
আমি সময়। পৃথিবীর হাত ধরে এগিয়ে চলি।
লীন হয়ে যায় আমার অতীত
বর্তমান প্রবল ছোটে ভবিষ্যত ছোঁয়ার জন্য
আমি সময়।
সময় কোথায় পিছিয়ে আসার জন্য?

ভালোবেসে ছেলেটা মেয়েটাকে বলেছিল
একটু সময় দাও। চাকরিটা পেয়েই তোমায় 
বাড়ি নিয়ে আসবো…
মেয়েটার হাতে আমি তো ছিলাম না! 
ছিল তাড়া। বড়লোক পাত্রে বিয়ে হয়ে গেল তার।
বছর দুয়েক আমিও ছুটলাম খুব।
ফিরে এল মেয়েটা। অত্যাচারে। 
এখন মেয়েটার হাতে আমি অগুনতি হয়ে বসে আছি
পুকুর ঘাটে, কলতলায়…

পৃথিবী বাঁধা আমার হাতে। 
দিন রাত্তির ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত আমি
তবু আমার সময় তো নেই বসে থাকবার
তবু ডাক দিয়ে যাই স্বপ্ন দেখা চোখে,
এস, আমার আঙুল ধরো।
ছুটতে শেখ…

খুব ইচ্ছে করে শিশুর হাসিতে এসে থেমে থাকি
বেশ কিছুক্ষণ
কিন্তু আকাশ ছুঁতে চেয়ে আমাকে টেনে ধরে।
সেও ছোটে…

আমি কে?
আমি সময়।
—------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

মানুষ - মিছিল

ডাস্টবিনের পাশে যেদিন উন্মাদ নগ্ন দেহটা যন্ত্রণায়
চিৎকার করে উঠল কেউ এল না পাশে
রাতের অন্ধকার চিরে
কয়েকটি কুকুর উলঙ্গ লোভ নিয়ে দাঁড়ালো উন্মাদিনীর চারপাশে

জন্ম নিল ছোট্ট কচি প্রাণ।
উন্মাদিনীর চোখে আগুন জ্বলে উঠল প্রথমবার
সে তার আঁচলে চেপে ধরল স্নেহ
কাঁচের টুকরো তুলে ছুঁড়ে মারল লোলুপ কুকুরগুলোর দিকে
তারপর জড়িয়ে জাপটে আগল দিল তার কোলে

ছোট্ট প্রাণ স্থান পায় এক বৃহৎ প্রাণে
উন্মাদিনী বলে, যা যা তুই যা আমি জেগে আছি
সন্তানহীনা একজন বুকে তুলে নেয় তাকে
উন্মাদিনী কে দেয় অন্ন বস্ত্র
কিন্তু তার অত সময় কোথা সময় নষ্ট করবার
সারাদিন ধরে সে কাঁচ কুড়োয়, বুকের ভিতর
আরো আরো বজ্র বাঁধে তার
সন্তান হীনা বিস্মিত হয়। 
রাত গভীর হলে উন্মাদ মায়ের স্রোত ভেসে আসে কণ্ঠে…সা…বধান! 

সব কুকুর থেমে যায়। সব মানুষ ভয় পায়।
উন্মাদিনী প্রবল ঝড় এখন, ধরতে গেলেই
ছুঁড়ে ফেলে, বুকের দিকে হাত বাড়ালেই
ঝনঝন করে ওঠে কাঁচ, রক্তের গন্ধে ম ম করে পথ

পৃথিবী উন্মাদিনীর নাম রেখেছে মা।

সারা রাত্তির অস্ত্র হওয়ার পরে সূর্য উঠলে সে মা
খানিক ঘুমিয়ে নেয়। 
তারপর ডাস্টবিন খেতে খেতে গান ধরে
আমরা সবাই রাজা
সেই কবে যেন সে শিখেছিল এ গান

ধীরে ধীরে মা বৃক্ষ হয়। 
সেই বৃক্ষের নিচে এসে বসে ছোট ছোট প্রাণ
নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে।

পালিকা মা তার মেয়ের নাম রেখেছে প্রীতিলতা।
আবর্জনা সরিয়ে ফেলে সে মেয়ে গাছ জড়িয়ে ধরে
বলে, কেন মা আমার সঙ্গে গেলে না?
উন্মাদিনী হাসে। 

পৃথিবী বলে, তোর উন্মাদিনী মা এখন মাতঙ্গিনি রে! 
মানুষ মিছিলের সামনে থাকতে হবে না? 
—----------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

ঘুম

ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে'
ওদের ঘুম ভাঙাও! 
সারি সারি উলঙ্গ রাজা সাজানো দোকানের সামনে
ওরা এসে দাঁড়িয়েছে।
সবাই দেখছে বুঝছে কিন্তু বলছে না কিছুই
ওদের হৃদয় ভর্তি ঘৃণা
ধিক্কার
তবু ওরা প্রশ্ন করছে না…
ওদের বুকের ভিতর যে পিতা ঘুমিয়ে
যদি তার ঘুম ভাঙ্গে এ অসময়ে
তবে সে এক প্রবল কণ্ঠস্বরে চিৎকার করবে
বলবে, এ রাজা পোশাক বিহীন!
এ স্বাধীনতা পরাধীন!
গণতন্ত্র বন্দি!

ফিরে এলেন মাতঙ্গিনি, প্রীতিলতা
পতাকা কাঁধে তুললেন সুভাষ
গান্ধীজি এলেন। ক্ষুদিরাম বিনয় বাদল দীনেশ
ননী বালা দেবীও এলেন। 
সভার বিষয় ঠিক হয়েছে ভারতবর্ষ
প্রফুল্ল চাকী বিস্ময়ে বললেন, এ ভারত কি আমারই?
নেতাজি বললেন, তোমরা সাহসী হও! 
আমি তোমাদের বোধ এনে দেব…
ক্ষুদিরাম বলে উঠল, আঠারো কই? আঠারো?
প্রীতিলতা হই হই করে মৃত্যু নিল গলায়
বলল, কারা যেন ঘুমিয়ে আছে…

দুর্দম ইংরেজ এল প্রচন্ড উল্লাসে।
বলল, আমরা কিন্তু পোশাক পরতে জানি
এরা জানে না, জানে না…

শুকনো পথের দুই পাশে কচি ধান ক্ষেতের বাস
চাষীর কাঁধে গামছা কপালে ঘাম
ঘরে আসবে নতুন পৃথিবী 
এবার পুজোয় একটা নাক ছাবি দেবে বউকে সে
তার আনন্দ ধুয়ে যাচ্ছে রোদ্দুরের গানে গানে

সভা শেষ হল এদিকে।
সকল দেশপ্রেমী বাতাস হওয়ার আগে দীর্ঘশ্বাস
ফেলে বলল, এর চেয়ে ভালো ছিল ইংরেজ…
নেতাজি বললেন, কয়েক সহস্র নেতাজির জন্ম
হওয়া দরকার বড়…

চাষীর স্বপ্নের পাশে এসে বসল সময়
বলল, যদি সবটা তোমার হতে পারতাম…

সারি সারি বসানো উলঙ্গ রাজার মূর্তি
সবাই দেখছে কিন্তু কেউ এখনো বলছে না
স্বাধীনতা পরাধীন! 
ওকে মুক্তি দাও!
ওদের ঘুম ভাঙাও!
—-------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

কনকাঞ্জলি

কনে বিদায়ের সময় চোখে জল নিয়ে মেয়ের সামনে আঁচল পেতে ধরল মা… দে! কনকাঞ্জলি দে! 

মেয়ের দুহাতে রবীন্দ্রনাথ ছিল ঠাসা। বাইশে শ্রাবণ ছুঁড়ে দিয়ে বলল, 

রবীন্দ্রনাথ থেকে কেবল এইটুকুই বিয়োগ করা যায় মা!
—------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

স্বপ্নের বাকি আধ খানা না

মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে কারা যেন ঠেলে তুলল
বলল, ওঠ ওঠ এ রাস্তা আজ তোর নয়
দেখছিস না রাজার আসার আয়োজন চলছে
স্বাধীনতা হাতে সোনার রথে আসবে রাজা

স্বপ্ন টা আধখানা দেখা বাকি ছিল তখনো। 
ঘুম ফেলে বিস্ময়ে চোখ মেলে বলি, রাজা আসবে? তবে থাকি এইখানে তার কাছে চেয়ে নেব 
স্বপ্নের বাকি আধখানা…

ঠেলে দিল আরো জোরে, ভাগ বলছি!
শুনছিস রাজার দুহাতে থাকবে স্বাধীনতা
কানে থাকবে গান, ঠোঁটে হাসি
বলি তোর কথা শুনবে বা কী করে, বলবেই বা কী?

হুমড়ি খেয়ে পড়লাম সামনে। 
জন্ম থেকেই এ রাস্তা সে রাস্তায় মানুষ
মানুষ কী আর? লোকে আমায় ফালতু বলেই ডাকে।
কদিন আগে বড় রাস্তার মন্টু এসেছিল 
বলে গেছে তোর বয়স হয়েছে তের
আর দেরি নয়। 
রাজা আসবে তোর গুহায়…

বললাম, শোনো না! শুনছো? 
এ কী মন্টুর রাজা? 
আমার গুহা দেখবে? 
আমি তবে অপেক্ষায় থাকি?

ওরা ভয়ঙ্কর হাসল। বলল, এ রাজার পরনে
কাপড় থাকে…
স্বাধীনতা বাসি হলে আসিস
ছুঁয়ে দেবে তোকে

স্বাধীনতা! স্বাধীনতা! স্বাধীনতা!
কে স্বাধীনতা এটা তো বলে যাও!

দুশ বছর ধরে যে মা অনেক যন্ত্রণা নিয়ে নিয়ে
উনিশ শ সাতচল্লিশে এক সন্তান প্রসব করেছিল
তার নাম স্বাধীনতা!
অন্য কিছু নয়।
তবে তোর মত রাস্তায় পড়ে থাকে না।
মাথায় থাকে। 
জন্মদিন এলেই সে রাজার হাতে চরে
বাজনা বাজে। পতাকা ওড়ে…
তাই তোরা ভিক্ষে পাস, রাস্তা পাস।

কানের কাছে মুখ নামিয়ে ওদেরই একজন বলল
তবে এ ছেলেকে বেয়াদপ করেছে ওই রাজাই
নইলে কী আর রাস্তা ওর একার হয়?
আমাদেরও মুখ বন্ধ রাখতে হয়, নইলে…

ওই তো মন্টু ডাকছে ফালতু ফালতু বলে…
ও খুব জোরে জোরে ডাকছে আমায়
তোদের রাজা স্বাধীনতাকেই যখন বন্দী রেখেছে
আমায় আর কি দেবে?
চলি।
স্বপ্নের বাকি আধ খানা না হয় 
তার রাজার সঙ্গে কচি ধান ক্ষেতে শুয়েই দেখব!
—------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

এই তো আমার স্বাধীনতা!

সকাল বেলায় আমি যখন ফুল হয়ে থাকি
প্রজাপতি ঠিক এসে বসে আমার গায়ে
ঠোঁটে রাখে চুমো। আলতো আদর দিয়ে
বলে, উড়ে যেতে ইচ্ছে হয় না? 
মনে হয় না স্বাধীন হয়ে ভেসে যেতে দূরে?
আমি খিলখিল করে হেসে উঠি।
এই যে তুমি আসো, ভালোবাসো
আমি গন্ধ ছড়াই, ভেসেই তো যাই গো!
এটাই আমার স্বাধীনতা।

দুপুর বেলায় গাছ হয়ে যাই।
পথিক আসে। ছায়ায় বসে।
একদিন এক ছোট্ট শিশু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে
তোমার কাছে এক প্রশ্ন রাখতে এলাম
রাখবো?
আমি বললাম আগে আমার ছায়ায় জুরোও। তারপর
রেখো।
সে বললে, আচ্ছা শোনো না! বইতে পেলাম 
তোমার নাকি প্রাণ আছে ঠিক আমারই মত!
তবে যে চলতে পারো না, ছুটতে পারো না, কইতে
নাইতে কিছুই পারো না…
উড়ে যেতে ইচ্ছে হয় না?
মনে হয় না স্বাধীন হয়ে ছুটে যেতে দূরে?
আমি জোরে জোরে হেসে উঠলাম।
পাতাগুলো নড়ে উঠল। ছেলেটা বাতাস পেল 
কপালের ঘাম শুকালো তার।
তার হাতের মধ্যে একটা ফল ফেলে দিয়ে বললাম
এটাই আমার স্বাধীনতা।

বিকেল বেলা হতেই আমি বাড়ির বধূ
খেটে খুটে স্বামী আসবে। শ্বশুর ভাসুর 
সূর্য পশ্চিম ছুঁলেই আমি গা ধুয়ে এসে গান হই
চুল বাঁধি, প্রদীপ জ্বালাই।
স্বামী এসে হাত ধরে বলে, চলো হাওয়া খেয়ে আসি
আমি বলি, রান্না বাকি মশাই!
সে অভিমান করে। রাতের মত খানিক কাব্য করে বলে, ইচ্ছে হয় না উড়ে যেতে?
স্বাধীন হয়ে খুব ভাসতে?
আমি হেসে তাকে জড়িয়ে ধরি।
বলি, এটাই আমার স্বাধীনতা।

আমার বার্ধক্যের চোখে ঘুম নেই
বন্দি ওষুধে অসুখে
যৌবন আমায় না দেখার ভান করে চলে যায়
বৃদ্ধ সময় আমি তাকে ডাকি, এস না গল্প করি!
যুবক বেলা টগবগে স্রোত নিয়ে ছুটে যায়।
কী মনে করে ফিরে আসে বেশ কিছু পরে
এই যে শোনো! ইচ্ছে হয় না ফিরে যেতে?
মনে হয় না স্বাধীন হতে?
শেষের শেষে দাঁড়িয়ে কম্পিত কণ্ঠে আমি বলি,
এই তো নিয়ম!
এই তো আমার স্বাধীনতা!
এই তো আমার স্বাধীনতা।
—------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)

স্বাধীনতা মানে

স্বাধীনতা মানে স্বচ্ছ সবুজ পৃথিবীর বাস
স্বাধীনতা মানে সজোরে বলা, বুক ভরে নাও শ্বাস!

স্বাধীনতা মানে ওই ছেলেটার খিদেয় দিন রাত
স্বাধীনতা মানে ঘুম ঘুম চোখে ধোঁয়া ওঠা ভাত

স্বাধীনতা মানে মাঠ ভরা হাসি শ্যামল কচি ধান
স্বাধীনতা মানে ভারত মাতার নির্ভয় সন্তান…

ছেলেটা ভারী বিস্মিত। এত ধুপ ধুনো…
কীসের আয়োজন?
লোকটা বলে তোরা এসব বুঝবি না রে! তোরা ছোটো জন!

পতাকা উড়ছে দেখছিস? স্বাধীনতা ওর মানে
দেখ দেখ ওই টুকু শিশুও সেটা জানে…

তোদের শুধু খিদে খিদে চাই চাই চাই
খাওয়া ভিন্ন দেশ প্রেম এসব কিছুই নাই?

ওই দেখ রান্না হচ্ছে যা নিয়ে পালা!
ছেলেটা বোঝে স্বাধীনতা মানে শাল্ পাতার উপরে 
গরম খিচুড়ি ঢালা…

স্বাধীনতা পেয়েছি! স্বাধীনতা খেয়েছি! আনন্দ তার ভারী
দেশ মা ভাবে, স্বাধীনতা দেশ ছেড়েছে কবেই…অশিক্ষা মহামারী।
—------------------
SUJAN MITHI (SUJATA MISHRA)