সীতায়ন

"মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ

যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতমঃ।"


শোক থেকে উৎপন্ন হল শ্লোক।

দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি।

ব্রহ্মা এসে বলে গেলেন, এই শ্লোক অক্ষয় হোক।

মিথুনরত ক্রৌঞ্চ-এর মৃত্যু সূচিত করল মহাকাব্য।

জন্ম নিলেন জনক-রাজের কর্ষিতা কন্যা সীতা।

যিনি বারবার অগ্নি পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত

শরীর মিশিয়ে নিয়েছেন মাটিতে।


মহাকাব্যের জয় জয়কার ঘোষিত হয়েছে চারিদিকে।

প্রজাবৎসল রামচন্দ্র পূজিত হয়েছেন ঘরে ঘরে।

কেঁদেছে মাটি, কেঁদেছে বাতাস, কেঁদেছে মা…


তাই আজ দিগন্ত থেকে দিগন্তে মায়েরা 

ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস!

প্রচন্ড দাবদাহে চূর্ণ বিচূর্ণ হয় মাটি…

ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে শিকড়…

রাজা কর্ষণ করেন, শক্ত ক্ষেতে...

আগুন ওঠে, ফসল ফোটে না…


মনে মনে ভাবে শতাব্দী, এই তো উন্নয়ন!

মাঠে ঘাটে পড়ে থাকে পৌরুষ।

পাখির ঠোঁটে বিষবৃক্ষের বীজ

পাতায় পাতায় বিষাক্ত ক্লোরোফিল।



বাল্মীকি নিদ্রাহীন।


রাবণ এবং মেঘনাদকে পরাজিত করিয়ে তিনি রামকে দেবতা করেছেন।

সীতাকে সতীত্ব পরীক্ষা করিয়েছেন।

মৃত্তিকায় নির্বাসন দিয়েছেন…

প্রজাবাৎসল্য শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করিয়েছেন…

কিন্তু মৃত্তিকায় মিশে যাওয়া সীতার চোখে

ঢেলেছেন আগুন!


বাল্মীকি এখনও সেই আগুন খুঁজে চলেছেন।

তাই তিনি বিনিদ্র।


চারিদিকে দাবানল।

রাত্রি গভীর হলে গাঙ্গুরের জলে ভেসে যায়

বেহুলার শরীর…


যে নারী ধিক্কারে মাটি হতে জানে,

যে নারী অস্ত্র হয়ে জন্ম নিতে পারে কর্ষণে কিংবা

ধর্ষণে…

যাকে ছুঁলেই ঝলসে যায় চোখ!

তাকেই আজও খুঁজে চলেছেন মহাকবি। 

ক্রৌঞ্চ-এর মৃত্যুর পরে নয়, 

সেই অগ্নি কন্যাকে বুকে নিয়ে রচনা করবেন

আর এক মহাকাব্য;

সীতায়ন...

------------------

Sujata Mishra

প্রাক্তন

মরুভূমিতে হু হু করে বেড়ে চলল উষ্ণতা।

তাপমাত্রা ফারেনহাইট ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল

ছায়াপথের বারোটা নক্ষত্রে।


আমি সেই আগুনের উপর গা এলিয়ে জিজ্ঞেস

করলাম, হ্যাঁ বিশাখা, বলো তারপর…

বিশাখা কেঁদেই চলল। 

আমি তার নরম চিবুক স্পর্শ করতেই সে

ঝর্ণা হয়ে গেল।

আমি তাতে আমার গলা অবধি ডুবিয়ে 

মুখে চুকচুক শব্দ করলাম। 

তাই তো...তোমার পুরো গল্প তো শোনা হল না!

আমার জন্য ঝর্ণা হয়ে গেলে?

বেশ, যা জ্বর নেমেছে আজ মরুভূমিতে, ভালোই

করেছ।


খুব খানিক স্নান সারার পরে উঠে এলাম।

ঝর্ণা তখন জমে বরফ।

উষ্ণতা কমতে কমতে সুমেরুতে গিয়ে ঠেকেছে।

আমি বরফের ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করতে

করতে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কই বিশাখা!

বললে না তো, তারপর কী হল!

বিশাখা কেঁদেই চলল।

আমি তার কাঁধ স্পর্শ করতেই সে দুর্দান্ত ঘোড়া হয়ে উঠল।

আমি তার পিঠে চড়ে পেরিয়ে এলাম রাতের

মরুভূমি। পিঠ চাপড়ে বললাম, সাবাস!

এভাবেই পাশে পাশে থাকতে হয় বুঝলে!


আমি সমভূমিতে এসে মরুভূমি ভুলে গেলাম।

জ্বরের রাত, অসুখের নদীও।

বিশাখা যে কী বলতে চেয়েছিল…

যাই বলতে চাক, আমার শুনে কী হবে?

আমি তো দিব্য ফিরে এসেছি জ্বরের মরুভূমি থেকে!


ওকে লুকিয়ে অন্য ঢেউ ঘরে এনেছিলাম যেদিন,

ও খুব কেঁদেছিল যেদিন,

ও গলায় দড়ি নিয়েছিল যেদিন,

শুধু সেই দিনটা আমার গলায় এক বিরাট 

তৃষ্ণা হয়ে বসে আছে!


সে যাক গে, জ্বর হলে জলপটটিটা এখনও

সেই তো এসে দিয়ে যায়!

যতই প্রাক্তন অথবা মৃত হোক না কেন! 

---------------------

Sujata Mishra

আমার রবীন্দ্রনাথ


"সত্যান্ন প্রমদিতব্যং।

ধর্ম্মান্ন প্রমদিতব্যং।

কুশলান্ন প্রমদিতব্যং।

ভূত্যৈ না প্রমদিতব্যং।"


বাবা বললেন, এই  হোক তোমার জীবনের মূলমন্ত্র।


সামনে প্রদীপ জ্বলছিল। সদ্য স্নান করে

আমি আর বাবা বসেছি ঘরের এক কোণে।

বাবা আমায় দীক্ষিত করবেন।

আমায় পথ দেখাবেন।

এটাই এ বাড়ির রীতি।

ছেলে মেয়েরা একটু বড় হলেই বাড়ির গুরুজনই

তাদের কানে প্রবেশ করিয়ে দেন জীবনের মন্ত্র।


আমি তখন পঞ্চম শ্রেণি। বাবা আমার কোলের

উপর রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, প্রণাম করো

ইনিই তোমার গুরু।

আমি রবীন্দ্রনাথ এবং বাবা দুজনকেই প্রণাম করলাম।

জিজ্ঞেস করলাম, ইনি ঈশ্বর বাবা?

বাবা হাসলেন। বললেন, বড় হও, বুঝবে।


আমি রবীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে 

রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধা করতে করতে

নবম শ্রেণিতে যখন,

আমার পায়ের পাতায় বসন্তের ঢেউ লাগল।

কানের সামনে মুখ নামিয়ে সে গাইল,

এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি

ভালোবাসি ভালোবাসি…

আমি শিহরিত হলাম।

এ যে রবীন্দ্রনাথ!

ইনি তো ঈশ্বর!

ইনি তো আমার গুরু!

আমি ছুটে গেলাম বাবার কাছে…

বাবা! বাবা! জানো, আজ কোকিল ডাকছিল!

সেই সুরে আমি যে আমার রবীন্দ্রনাথকে পেলাম!

কিন্তু তা কী করে হয়?

উনি যে…

বাবা হাসলেন। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,

উনিই তো বসন্ত!

তিরতির করে উঠল আমার ঠোঁট।

এই প্রথম আমি রবীন্দ্রনাথকে প্রেমিক ভাবলাম।

বাবার সামনে থেকে এক ছুটে ঘরে এসে

বিছানায় উপুড় হলাম।

আমার বুকের নীচে গান বয়ে চলল

আমারও পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো…


একদিন আমার বসন্ত প্রখ্যাত গবেষক হয়ে বিদেশে গেল।

তার শিকড় প্রবেশ করল সেখানেই।

তার কোকিল রবীন্দ্রনাথ ভুলে গেল।

আমি কেঁদে পড়লাম বাবার কাছে।

বাবা! বাবা! এ কেন হল?

আমি যে নিঃস্ব হলাম!

বাবা মাথায় হাত রাখলেন, বললেন

…"আছে দুঃখ আছে মৃত্যু।"

আর আছে শক্তি...

"অসতো মা সদ্গময়।

তমসো মা জ্যোতির্গময়।

মৃত্যোর্মামৃতং গময়।

আবিরাবীর্ম এধি।।

রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং,

তেন মাং পাহি নিত্যম্।"


আমি পঞ্চম শ্রেণি থেকে রবীন্দ্রনাথ 

বুকে ধরে আছি।

বাবা বলেছিলেন, বড় হও, জানবে।

আমি আজও বড় হয়ে চলেছি...


স্নান করে রবীন্দ্রনাথ এর সামনে প্রদীপ জ্বেলে

প্রণাম করেছি।

দ্বিপ্রহরে বুকে জড়িয়ে ধরেছি সঞ্চয়িতা।

গভীর রাতে গীতবিতানের সুর ভিজিয়েছি

বিষাদের অশ্রুতে।


আমার বুকের গহনে সোনার তরী ভেসে যাচ্ছে

আজও…

পাকা ধানক্ষেতে দুলছে শিশির,

দুলছে আকাশ।

বসে আছি কূলে আমি আর রবীন্দ্রনাথ।

------------------

Sujata Mishra

ঈশ্বর-বৃক্ষ

তারপর মেয়েটার চোখের তারায় জন্ম নেয় 

সূর্য। মেয়েটা দুহাতে আলো, উত্তাপ তুলে দেয়

জরাজীর্ণ ফসলগুলোতে। সালোকসংশ্লেষ পূর্ণ

হলে মেয়েটা দাবানল সৃষ্টি করে। দাউদাউ করে

পুড়ে ছারখার হয় বিষাক্ত শিকড়। মেয়েটার কাছে

ছুটে আসে পিঞ্জর...বলো! কী উপায়?

লোহার শিকল কেঁদে পড়ে, শক্তি দাও! শক্তি দাও!

মেয়েটা ভ্রুর কুঞ্চনে তখন কঠিন পাহাড়।

চোয়াল শক্ত। পিঞ্জরে শব্দ ঢালে। বলে, খুঁজে নাও! উন্মুক্ত থাকে না, কিন্তু দ্বার থাকে। শিকলের 

ভাঁজে ভাঁজে লিখে দেয় মন্ত্র, বাঁচতে হবে…

বাঁচতে হবে।


সে অনেক কাল আগের কথা। মেয়েটা হাসত, খেলত, ছুটত, ভালোবাসত…

তারপর একদিন তার হাসি, খেলা, দৌড় কারা যেন ছুঁড়ে ফেলল! এর পা থেকে ওর পায়ে... ওর পা থেকে তার পায়ে…

বর্ষার কাদার উপর মেয়েটা ঝমঝম বৃষ্টির যন্ত্রণা হয়ে উঠল। কারা যেন চিৎকার করে উঠল, হচ্ছে না! হচ্ছে না! আরও চাই!

কারা যেন মেয়েটার শরীরে চালিয়ে দিল পাশবিক উল্লাস…

তারপর তার অবসন্ন যন্ত্রণা ছড়িয়ে দিল সারা অরণ্যে...

হো হো করে হেসে উঠল খেলোয়াড়রা

সমস্বরে বলল, গোল! গোল!...গোল!


তারপর মেয়েটার মুখটুকু বাদে সারা শরীর সাড়া দেয়না। কিন্তু তার চোখের তারায় জন্ম নেওয়া ওই আগুনে রোজ রোজ এমন কত খেলোয়াড়ের অরণ্যে লাগে দাবানল। এমন কত যন্ত্রণারা শিখতে আসে জীবন। 

মেয়েটা তার মস্তিষ্কের সব স্নায়ু জড়ো করে বিস্ফোরণ ঘটায়। সে অরণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেলে কচি ঘাসের দানা ছড়ায় ঠোঁট দিয়ে। গান গায়, আলো বোনে। 


মেয়েটা তার বুদ্ধি আর মনোবল দিয়ে সালোকসংশ্লেষ সম্পন্ন করে নিজের। মাটি থেকে 

শুষে নেয় প্রত্যাশা...কাউকে হারতে দেব না বর্ষার ময়দানে! গোল করার আগেই অন্তত একটা ঝড় তোলা দরকার…


তারপর মেয়েটার শিকড় পৌঁছে যায় অনেক গভীরে। দাবানলকে ভয় পায় বর্ষার শূন্যস্থানও। 


কেবল প্রজাপতি এলেই মেয়েটার চোখে কান্না নেমে আসে...ফুল ফোটানোর আগেই যে তার

শরীর…


তারপর মেয়েটার নাম হয় ঈশ্বর-বৃক্ষ।

----------------

Sujata Mishra

হারিয়ে গেছি আমি

না গো মা! আমি তো আর একলা নই!

অফিস থেকে ফিরে এসে

তুমি যদি ডাকো, খুকু কোথায় ওরে?

চুপ করে ওই গোলাপ শাখায় লুকিয়ে যাব।

ফিরে আসবে আমার ক্লান্ত বাবা।

ভাববে, তাই তো! এই চাবি বন্ধ

ঘরে মেয়েটা গেল কোথায়?


তোমরা আমায় খুব খুঁজবে। খাটের তলা

ব্যালকনি, আলমারি…

গার্ড কে ডেকে জিজ্ঞেস করবে,

কেউ কি বেরিয়েছে?

এই এতটুকু এক মেয়ে, দেখেছ?

পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন তোমার কান্না শুনে

অবাক হবে। বলবে সেকি! ছোট্ট মেয়ে একলা

থাকত নাকি? উচিত নয়...উচিত নয়!

তুমি বলবে, না না কাজের মাসি থাকে।

আজ নেহাত ছুটি নিয়েছিল, তাই...

...তাই বলে চাবি বন্ধ করে অফিস করবেন?


আমি তখন গোলাপ মায়ের কোলে

আঁচল শুঁকছি তার, 

আলো খেলছি, ভালোবাসছে সেই মাও

আমায় খুব।

বলছে, খুকু! আমরা আছি। একলা ঘরে

আর পাবে না ভয়।

ওই দেখ, জানলার বাইরে ওই আকাশ

পথের ধুলো, রাতের চাঁদ তারা আর দিনের সূর্য সবাই আছে আমাদের।


তুমি তখন ভীষণ কাঁদছ।

বাবা বলছে তোমায়, দোষ তো তোমার!

মা যে তুমি! অফিস থেকে ফিরেও

সাজগোজ, ফোন এসব নিয়েই থেকেছ। কোনোসময় দিয়েছ তাকে আদর?

চিৎকার করে তুমি বলবে, আর তুমি?



আমি তখন গোলাপ মায়ের কোল থেকে টুক

করে মুখ বের করে, ছুঁড়ে দেব হাসি…

কেমন মজা! খোঁজো আমায়!

আর পাবে না কিন্তু!

একলা থেকে একাকীত্বে হারিয়ে গেছি আমি!

-------------------

Sujata Mishra

অভিনয়

কে ও! অভিনেতা?

আচ্ছা, তুমি অভিনয় দিয়ে তালগাছ হতে পারবে?

এক পায়ে দাঁড়িয়ে?

আচ্ছা, তুমি চড়া মেকআপে পাখি হতে পারবে?

আকাশের বুকে হারিয়ে?


কে ও! অভিনেত্রী?

আচ্ছা, তুমি তালগাছের নীচে গান গাইতে পারবে?

বাতাসে বাজবে আশা।

আচ্ছা, মঞ্চে দাঁড়িয়ে তোমরা ঘর বাঁধতে পারবে?

সত্যি ভালোবাসা?


কে ও! ভালোবাসা নাকি?

আচ্ছা, তুমি ভালোবাসতে বাসতে অভিনয় ভুলে যেতে পারবে?

যার নাম হৃদয়।

আচ্ছা, পাঁজরের ভিড়ে নদীটাকে বাঁচিয়ে নিতে পারবে?

যে কিনা অভিনয় নয়…

---------------

Sujata Mishra

আজগুবি ধাবা

বাবা রে বাবা...মস্ত ধাবা

তার ভিতরে ঘর আর ঘর

জ্বলছে চুলা কনের মাথায়

ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট বর।


বাবা রে বাবা... বিয়ের ধাবা

বরের এবার ঘুম ভেঙেছে

শিঙ নেড়ে যেই আসছে ষাঁড়

হুক্কাহুয়া ডাক ছেড়েছে।


বিয়েবাড়ির ভুরি ভোজে

লঙ্কা পেঁয়াজ রসুন আদা

হুতোম প্যাঁচা বরের মামার

পিসের মাসির আপন দাদা।


বর ডাকলে, কই রে হুতোম!

বউটা আমার গেল কই?

আমড়া চুষে বউ বললে,

আমি তো আর কনে নই!


আমি হতে পারি রুই

আচ্ছা তবে হই পুঁটি?

ষাঁড় বললে, ভীষণ মজা!

বিয়ে বাড়ির আজ ছুটি!


বাবা রে বাবা... ফাঁকা ধাবা

মুরগি খোঁটে নরম ঘাস,

ঘোঁতন বরের চোখের জলে

ডুব দিচ্ছে পাতি হাঁস।


কনের চোখেও জলের ঘড়া

গোলদিঘিতে ভরতে যায়…

মস্ত ধাবা একলা বসে

ডিগবাজি আর খাবি খায়।

----------------------

24. 03. 2021


ইচ্ছে

বড় হয়ে কী হতে চাও?

আমি বলব মাস্টারমশাই?

শানু এগিয়ে এসে বলল, ডাক্তার হব আমি।

মাস্টারমশাই ঘাড় হেলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

ডাক্তার কেন? 

শানু এবার মাথা নিচু করে ফেলে।

মাস্টারমশাই আবার জিজ্ঞেস করেন, বলো!

ডাক্তার হতে তোমার ভালো লাগে?

না...মায়ের।

টুসি, তোতা, অনি সবাই একে একে বলে

ফেলে মায়ের ইচ্ছে, বাবার ইচ্ছে।

ডাক্তার যদি কোনোক্রমে না হতে পারে তবে

ইঞ্জিনিয়ার তো হতেই হবে তাদের!

নিদেনপক্ষে টিচার

তার কম কিছুতেই না!


সবচেয়ে শান্ত ছেলেটি তখনও চুপ করে আছে।

মাস্টারমশাই তার মাথায় হাত রাখতেই সে বলে

ওঠে, মাস্টারমশাই! আমি ঠাকুর হতে চাই।


মাস্টারমশাই তো ভীষণ অবাক!

এইটুকু ছেলে, তার মধ্যে ঈশ্বর হওয়ার

চেতনা কেমন করে আসে!

কেমন করে সে অনুভব করে বিবেক, বোধ,

ভালোবাসা দিয়ে গড়া নিজের অন্তর

ঈশ্বর হয়ে যায় ধীরে ধীরে…

সে এইটুকু বয়সে কী করে উপলব্ধি করে এই ধারণা?

নিশ্চই তার বাবা মায়ের ভীষণ ভালো শিক্ষা।

নিশ্চই তাকে শেখানো হয়, তুমি চাইলে

রোদ্দুর কিংবা ঝর্ণা হতেও পারো।


মাস্টারমশাই এক বুক খুশি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

ঠাকুর কেন, বাবা?

ছেলেটি উত্তর দিল, আমার বাবা মা ঠাকুমা

সবাই শুধু ঠাকুরকেই ভালোবাসে।

ঠাকুর বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার ভয় পায়।

ঠাকুমা যত্ন করে খাওয়ায়। স্নান করায়।

ঠাকুর পড়ে না তাও তাকে কেউ বকে না।

ঠাকুরকে কেউ রাত থাকতে বিছানা থেকে টেনে তুলে হোম ওয়ার্ক করতে বলে না।


আমি ঠাকুর হলে আমার বাবা মা

সবসময় আর আমায় বকবে না!

আমি ঠাকুরের মত ঘুমোতে পারব!


মাস্টারমশাই আর কোনোদিন জানতে চান না,

কোন শিশু বড় হয়ে কী হতে চায়।

-------------

Sujata Mishra

ইল্যাটিং বিল্যাটিং সই লো

ইল্যাটিং বিল্যাটিং সই লো

কীসের খবর পাই লো

রাজা মশাই বলে গেছেন

একটি বালিকা চাই লো…


রাজামশাই বলে গেছেন,

একটি বালিকা চাই লো…


বালিকার নাম মল্লিকা। বাড়ি মাটির, ছাত টিনের।

বালিকার বাবা দিনমজুর, মা মৃত।

বালিকা বিশ্বাস করে, মৃতের জগৎ থেকে তার মা

তার জন্য রোজ সাহস পাঠায়। তেজ পাঠায়।


মল্লিকার চোখে আগুন, বুকে উদ্যম।

বাবার ভাগ-ক্ষেতে বৃষ্টি মাখতে মাখতে

সে গান সাজায়, ফসল বোনে।

কড়া রোদ্দুরে ভিজতে ভিজতে কুড়ুল চালায়,

সবুজ বসায়, বাসা বাঁধে।

মল্লিকা ইস্কুলে যায়। চুল বাঁধে। কালো কুচকুচে

মুখে হাসি আনে। মল্লিকা উঠানে চুলা জ্বালে।


ভাত ফোটায়, ফুল ফোটায়, পায়ের নিচে

মাটি গড়ে। মল্লিকা বাঁচতে জানে।


ইস্কুল পেরিয়ে কলেজ, কলেজ শেষে 

ইউনিভার্সিটি… 

কালো মেয়ের চোখের আগুন 

প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে টিভিতে...রেডিওয়।

ট্রেনে একলা একা ডাকাতদল ধরেছিল সে!


মল্লিকা বীরাঙ্গনা হয়ে ওঠে।

মল্লিকা তেজ জ্বালে, মল্লিকা গানও জানে।

ফসলে মাখামাখি হয় তার ঘাম।

পাড়া পড়শী ভুলে যায় ফুল দিয়েই তার নাম।


মল্লিকা লাঠি চালায়। বাজার করে। রান্না চড়ায়।

প্রথম হয়। খোঁপাও বাঁধে।

মল্লিকা কাঁদে!


মূর্তি গড়েন মানস বাবু…

তিনি কালো চুলে কালো ফুল

এঁকে বললেন, আর কেঁদো না মেয়ে!

আমায় ফসল তোলা শিখিয়ে দাও!


মল্লিকার শক্ত হাত।

মানস বাবুর নরম চোখ।

মল্লিকার খোঁপায় দুলে উঠল চাঁপার বাগানখানা।

সে বলল, রাজামশাই! ফসল তোলার আগে

যে বুনতে হয় গো!

এই নাও বীজ। ছড়িয়ে দাও পুবের মেঘে।

দেখো, সকাল কেমন জন্ম নেবে রাতের মাটিতে!

রাজামশাই দু চোখ বুজে বলেন, আমার কেবল

মল্লিকা যে চাই!


পড়শীরা সব গেয়ে উঠল।

ক্ষেত ও বৃষ্টি দুলে উঠল।

ফুলগুলো সব বলে উঠল…


ইল্যাটিং বিল্যাটিং সই লো

কীসের খবর পাই লো

রাজামশাই বলে গেছেন, মল্লিকা বালিকা চাই গো!

---------------

Sujata Mishra