ঔরস

।। এক ।।


নারী জন্মমাত্র থেকেই বলি-প্রদত্ত এ কথা শুনে একবিংশ শতকের গ্রাম গঞ্জ শহরের ইঁট কাঠ পর্যন্ত হেসে উঠলেও কিছু মানুষ চোখ পাকিয়ে রে রে করে ওঠেন, কেন নয়? কেন নয়! নারী অর্থে সুললিত কায়ায়, পুরুষের ছায়ায় পর-নির্ভর হলেই শোভনীয় মঙ্গল তাঁদের কাছে। 

সেইরকম এক দৃষ্টান্তমূলক পরিবার

রামকুমার মিত্রের নামেই তালপুকুর বাড়িখানি।


বত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করে আছে সে বাড়ির প্রাচীর, দেয়াল ছাত। রং চটে পলেস্তারা খসে বৃদ্ধা ঠানদির ঘর হয়েছে ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি-কথা। তবুও সে বাড়িতে গমগম করে ওঠে রামকুমার বাবুর গম্ভীর কন্ঠ, 'শোনো খোকার মা! এই বয়সেই এ বাড়ির নিয়ম শৃঙ্খলা শিখিয়ে দাও তোমার মেয়েকে। ওকে বলে দাও, ওর প্রতি ওর মেজ কাকার বন্ধুর আচরণ চৌকাঠ পার না হয়। আমি বরং মেজকে বলে দেব, ওই বন্ধুটি এ বাড়িতে যেন আর না আসে কখনো।' 


মায়ের কাঁধে মাথা রাখে অনুপমা। 'মা, বাবা ওনাকে শাস্তি দেবেন না কেন?' 

মা ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, 'চুপ চুপ!

এটাই যে বাড়ির রীতি।'


অনুপমার পড়াশোনায় যতখানি মেধা এবং ইচ্ছে পরের ভাইটি ততখানিই দূর্বল ও ফাঁকিবাজ। তবুও মিত্রবাড়িতে ভাইয়ের বুদ্ধি বিকশিত করার জন্য দুধটা ফলটা বেশি করেই আসে। অনুপমা অবশ্য ভোজনে আসক্ত নয়, সে ছন্দে আসক্ত। সে চাঁদ সূর্য ফুল কবিতায় বিমোহিত। প্রতি মুহূর্তে সে কল্পনার মাটিতে নানা বিমূর্ত কায়া গড়ে, প্রতি মুহূর্তে ভাঙে। আবার নতুন সৃষ্টি করে। তার এই সৃষ্টির ভাঙা গড়া খেলা দেখার জন্য তার আভিজাত্য আঁকড়ানো বাড়িতে কেউই ছিল না। তাই নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে অনুপমার শ্বাস দীর্ঘ হয়, অন্তর প্রস্ফুটিত হয়। মেজকাকার বন্ধুটির জন্য সে বাড়ির দরজা বন্ধ হলেও বাবার পিসতুতো এক দাদার আবির্ভাব হয় সে গৃহে। তেলতেলে মুখের উপর বসানো দুটো লোলুপ চোখ। অনুপমার বাবা তাঁর পায়ে শ্রদ্ধা ঢেলে বললেন, এ বাড়ি তো তোমারই দাদা! আজ থেকে এখানেই থাকবে তুমি। চুলোয় যাক তোমার ছেলেপুলে। অপদার্থ সব! নইলে বাবার সঙ্গে কেউ বিতণ্ডা করে!

অনুপমার হৃদয়ে তিরতির করে ওঠে ভয়।


।। দুই ।।


সুনিবেশবাবুকে ধরে পড়লেন সবাই। সাহিত্যের সেরা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি! এ সারা বাংলার অহংকার, সারা দেশের অহংকার। সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন তাঁর স্ত্রী রত্নাকে, আপনার স্বামী সম্পর্কে যদি দু চার কথা বলেন…

রত্নার উজ্জ্বল মুখ, চোখে হাসি, দুই গর্বিত গালে টোল ফেলে বললেন, 'এ আনন্দ তো সারা দেশের!'

বছর চল্লিশের সুনিবেশবাবু তাঁর স্বভাবে নির্লিপ্তই রইলেন এত বড় সাফল্যেও। দৃষ্টিতে কল্পনা, হয়ত সেই মুহূর্তেই কোনো উপন্যাসের বীজ গ্রথিত হচ্ছে তাঁর মননে।


লোকজন সব চলে গেলে রত্না জড়িয়ে ধরলেন স্বামীকে, 'এ আমার স্বপ্ন ছিল সু! তোমার নামে আমায় চিনুক পৃথিবী। আমি অহংকার করে বলব…'

মুখের কথা নিয়ে সুনিবেশবাবু বললেন, 'তোমার যে ছবিটা পাঠিয়েছিলে সর্বভারতীয় অঙ্কন প্রতিযোগিতায়, তার কী হল রত্না?'

রত্না স্বামীকে ছেড়ে এগিয়ে এলেন বিছানার দিকে। চাদরের ভাঁজ ঠিক করতে করতে বললেন, 'এত সহজ নয়, মশাই! নিজের পরিচয়ে পরিচিত হওয়া! সঠিক যোগ্যতা প্রয়োজন।'

দৃষ্টিশক্তিহীন মেয়ে অনুষ্কা পাশের ঘরে বেহালায় সুর তুলতে শুরু করেছে। সুনিবেশবাবু বললেন, 'এক কাপ চা দাও রত্না। অনুর সুর শুনতে শুনতে লেখাটা গুছিয়ে নিই।'

 

রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে রত্না ভাবলেন, 'এই মানুষ আসলে কী! এত আনন্দেও তাঁর মনে কোনো দোলা লাগে না? আমাকেও আনন্দ পেতে দিতে চান না তাঁর সাফল্যে! চান আমার পরিচয় হোক। আমার নিজের! এই কী তবে সম্মান? এই কী তবে সমতা? এই কী প্রকৃত ভালোবাসা?' মনে মনে ঈশ্বরকে প্রণাম করলেন রত্না, 'এমন মানুষ যেন প্রতি জন্মে জীবনে পাই আমি।'

পাশের ঘরে এসে মেয়ে অনুর মাথায় হাত রেখে বললেন, 'অনু! বাবার মত হ'স মা তুই!

বাবার মত।'

                 

।। তিন ।।


দিন দুই যেতে না যেতেই অনুপমা বাড়িতে আগত জ্যেঠুর লোভ আরো স্পষ্ট দেখতে পায়। নানা অছিলায় তাকে কাছে ডাকা, পায়ে, কপালে মালিশ করিয়ে নিতে নিতে দেশ বিদেশের যৌনতা নিয়ে কথা বলা অনুপমা কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। অথচ প্রতিবাদ করার উপায়ও তার ছিল না। সদ্য ফুটে উঠতে চাওয়া কুঁড়ির ভিতরে লাজুক মিষ্টতায় আবিষ্ট হল ঘৃণা। কিছুদিন এভাবে চলার পর সে মনে মনে স্থির করল, কোনো উপায়ে এনাকে এই বাড়ি থেকে বের করতেই হবে।

দেড় বছরের ছোট ভাই পড়াশোনায় অসাধারণ না হলেও দিদির প্রতি ভাব এবং দুষ্টুমিতে নেহাত সাধারণ না। জ্যেঠুর কাছে যেতে দিদির কুণ্ঠা, কান্নার কাঁধে হাত রাখল ভাই, 'দিদি চিন্তা করিস না আমরা ওনাকে ঠিক এ বাড়ি থেকে বের করব দেখিস।'


গভীর রাতে মুখের উপর কালো হাঁড়ি তার উপরে সাদা খড়ির চোখ মুখ, জ্যেঠুর ঘুমন্ত শরীরের সামনে দাঁড়িয়ে 'পালা বলছি মোহিতলাল!' চিৎকার এবং জ্যেঠুর ধড়ফড় করে উঠেই অজ্ঞান হওয়া, হঠাৎ ঘরের আলো জ্বলে ওঠা ও ভাই বিনুর ধরা পড়ে যাওয়া ভীত মুখ সব একসঙ্গে এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল যে অনুপমা নিজেও এতটা ভাবেনি। ভাইকে নিষেধ করলেও সে ভেবেছিল অত রাতে বাবা তো প্রতিদিনের মত ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাবেন, ভাই ভয় দেখিয়ে ফিরে পড়বে বাবা ওঠার আগেই নিশ্চয়। কিন্তু বাবা যে তখনো বিছানায় পিঠ পাতেননি নানা চিন্তায় তা দুই ভাই বোন কেউ ঠাহর করতে পারেনি। 

বিনুকে জোরে বকতেই বিনু প্রচন্ড রাগত স্বরে বলে উঠল, 'আমার দিদিকে দিয়ে পা টেপায় জ্যেঠু, আমি বেশ করেছি!'


প্রচন্ড মার খেল বিনু। সারাদিন খাওয়া বন্ধ হল অনুপমার। 'গুরুজনের প্রতি অশ্রদ্ধা! এই শিক্ষা তোমাদের?' মেজকাকা বললেন, 'তবে বলেছিলাম না আমি বন্ধু নিরপরাধ ছিল! এই অনুই বন্ধুদের পাল্লায় গোল্লায় গেছে। ওকে শিক্ষা দাও বৌদি!' 


দিন সাতেক পরে অনুপমা নিখোঁজ হয়। সারাদিন খোঁজাখুঁজির পরে যখন বাধ্য হয়ে পুলিশের শরণাপন্ন হতে নির্দেশ দিচ্ছেন বাবা মেজকাকাকে ঠিক তখন বাড়ির কাজের মেয়ে শম্পা অনুপমাকে প্রায় একপ্রকার জড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসে। একেবারে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। বাইরে এসে কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছে বলে, 'তোমাদের এই বড়লোকিপনা, এই সম্মান সম্মান করে হাঁক ছাড়া এসবের জন্যই এই মেয়েটা একদিন মরবে এই বলে দিলুম।'


রাতের অন্ধকারে সে জ্যাঠাকে বিসর্জন দিলেন অনুপমার বাবা, 'নেহাত তুমি আমার দাদা নইলে চাবকে পিঠের ছাল তুলে নিতাম আমি। আর কোনোদিন এ মুখো হবে না বলে দিলাম।'


।। চার ।।


অনির্বাণ ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছে। অনেকদিন যন্ত্রণা সহ্য করার পরে সে তার শক্ত মেরুদণ্ডে বলতে শিখেছে, 'ভালোবাসা কোনো অপরাধ নয়। আমি পাপিয়াকেই বিয়ে করব বড়দা!' রামকুমারবাবু কঠিন চোখ নামিয়ে চটির শব্দ তুলে প্রবেশ করেছেন আভিজাত্যের ঘরে। বড় বৌদি চোখের কোলে চিকচিকে জল দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন, 'অনি, ভালো থেকো দুজনে। মাঝে মাঝে তোমার দাদাকে লুকিয়ে ফোন কোরো ভাই!' মুখের আঁচল গলে কান্না নেমে এসেছে গালে বুকে।


পাপিয়াকে নিয়ে ঘর বেঁধেছে অনির্বাণ। নুন আনতে পান্তা ফুরালেও তাদের ভালোবাসা ফুরায় না। অনির্বাণের মনের ভিতরের বিষাদ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে, হন্যে হয়ে চাকরির চেষ্টা করে সে। চেষ্টা করতে করতে পেয়েও যায়। বাতাসে ভাসিয়ে দেয় আনন্দ। সাহস আর মিষ্টি নিয়ে একবার গিয়ে দাঁড়ায় দাদার মুখোমুখি।

-'কেন এসেছিস অনি?' দাদার কঠিন মুখ।

-'পাপিয়া খুব ভালো মেয়ে দাদা, হোক না অন্য জাতি, হোক না ভালোবাসা! তাও যখন ওকে মানলে না আমার কিছুই বলার নেই। আজ আমাদের আনন্দটুকু ভাগ করতে এসেছিলাম কেবল। আমি চাকরি পেয়েছি। এই মিষ্টিটুকু বিনু আর অনুকে দিলে খুব ভালো লাগবে।'

রামকুমারবাবুর দিকে মিষ্টির প্যাকেট বাড়াল অনির্বাণ। মুহূর্তের মধ্যে তার ঠাঁই হল জানলার বাইরে পথের ধূলায়। 

পাপিয়ার মাথা নিচু, চোখে জল।

অনির্বাণের চোখে আগুন, 'বড়দা! তোমার এই নিয়মগুলোর ফাঁসে পড়েই একদিন তুমি শেষ হবে, মিলিয়ে নিও।'

আড়ালে দাঁড়িয়ে বড় বৌদি বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

            

।। পাঁচ ।।


সুনিবেশবাবু নিজের ঘরে বসে বই পড়ছেন নাহয় কিছু লিখছেন নাহয় গভীর ভাবনায় মগ্ন রেখেছেন অন্তর, এমন সময় ঘরে এল অনুষ্কা। 

-'বাবা! আজ কলেজ যাবে না?' 

মুখ তুললেন সুনিবেশ, 

-'না রে মা আজ শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।' 

-'কী হয়েছে বাবা?' উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর অনুষ্কার।

-'না রে মা! তেমন কিছুই নয়। এমনিই।'

-'ও তাই বলো! তোমার মনের শরীর অসুস্থ!'

-'তুই আমার সত্যিকারের মা জানিস তো অনু!

ঠিকই বুঝতে পারিস আমার কখন কী হয়।'

-'তা মন কেন খারাপ বাবা তোমার? কোন লেখা নিয়ে বিব্রত?'

-'মনীষা। মনীষাকে কিছুতেই মারতে পারছি না। অথচ ওকে না মারলে আমার উপন্যাস কিছুতেই এগোবে না!'

-'বাবা, কোনো কোনো মৃত্যু জীবন বাঁচায়। যেমন মাছ। খাবি খায়, মরে আর আমাদের অসুখ ভাতে পাতের উপর সুপাচ্য ঝোল হয়ে পড়ে তাই না?'

-'অনু! তুই পারিসও মা! আচ্ছা তোর নতুন তোলা সুর আমায় কখন শোনাবি বল তো?'

-'তোমার মনীষার নতুন জীবন লাভের পরে।'

-'পাগলী আমার!'

রত্না আসেন, হাসেন, ভালোবাসেন। এ সংসারে বড় প্রেম, বড় মায়া। সুনিবেশ তাঁর কোনো কমতি রাখেননি। মেয়ের চোখে রাত্রি থাকলেও মেয়ে অনেক গুণের অধিকারী। তার সুরে জন্ম নেয় ফুল পাখি গাছ পৃথিবীও। তার সুরে মরুতে বৃষ্টি আসে নেমে, বৃষ্টিতে রোদ্দুর। রত্না আঁকেন। মনের খুশিতে নানারকম ভঙ্গিতে। না তাঁর কোনো উচ্চাশা নেই, নেই নিজের নামে নিজে গর্বিত হতে সে যতই তাঁর সু বলুন না কেন! তিনি এমন করেই বেঁচে থাকতে চান সারাজীবন।

সুনিবেশকে মনীষার গল্প এগোতে দিয়ে মা মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বেজে ওঠে টেলিফোন

-'হ্যালো স্যার! মনীষা বলছি!'


।। ছয় ।।


অনুপমার মনের মধ্যে ভয় থাকলেও বাবার প্রতি খানিক কৃতজ্ঞতাও আছে। বাড়িতে আর কোনো অযাচিত পুরুষ প্রবেশ করতে দেন না তিনি। চাকরবাকর দের মধ্যে মাত্র কিশোরীতেই সুন্দরী সুললিত অনুপমার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার মত কাউকে দেখলেই পত্রপাঠ বিদায় দিয়ে দেন তিনি। 

মেজকাকার বন্ধুবর্গ আগেই নিষিদ্ধ ছিল, ছোট ভাই বিনুকেও বলা হল, এ নিয়ম তার জন্যও। অনুপমা খানিক নিশ্চিন্ত হয়েই থাকত বাড়ির সময়টুকু। কিন্ত দু এক সপ্তাহ যাবৎ স্কুলে তার জন্য অপেক্ষা করে থাকছে এক অন্য অস্বস্তি। ক্লাস টেনের সুপ্রিয়দা তার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। কিছু যেন বলতে চায়, কী যে তার ভাষা বোঝে না অনুপমা। কেবল লজ্জায় মুখ নিচু করে থাকে সে। 


বিনুর হাতে একদিন এক ছোট্ট চিরকুট পাঠায় সুপ্রিয়, তাতে লেখা…'অনুপমা! আমি কিছুতেই বলতে পারব না কেবল বুঝে নাও।'

অনুপমা ভাইয়ের মুচকি হাসি চুপ করিয়ে বলল, 'এ কথা বাড়িতে বলিস না যেন ভাই!' চিরকুট ছিঁড়ে খুঁড়ে পড়ে রইল পথে। 


রাতে বিছানায় শুয়ে অনুপমা হৃদয়ের শেষ কিনারা অবধি খুঁজে এলেও সুপ্রিয়দাকে দেখতে পেল না। সুপ্রিয় তার কাছে ক্লাস টেনের প্রথম হওয়া শিক্ষকদের বাধ্য ছাত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।


তবুও স্কুলে সেই অস্বস্তি চলল, বিনুর হাসি, মাঝেমধ্যে 'বাবাকে বলে দেব!' ভয় দেখিয়ে চকলেট আদায় করা, মেজকাকার মাস্তানি, মায়ের কান্না, বাবার আভিজাত্য, নিরুদিষ্ট ছোটকা ও পাপিয়া কাকিমা এসব নিয়ে সময় এগিয়ে যেতে লাগল।


।। সাত ।।


-'মনীষা! বলো!'

-'স্যার আজ এলেন না কেন?'

-'শরীরটা ঠিক… কিন্তু তুমি ফোন করেছ কেন?'

-'আসলে স্যার আপনাকে খুব মিস করি তো তাই'

-'আমাকে মিস করো, না ক্লাস?'

-'আপনাকে।'

-'শোনো মনীষা! কথায় লাগাম দাও। আমি তোমার শিক্ষক। অহেতুক ফোন করে সময় নষ্ট কোরো না আমার!'


ফোন রাখার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই হই হই করে বাড়িতে ঢুকল কলেজের রাহুল, প্রিয়াংকা, বিক্রম, রানা, আর মনীষা। 'শুনলাম স্যারের শরীর খারাপ তাই দেখতে চলে এলাম।'

রত্না ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফ্রিজ খুলে মিষ্টি বের করে ট্রেতে সাজিয়ে পরিবেশন করলেন বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে। অনুষ্কা বেহালা বাজাল, ওরা সঙ্গত করল হাততালি দিয়ে, মুগ্ধতা দিয়ে। আর সুযোগ বুঝে মনীষা সুনিবেশের হাত ধরে বলে দিল, 'আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি স্যার।'


সুনিবেশ বেশ চিন্তিত। মনীষা রীতিমত সাহস দেখিয়ে ফেলছে দিনের পর দিন। ক্লাসে অতিরিক্ত মনোযোগ পেতে চাইছে। করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, স্টাফরুমে আসছে। বাড়িতে ফোন করছে, ভালোবাসি বলছে। সুনিবেশ এই চল্লিশের ঘরে এসে এক বিরাট ফ্যাসাদে পড়েছেন। এদের মনস্তত্ব তিনি বোঝেন। এরা নিজের জীবনকেও বাজি ধরতে পারে আবেগের জন্য। তিনি এও জানেন যে মোহ কেটে যাবে মনীষার, কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে বোঝানোর মত কিছুই করতে পারছেন না সুনিবেশ। 

অনেক ভেবে ফোন করলেন, 'মনীষা কলেজের পরে রেস্টুরেন্টে দেখা করো।'

হাতের উপর হাত রেখে মনীষা বলে, 'আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না স্যার।' হাত সরিয়ে সুনিবেশ তাকে বোঝান, 'এ হয় না মনীষা! হৃদয়ে প্রবেশ করা এত সহজ নয়! আমার স্ত্রী কন্যা সংসার থাকুক আর না, আমি এমন কিছু দেখিনি তোমার মধ্যে যা দিয়ে তোমায় ভালোবাসতে পারি।'

মনীষা বলে ওঠে, 

-'বলুন না স্যার! কী চাই আপনার?'

-আকাশ...মাটি...বৃষ্টি পারবে দিতে?'

-'এ তো কাব্য স্যার! আমি তো লিখতে পারি না!

ভালোবাসতে পারি।'

-'আমি লিখতে পারি, ভালোবাসতেও। শুধু হৃদয়ে বসতে দিই না। যাও ফিরে।'

 

কান্নায় ভেঙে পড়ে ছুটে যায় মনীষা। সুনিবেশ ভাবেন এত কঠিন না বললেও হত মেয়েটাকে। খুব ভুল হল তার। ভালোবাসার ভূত নামলে কাল সকালে তিনি মনীষাকে একবার ফোন করে নেবেন ভাবলেন।


সকালেই এল ফোনটা সুনিবেশের কাছে। 

-'মনীষা আত্মহত্যা করেছে স্যার! 

সুনিবেশ ছুটে গেল তার বাড়ি! এত দুরন্ত একটা প্রাণ কেবল তাঁর জন্য… কেন তিনি আর একটু সময় নিলেন না! কেন তিনি তাকে আরো বোঝালেন না? বুকের ভিতর একরাশ কান্না নিয়ে প্রবেশ করলেন মনীষার বাড়ি। নিথর দেহখানি শুয়ে আছে মেঝের উপর। মুখ ফ্যাকাশে, শরীরের সব রক্ত প্রায় বেরিয়ে গেছে কাটা শিরায়। মা-হারা মনীষার বৃদ্ধ বাবা কাছে এসে বললেন, 

-'কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিল না। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই মানসিক ভাবে অস্থির ছিল। এমন একটা যে করবে, ভাবিনি স্যার।'


সুনিবেশ বেরিয়ে এলেন। স্নান করলেন। কাঁদলেন। অনুষ্কা বাবার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, -'উপন্যাসের কতদূর গো বাবা? মনীষা কোথায়?'


।। আট ।।


অনির্বাণ পাপিয়ার এক ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। পাপিয়া নাম রেখেছে রিনি। অনির্বাণ অফিসে বের হয়ে গেলে তার সময় কাটে ওই রিনিকে নিয়েই। কিন্তু তাদের ভরা সুখের জীবনে কোথাও যেন সেই ছন্দ নেই, সেই আলো নেই। আসলে ভালোবাসার আকাশে মেঘ জমলে তা বৃষ্টি হয় খুব কম, মেঘের পাথর হয়ে যায়। অনির্বাণ রাত করে বাড়ি ফেরে, অফিসের কাজের চাপে রাতেও কম্পিউটারে কাজ করে। মেয়েকেও সময় দেয়না পর্যন্ত। শেষ বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতিও ক্ষীণ। রান্নায় নুন কম বেশি কিছুতেই কোনো প্রতিক্রিয়া নেই অনির্বাণের। এমন চলতে চলতে একদিন পাপিয়া রিনিকে নিয়ে ঘর ছাড়ে, হৃদয় ছেঁড়ে। নিতান্ত অভিমানে পাথুরে মেঘ বুকে নিয়ে চলে যায় দূরে। অনির্বাণ দিনরাত পরিশ্রম করে অফিসের টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে সুখ। অভিমান ফুলে ওঠে তার বুকেও, 'পাপিয়া বুঝল না আমি কাদের জন্য এত পরিশ্রম করি! কেন আমি সময় দিতে পারতাম না! মেয়েটাকেও নিয়ে চলে গেল! বেশ।

আমি কিছুতেই আনব না।'


দুইদিকে প্রবাহিত হয়ে চলল ভালোবাসা, মধ্যে অভিমানের নদী। সময় বাড়লে যে নদীতে বন্যা হয়, প্রশস্ত হয় খাত। পাপিয়া পথ দেখে, অনির্বাণও। কেউ এগিয়ে এসে সে পথের শেষ করে না। পাপিয়ার দাদা তাকে প্রস্তাব দেয়, 'এ সম্পর্ক টিকিয়ে কী লাভ? বিচ্ছেদের মামলা করে দে। টের পাক সে!'

পাপিয়া সময় চায়। এক বছর...দু বছর

অনির্বাণের বাড়িতে চিঠি আসে, বিচ্ছেদ চাই সম্পর্কের। ভালোবাসাহীন দুটো নাম আলাদা হওয়াই তো ভালো! অনির্বাণ উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে যায় এবার, 'না পাপু না! আমায় ক্ষমা করে দাও। আমার রিনিকে বুকে দাও আমার!'

পাপিয়ার দাদা ছুটে এসে ঘাড় ধরে বের করে দেয় অনির্বাণকে। 

-'এতদিন কোথায় ছিলে বাপু? এখন যেমনি টাকাপয়সা দিতে হবে, অমনি হুড়হুড় করে চলে এসেছ?' 

অনির্বাণ উদ্ভ্রান্তের মতোই বেরিয়ে এল আবার। বুকের ভিতরের অভাব তার মস্তিষ্কে পৌঁছাল। পায়ে হাতের স্নায়ুতে পৌঁছাল। চোখের তারায় ঘোলাটে জল, ঠোঁটের উপর এলোমেলো কথাদের ঘর। অনির্বাণ উন্মাদ হল। 


।। নয় ।।


রামকুমারবাবু ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছেন পুরুষতন্ত্রের কঠিন বেড়াজাল। আগল দিয়ে রাখা মা ঠাকুমার বন্দীত্ব। প্রবল প্রতিবাদ এসেছে মনে কিন্তু পরক্ষণেই উদাহরণ এসেছে সামনে, বেশি প্রশ্রয়ে চন্ডীবাবুর স্ত্রী পলাতক, অধিক ভালোবাসায় মুকুন্দ কাকার গায়ে হাত তোলেন জ্যেঠি। সংসারে খবরদারি করেন অলোক দাদার বৌদি, অলোক দাদার মায়ের উপর অত্যাচারেও দাদা চুপ। আর এই প্রৌঢ়ে বিনু উদ্ধার করে নিয়ে আসে তাঁর ছোট ভাই উন্মাদ অনির্বাণকে। চিকিৎসার খামতি রাখেননি তিনি। বছরখানেক ভর্তি রাখলেন মানসিক হাসপাতালে। তারপর নিয়ে এলেন বাড়িতে, ডাক্তারের পরামর্শ মতই। অবিবাহিত মেজ ভাই হাসল, বলল, 'ঠিক হয়েছে!' তারপর নিজের ব্যবসা বাড়াতে বড়দা রামকুমারবাবুর সম্পত্তির অনেকাংশ নিয়ে চলে গেল বিদেশে। 

রামকুমারবাবু, অসুস্থ ভাই, প্রৌঢ়া ভীত স্ত্রী, রূপবতী মেধাবী কন্যা এবং সহজ সরল বোকা পুত্র, তাঁর আভিজাত্যের শাসন নিয়ে এগিয়ে চললেন। 


অনুপমা অবসর পেলেই ছোটকার পাশে এসে বসে। অনির্বাণ খাতার পাতায় শুধুই মুখ এঁকে চলে। দুটো চোখ একটা নাক, ঠোঁট আর শূন্যতা। সে মুখ যে কার, শিশুর নাকি বৃদ্ধের নাকি পাপিয়ার বোঝার উপায় নেই। আঁকে আর কাটে। কাটে আবার আঁকে। অনুপমা অনির্বাণের চোখের জল মুছিয়ে দেয়, খায়িয়ে দেয়। কাটা ছবির পাশে পৃথিবী আঁকে। গাছপালা পাখি পশু বৃষ্টি।

অনির্বাণ ঘুমোতে ঘুমোতে কথা বলে ওঠে, -'পৃথিবীর কোথায় হৃদয় মেরামত হয় গো?'

অনুপমা সুপ্রিয়দার কথা ভাবে। ক্লাস টেনের সেই চিরকুট দেওয়ার পরে আর কোনোদিন সে কোনো কথা তাকে বলেনি। স্কুল শেষ হয়েছে তার। ভালো ফল করেছে। কলেজে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু অনুপমার স্কুল ফেরতা পথে দাঁড়িয়ে থেকেছে। চোখের কোণে চিকচিকে জল নিয়ে তাকিয়ে দেখেছে। বিনুর হাতে নোটস পাঠিয়ে বলেছে, -'তোর দিদির কাজে লাগতে পারে।'

অনুপমার মনের মধ্যে তৈরি হয়েছে মায়া। রাতের পর রাত জেগে থেকে সে মনকে প্রশ্ন করেছে, 'এই কী ভালোবাসা?' কোনো উত্তর দিতে দেয়নি সে মনকে। ছোটকার দিকে তাকিয়ে সব ছেঁড়া ছবির উপর পৃথিবী এঁকেছে। ঘাস পাতা ফুল ফল পাখি…


।। দশ ।।


রত্নাকে মনীষার সব কথা খুলে বলেছিলেন সুনিবেশ। রত্না মনীষার মৃত্যুতে কষ্ট পেলেও তাঁর স্বামীর দৃঢ়তায় খুশি হয়েছিলেন। সুনিবেশের উপন্যাসে মনীষার নতুন জন্ম হয়েছিল। মৃত্যুর পরের জন্ম। যা ভেবেছিলেন সুনিবেশ তা তিনি লিখতে পারেননি। মনীষার পুনর্জন্মের পরে তার হৃদয়ে তুলে দিয়েছেন তার ভালোবাসাকে। সে ভালোবাসা বিবাহিত নয়, সে ভালোবাসা রূঢ় নয়, সে ভালোবাসা অধ্যাপক নয়। তার মতোই ছুটে বেড়ায়, হেসে বেড়ায়। মনীষার বৃদ্ধ পিতাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন কন্যার নতুন জন্মের পরিচয়,  দিয়েছেন আনন্দ, প্রাপ্তি। 

হাততালি দিয়ে উঠেছে অনুষ্কা, 'এইতো চাই বাবা!

সবাই সুখী হোক, কী জীবনে কী গ্রন্থে।'

এসব অনেক দিন আগের কথা। সেই উপন্যাস সুনিবেশকে আরো বড় পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছে। শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক সুনিবেশ রত্না এবং রত্ন অনুষ্কাকে নিয়ে গড়ে চলেছেন দৌড়। স্ত্রী রত্না আঁকার খাতায় খানিক বিশ্রাম নিতে চাইলে তিনি ঠোঁটে চুম্বন করে বলেছেন, 'থেমে গেলে তো পূর্ণচ্ছেদ!' 

রত্না আবার শুরু করেছেন। অনুষ্কার সুরের সিডি বিক্রি হচ্ছে বেশ, সাংবাদিক ক্যামেরা কলম কাগজ যত্ন স্নেহ প্রেম একত্রে বাস করে যে ঘরে, তার নাম সুনিবেশ সু-নিবাস।

তথাপি ঘুমের মধ্যে মনীষা নেমে আসে। সুনিবেশের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, 'স্যার, একবার আমার হাতটা ধরবেন স্যার? কেবল একবার!' 

সুনিবেশ সে হাত ফিরিয়ে দেন। চিৎকার করেন, -'আমি তোমায় ভালোবাসি না মনীষা! কেন বুঝছ না! কেন মরে গেলে? কত তো ভালো ছেলে আছে! কেন আমার জন্য চলে গেলে তুমি?'

রত্না সুনিবেশের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। উঠিয়ে জল খায়িয়ে দেন। বলেন, 'এভাবে ওকে মনে রাখলে ওর আত্মার শান্তি হবে না যে!'


।। এগারো ।।


পাপিয়া কাঁদে। রিনি মায়ের বুকে মুখ গুঁজে জিজ্ঞেস করে, 'বাবা কোথায় মা?' 

পাপিয়া দাদার কাছে ছুটে যায়- 'দাদা একবার ওর কাছে আমি যাই!' দাদা কঠিন মুখে চোয়াল শক্ত করে, 'এ হয়না পাপু! আমাদের পরিবারের এক সম্মান আছে! ওই অহংকারী অভদ্র লোকের কাছে আর আমরা তোকে যেতে দেব না!' 

রিনিকে জড়িয়ে ধরে পাপিয়া। "তোর বাবা বাণিজ্যে গেছে বাবা। হিরে জহরত নিয়ে ফিরবে গান গাইতে গাইতে,

'আমার চাঁদের কণা রিনি মাগো

বাবা এসেছে জাগো জাগো'..."

রিনি বাবার গল্প শুনতে শুনতে বাবাকে বুনতে বুনতে ঘুমিয়ে যায় মায়ের বুকে।


পৃথিবীতে এমন কোনো কোনো মানুষ থাকে, তারা ঠিক ভুল ভালোবাসা সব বুঝতে পারে কিন্তু কোনোকিছুর ভালো খারাপ প্রয়োগ করতে পারেনা। অন্যায় হচ্ছে জেনেও প্রতিবাদ করতে পারে না। কৃত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে ইচ্ছে হলেও করতে পারে না। পাপিয়াও পারে না। 


প্রবল এক ঝড়ের বিকেলে বিনুর হাত ধরে পাপিয়ার সামনে তার দাদার বাড়িতে এসে দাঁড়ায় অনির্বাণ। এলোমেলো দৃষ্টি, অগোছালো পদক্ষেপ

পাপিয়া ডুগরে ওঠে, 

-'এ কী অবস্থা বিনু ওর?'

-''তোমাদের এতদিন খুঁজে পাইনি কাকিমা! কাকা ঠিকানা বলতে পারেনি। গতকাল হঠাৎ কাকার পুরানো ডায়েরির পাতায় খুঁজে পেয়েই…'

-'কিন্তু এরকম কী করে হল?'

-'আমি স্টেশনের পাশে পড়ে থাকতে দেখেছি কয়েক বছর আগে। জানিনা কী করে।'

-'বিনু ও কি আমায় চিনতে পারছে না? রিনি রিনি কোথায় গেলি মা, এই দেখ তোর বাবা ফিরে এসেছে, আয় দেখবি আয়।'


এগিয়ে আসে পাপিয়ার দাদা। 

-'কী রে তুই? এখন এই পাগলটার জন্য চোখের জল ফেলছিস?'

বিনু কাগজটা বাড়িয়ে দেয়। 

-'এতে কাকার সই করা আছে কাকিমা। তুমি মুক্ত। কাকাও। চলি।'


রিনির ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তখন অনির্বাণ বলে চলেছে, 

-'এক দেশে এক রাজা ছিল তার যে রানী মস্ত অভিমান তাদের মেয়ে… তাদের মেয়ের হারিয়ে গেছে গান…'

বিনু কাকাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল পাপিয়ার দাদার বাড়ি থেকে।


।। বারো ।।


রামকুমারবাবুর মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে পথে। হয়ত কাকতলীয়ভাবেই তাঁকে উদ্ধার করে সুপ্রিয়। বাড়ির লোকজন পৌঁছানোর আগেই প্রয়োজনীয় রক্ত তাঁর শরীরে পৌঁছে দেয়। বুকে হাত রেখে দেয় ভরসা। অনুপমার চোখ ছাপিয়ে নামে কান্না, অনুপমার মা সুপ্রিয়র মাথায় হাত রেখে বলেন, -'তুমি দেবদূত বাবা!' 

একটানা পনের দিন হাসপাতালে থাকার সময় সুপ্রিয় নিজের ছেলের মতই বিনুর পাশে পাশে থেকেছে। রামকুমারবাবু বাড়ি ফেরার আগে তার দিকে তাকিয়ে বলেছেন, 'এ রক্তের ঋণ কখনো শোধ করতে চাইব না, শুধু যদি কণামাত্র তোমায় দিতে পারি, ধন্য মনে করব।'


অনুপমার বাড়ানো হাতে হাত ছোঁয় সুপ্রিয় প্রথমবার। অনুপমা সে হাতে আঙুল দিয়ে লিখে দেয়, 'ভালোবাসি।' 


।। তের ।।


সুরের সাথে সাথে অনুষ্কা এক স্কুলে চাকরি নিল। রত্না এবং সুনিবেশ দুজনেই চেয়েছিলেন মেয়েও দাঁড়াক নিজের পায়ে। ব্রেইল শেখাতে শেখাতে সে সুর বোনে, সুর বুনতে বুনতে রবীন্দ্রনাথ শেখায়। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই অনুষ্কা এক ছাত্রপ্রিয় দিদিমণি হয়ে ওঠে। বড় কাছের হয়ে ওঠে স্কুল শুরুর গান, হাসি অন্ধকার পৃথিবীর আলোকময় নক্ষত্র। অনুষ্কার হৃদয় উৎসারিত হয়ে ভালোবাসা ধাবিত হয় কচি কন্ঠের সে আনন্দে। তারা আবৃত্তি করে, 'আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর,' অনুষ্কার বাজানো সুরের সঙ্গে গেয়ে ওঠে 'এ কি লাবণ্যে পূর্ন প্রাণ প্রাণেশ হে…' অনুষ্কা এক অন্য পৃথিবী খুঁজে পায়, অন্য আনন্দ। সুনিবেশ বলেন 'এই তো আকাশ! এইতো সোনার তরী! রাশি রাশি ভরে নাও হৃদয়।' 


সুনিবেশের কাছে রিসার্চ করে মেধাবী সুপ্রিয় কলেজে চাকরি পেয়েছে। অনুপমার সঙ্গে ভালোবাসার বিনিময় শেষে অন্তত মাসে একবার সে আসে স্যারের বাড়ি। সুনিবেশ সুপ্রিয়কে পেলেই বসে যায় ভাবাবেগে। রত্না নিয়ে আসেন সুপ্রিয়র পছন্দের মিষ্টি। পাশের ঘরে সুরের মূর্ছনা ওঠে অনুষ্কার। সেদিন সুপ্রিয় সকালে এসে কিছু সময় কাটানোর পরেই সুনিবেশ তার কাছে প্রস্তাব রাখে, 'আজ বাড়ির গাড়িটা একটু খারাপ হয়েছে সুপ্রিয়, অনুকে একটু পৌঁছে দেবে স্কুল? তুমি তো কলেজেই যাবে নাকি!'

সুপ্রিয়র কলেজের পথেই অনুষ্কার স্কুল। তাই সানন্দে রাজি হয় সুপ্রিয়। গাড়িতে উঠে পাশের সিটে বসে অনুষ্কা। 


-'এই এক গন্ধে আমি মাতাল হই, নেশাগ্রস্ত হই সুপ্রিয়!'

-'কোন গন্ধে?'

-'জানিনা!'

-'তবে বললে যে!'

-'দৃষ্টি নেই তো, ঘ্রাণ বড় প্রবল।'

-'তোমার স্কুল এসে গেছে অনুষ্কা।'


অনুষ্কা নেমে আসে গন্ধটাকে ছেড়ে। দীর্ঘদিন ধরে সে এই গন্ধে নেশাগ্রস্ত হয়, আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু এক ইন্দ্রিয়ের অক্ষমতা তাকে বলতে দেয়নি। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারেনি। আর অনুপমায় অনুরক্ত সুপ্রিয় কোনদিন সে অন্ধ চোখ, সে আসক্তি, সে সুরের অপেক্ষা বুঝতে পারেনি।

    

।। চোদ্দ ।।


অনুপমা সুপ্রিয়কে ভালোবাসে, সুপ্রিয় অনুপমাকে। রামকুমারবাবু বোঝেন, মনে মনে পছন্দ করেন কিন্তু প্রকাশ করেন না। বিনুর হাতে তুলে দেন পারিবারিক ব্যবসার ভার। অনির্বাণ ছাদের বাগানে ফুল ফোটায়, কাঁদে। অনুপমা সুপ্রিয়র সঙ্গে দেখা করে পরিকল্পনা করে কাকিমাকে যদি শেষবারের মত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যায়…

অনেক ভাবনা চিন্তা শেষ করে দুজনে গিয়ে উপস্থিত হয় পাপিয়ার দাদার বাড়ি।

-'এই শেষবার এসেছি কাকীমা! ছোটকার কান্না আর যে সহ্য হয়না!'

পাপিয়ার দাদা বেরিয়ে এসে বলে, 

-'তোমাদের সাহস তো কম নয়! ডিভোর্সের পর আবার এসেছো?'

পাপিয়া রিনির হাত ধরে এক ছুটে বাইরে এসে বলে, 

-'কীসের স্বার্থ দাদা তোমার? কেন আমায় এভাবে আটকে রেখেছ এত বছর? আমি তোমাদের কোন সম্মানে আঘাত দিয়েছি বলতে পারো? বাবা আমার নামে বাড়ি সম্পত্তি দিয়ে গেছে, ও বাড়ি চলে গেলে যদি তার ভাগ নিই এই ভয়ে তুমি আমায় রুদ্ধ করে রেখেছ দাদা! তুমি মানুষ?'

-'তোকে এসব কে বলেছে? তোর ভালোর জন্যই…'

পাপিয়ার বউদি এসে পাপিয়ার কাঁধে হাত রাখে। -'আমি বলেছি। ওদের দুজনের কষ্টের শ্বাস আমার জীবনেও পড়ছে যে গো!

পাপু তুমি যাও বোন।'


রিনি একছুটে বাবার বুকে পড়ে, মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, 

'সেই গানটা গাই মা? 

রিনি এসেছে জাগো বাবা

রিনি এসেছে জাগো…'


রামকুমারবাবু চোখ মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অনুপমা সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল, 'এভাবেই থেকো কিন্তু!'

সুপ্রিয় হাসল। বলল, 

'বুকের বামে হাত রেখো। যা শুনবে তাই আমি বলছি।'


।। পনের ।।


-'ও, সুপ্রিয় এসেছ? আজকেও আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে। অনুষ্কার এদিকে স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। একটু যদি…'

-'হ্যাঁ স্যার নিশ্চই!'


সুপ্রিয়র হাতের উপর হাত রেখে অনুষ্কা বলে, -'এইটুকুই চেয়েছিলাম। ক্ষমা করো। আর চাওয়ার কিছু নেই।'

সুপ্রিয় এবার বুঝতে পারে প্রথমবার। 

'অনুষ্কা আমার হৃদয় যে অনুপমার!'

-'বললাম না আর কিছু চাইনা আমার!

একটা ইন্দ্রিয় যে নেই আমার। সূর্যেও রাত। ভীষণ কষ্ট হয়, তবুও চাই কি? না চাই না। মাঝেমধ্যে সূর্যের গন্ধ নিয়ে নিই বুকে। ব্যাস!'

কথা বলতে বলতে, গন্ধ নিতে নিতে, ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে দিতে দুর্ঘটনা যে কখন ঘটে যায়!!


নিথর দেহ দুটো যখন সুনিবেশ আর রত্নার সামনে এসে পৌঁছায়, তখনও পৃথিবী পৃথিবীতেই।


রত্না পক্ষাঘাতে, সুনিবেশ বাকহীন, অনুপমা চেতনরহিত, রামকুমারবাবুর নামেই তালপুকুর বাড়িতে আভিজাত্য ভেঙে টুকরো করে বুক ফাটা আর্তনাদ…


সুনিবেশবাবুর উপন্যাসে তখন ঘোড়ায় চড়া সৈনিক প্রশ্ন করছে বাতাসকে, 'বলো তো! যুদ্ধ করতে করতে কবি হওয়া যায়?'


।। ষোলো ।।


কেটে গেছে আরো বছর তিনেক। অনির্বাণ সুস্থ হয়েছে। বিনু ব্যবসার কাজে দূর দেশে। রামকুমারবাবুর ওষুধের ডোজ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। অনুপমা চাকরি পেয়েছে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে সুনিবেশের বাড়ি যাতায়াত শুরু করেছে নিয়ম করে।

সুপ্রিয়র ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে অনুপমা আজ বুঝতে পেরেছে অধ্যাপক সুনিবেশ বাবুই সুপ্রিয়র জীবন ও সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি তথা জীবনদর্শনের গুরু। ডায়রির একটা পাতায় সুপ্রিয় লিখে গেছে, 'এরকম হাজার সুনিবেশ স্যারের জন্ম যদি আমি দিতে পারতাম!


অনুপমা রত্নার পক্ষাঘাতগ্রস্ত শরীরে যত্ন দেয়। ডাক্তারের সাহায্যে, পরম যত্নে সুনিবেশের বাকশক্তি ফিরিয়ে আনে। সুপ্রিয় তার স্যারের স্পর্শে আকাশ পেত, অনুপমা মাটি হয়ে ছুঁতে চায় সেই আকাশ।


সুনিবেশ বলে চলে, "বাতাস উত্তর দেয়, 'হ্যাঁ সৈনিক! তোমার হৃদয়ে যদি বাস করে আকাশ পর্বত অথবা তুমি যদি বুনতে পারো ভালোবাসা তবে নিশ্চিত তুমি কবি!'..."

লিখে চলে অনুপমা। 

সুনিবেশ আর লিখতে পারেন না এখন। 



লিখতে লিখতে অনুপমা বিভোর হয়। এক প্রায় বৃদ্ধ মানুষের মধ্যে সতেজ সুপ্রিয়কে খুঁজে পায়। তারপর আসে সেইদিন…

-'অনুপমা!'

-'হ্যাঁ স্যার…'

-'কী পাও তুমি?'

-'কী খোঁজো? সুপ্রিয়কে?'

-'আপনার মত বৃক্ষকে।'

-'কী চাও?'

-'আপনাকে। একটিবার।'

-'আমার সারা শরীরে আপনাকে রাখতে চাই।

সুপ্রিয়কে হৃদযে রেখে আপনাকে একটিবার ভালোবাসতে চাই।'

-'মনীষা?' 

-না, আমি অনুপমা। গাছ বুনতে চাই। ছায়াশীল, মায়াশীল, আর এক বৃক্ষ।'

চিৎকার করে ওঠেন সুনিবেশ।

-'এ হয়না!'

পাশের ঘরে রত্না বিছানা থেকে পড়ে যান।

সুনিবেশ অনুপমা ছুটে যান। 

রত্না বিড়বিড় করেন,

'তুমি কাউকে কষ্ট দেবে না সু! কাউকে না!'


।। সতের ।।


রামকুমারবাবু মেয়ের জন্য পাত্র দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর শরীরটাও ভালো যাচ্ছেনা। কিছু হয়ে যাওয়ার আগেই একটা ব্যবস্থা করতে হবে। রিনি আড়াল থেকে জ্যেঠু জেঠিমার আলোচনা শুনে সারা বাড়ি নেচে নেচে ফেরে, 'দিদির বিয়ে হবে! দিদির বিয়ে হবে!'


অনুপমা সুনিবেশের সামনে বসে, সুনিবেশ এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। 

-'এমন কেন করছো? তুমি বাচ্চা মেয়ে! আমার মেয়ের বয়সী উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ!

আমি এক সন্তানহারা পিতা, অসুস্থ স্ত্রীর স্বামী।'

-'আর এক বিরাট প্রতিভা! বিরাট বৃক্ষ! 

আমি একটা চারা চাই। শরীরে সেই বৃক্ষের স্পর্শ চাই।'

-'মনীষা চলে গিয়েছিল। তোমায় যেতে দেব না। কিন্তু শর্ত একটাই, যদি তোমার গর্ভে জন্ম নেয় কোনো উপন্যাস, তার নামকরণ আমি দেব না।

পারবে তো সামলাতে?'

-'পারব।'

অনুপমার দৃপ্ত কন্ঠস্বর।

'আমার হৃদয় যাকে ভালোবাসে, আমিও তাকে।'



বাইরে প্রবল ঝড়, অন্ধকার ঘর। দুটো অসম শরীর মিলে যাচ্ছে। জুড়ে যাচ্ছে। চারটে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে স্বর্গীয় ক্ষণ। রত্না পাশের ঘর থেকে বলে যাচ্ছেন ক্রমাগত, 'বড় যন্ত্রণা সু! ওকে ফিরিও না! মনীষাকে ফিরিও না! অভিশাপ লাগবে সু!'


।। আঠারো ।।


অনুপমার গর্ভ উন্নত হচ্ছে। রামকুমারবাবুর অভিজাত সত্তা ধুয়েমুছে এখন কেবল কান্না আসে। পাপিয়া আগলে রেখেছে তাকে। অনির্বাণ বারবার জানতে চেয়েছে, 'কার ফল এ গর্ভ?' তার নির্লিপ্ত ভীত মা সদর দরজা বন্ধ রেখেছে। বিনুও মেজকাকার পথ অনুসরণ করে বাড়ি ছেড়ে ব্যবসা নিয়ে চলে গেছে। অনির্বাণের ছোট চাকরির টাকায় ভাতের উপর জুটছে নুন। পড়শিরা থুথু ছিটিয়েছে, গালমন্দ করেছে, করুণা করেছে। 


অনুপমার পুত্র সন্তান হয়েছে। 


সুনিবেশের বাড়িতে দেখাশোনা করার দুটো লোক রেখেছে সরকার। ওষুধপত্র, হাসপাতাল, চিকিৎসা, যত্ন সবকিছু দিয়ে তারা বাঁচাতে চায় রত্ন সুনিবেশকে।


।। উনিশ ।।


ছোট্ট পাহাড়ঘেরা গ্রামে অনুপমা চাকরি নিয়ে এসেছে। কচি মুখে মা ডাক এসেছে। 

রামকুমারবাবু নাতি দেখার আগেই মারা গিয়েছিলেন, মা নাতি হওয়ার পরেও তার মুখ না দেখেই। 


অনুপমার কোলের আলো কচি পায়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায় আর ছড়া বলে। আঙুলে সুর তোলে। 

একটু বড় হয়ে স্কুলে ভর্তি হয়। আঙুল ওঠে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামেও। ছেলের কৌতূহল, 'কে আমার বাবা! বলো না মা!'


ছেলের প্রশ্নে অনুপমা উত্তর দেয়, 'যিনি সবার পিতা তিনিই তোমার। ঐ যে সূর্য উনি তোমার পিতা।'

পড়তে পড়তে, লিখতে লিখতে, সুনিবেশ বৃক্ষের  চারা বড় হয়। প্রতিভার বিচ্ছুরণ হয় তার। গল্পে কবিতার অবয়বে জীবন দর্শন ফুটে ওঠে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ছোট পাহাড়ি গ্রামের পিতৃপরিচয়হীন সুপ্রিয়। অনুপমা তার হৃদয়ের নামেই ছেলের নামকরণ করেছিল। 

ধীরে ধীরে সাহিত্যের অন্যতম পুরস্কার লাভ করে সে ছেলে। 


পুরস্কার লাভের পরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, 'সুপ্রিয় বাংলা সাহিত্যের এক প্রখ্যাত নাম। যদিও তাঁর পিতার পরিচয় জানা যায় না, হতে পারেন তিনি সত্যকাম, জাবালার পুত্র…'


।। কুড়ি ।।


পক্ষাঘাত সেরে গেছে রত্নার। একটু একটু করে তুলি ধরেছেন তিনি। সুনিবেশকে চা করে দিয়েছেন। হাতে হাত ধরে অনুষ্কার জন্য কেঁদেছেন। তার বেহালায়, ছবিতে পুষ্পস্তবক দিয়েছেন। 

সংবাদপত্রের অফিসে নিয়ে গেছেন।


গাড়ি থেকে নেমে সুনিবেশকে বলেছেন, 'আমি এই প্রথম তোমার অনুমতি ছাড়া কিছু করব। মাপ ক'রো।'


সাংবাদিকদের সামনে গিয়ে বলেছেন, 'কালকের সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় লিখবেন, 'সুপ্রিয়, অনুপমার সূর্য, সুনিবেশ বৃক্ষের ঔরস।'

-----------–----

SUJATA MISHRA

নুন

ছেলেবেলায় পাশেরবাড়িতে ভাত ফোটার গন্ধটাকে কাঁঠাল-চাঁপা বলে ডাকতাম আমি। সময় নির্দিষ্ট ছিল। বাটি হাতে সামনে দাঁড়াতেই হড়াশ করে গরম ফ্যান পড়ত তাতে। পড়ত বিরক্তি, উপচে পড়ত ধিক্কার, "আবাগিরা মরেও না!" 

মা খুব কাঁদত, আমি সেই ফ্যানের বাটি ধরতাম মায়ের চোখের নিচে, মা! নুনটা এতে দাও! আলোনা ফ্যান কি খাওয়া যায়?

-–------------------

SUJATA MISHRA


ভিক্ষুক ও ঈশ্বর

বাবু হে…

ডুবতাসি…

বাঁচায়ে লন!

বাবু হে...এ…!


ছেলেটা চিৎকার করে ওঠে

ওরা ডুবে যাচ্ছে!

ওরা মরে যাচ্ছে!

ওদের বাঁচাতে হবে!

কে আছো মন্দিরে?

কে আছো মূর্তিতে?

আমায় একবার ঈশ্বর বানিয়ে দাও!

আমি ওদের তুলে নিয়ে আসি।


ওরা আবার চিৎকার করে...

বাবু হে…

বাঁচায়ে লন!

ডুবতাসি…!


ছেলেটা ছুটতে থাকে।

ওরা ডুবে যাচ্ছে।


পথ আটকে ধরে ভিক্ষুক,

তিনদিন খাইনি বাবু!

ছেলেটা বিরক্তি ঢেলে দেয় তার পুঁটলিতে

আঃ! পথ ছাড়ো

আমায় ঈশ্বর হতে হবে!

ওরা যে ডুবে যাচ্ছে..

ওদের বাঁচাতে হবে!


ভিক্ষুক হাসে।

কোথায় ওরা?

নদী কোথায়?

সাগর?

ঈশ্বর হতে গেলে প্রথমে তোমাকেই নদী হতে হবে।

প্রথমে তোমাকেই ডুবতে হবে,

প্রথমে তোমাকেই ভিক্ষুক হতে হবে।


ছেলেটার প্রেমিকা ছেলেটাকে বলেছিল

তোমার জন্য প্রেম নয়, অসুখ দরকারি।


চলে যাওয়ার আগে ভিক্ষুক বলে গেল,

ডুবে যেতে যেতে যদি মন্দির অথবা

মূর্তি আঁকড়ে ধরো

তবে তোমার ঈশ্বর হওয়া নয়

অসুখ হওয়া দরকারি।


মন্দিরে ঝুলছিল তালা,

মূর্তিতে শুকনো ঘাস।


ছেলেটা দুটো কান চেপে ধরল

তারপর চিৎকার করল...

বাবু হে…

বাঁচায়ে লন…

আমি ঈশ্বর হতে চাই না…

ভিক্ষুকের ভিক্ষা হতে চাই!

বাবু হে…

  

-----------

Sujata Mishra