তোকে কতবার বলেছি, এ বাড়ির ধারে কাছে তুই আর আসবি না! ফের কেন এসেছিস তুই?
প্রাসাদোপম বাড়ির দারোয়ান আজও মেয়েটিকে প্রতিদিনের মত একই কথা বলে গেট থেকে দূর দূর করে বের করে দিল রাস্তায়। মেয়েটাও কাঁদতে কাঁদতে মিলিয়ে গেল শোঁ শোঁ ছুটে যাওয়া গাড়ির কেটে যাওয়া বাতাসের ধাক্কায় অথবা উড়ন্ত ধুলোর স্রোতে।
তবুও মেয়েটা রোজ আসে। মস্ত বাড়িটার সামনে দাঁড়ায়। রক্ষী গালিগালাজ করে ঠেলে দেয় পথে।
মাসখানেক চলার পরে একদিন মেয়েটার ডাক পড়ে ভিতরে। দুরুদুরু বুকে একরাশ খুশি নিয়ে মেয়েটা ভিতরে প্রবেশ করে। ঘরের দরজায় পা রাখতেই তার অপেক্ষার মানুষটি গম্ভীর কন্ঠে বলে
ওঠেন...নাম কী?
মেয়েটা মুখ নামিয়ে উত্তর দেয়, মায়া।
মানুষটি আবার জিজ্ঞেস করেন, কেন একমাস ধরে প্রতিদিন আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছিলে? কিছু কি বলার আছে আমায়?
মেয়েটা যেন লজ্জায় আরো মাথা নামিয়ে নিল। তারপর বলল, একবার শুধু জড়িয়ে ধরবেন আমায়?
মানুষটা থমকে গেলেন। তারপর মেয়েটার নিচু মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, এস!
মেয়েটা এসে মানুষটার বুকে মাথা রাখল। মানুষটাকে তার দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল।
তারপর মানুষটার বুকে মেয়েটা এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, কিন্তু আর নড়ল না।
দারোয়ান, কাজের লোক, ড্রাইভার, মালি ছুটে এল সকলে। মানুষটার বুক থেকে মেয়েটার মৃত শরীর নামিয়ে রাখল বিছানায়।
পুলিশ এল, মিডিয়া এল, কাকের মুখে খবর জানল পথ ঘাট, চায়ের দোকান, মাছের হাট…
কিছুদিনের জন্য বাড়িতে অনুপস্থিত মানুষটার স্ত্রী ফিরে এলেন বাড়ি, কান্নাকাটি এবং অগ্নি বিসর্জনের পর আবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। প্রচুর লোকজন, ক্যামেরা, হই হই এর মধ্যে মানুষটা সম্পূর্ণ একা।
ইন্সপেক্টর এসে বললেন, রাকেশবাবু, আর যাই হোক আপনার বয়সটা একটু ভেবে দেখতে পারতেন! মেয়েটার পিঠে বুকে কালশিটে, দাঁতের কামড়...যাই হোক এই বয়সে এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন, দেখি আপনার জন্য কী সুবিধা করতে পারি। চলি! বলে ফিরে যেতে গিয়েও ইন্সপেক্টর ফিরে এলেন মানুষটার কাছে।
ফিসফিস করে বললেন, এই বয়সে এমন এনার্জি ভাবা যায়না মশাই! আপনার সিক্রেটটা একটু জেনে যাব পরে এসে কিন্তু!
পরের দিন সারা দেশ জেনে গেল প্রখ্যাত বৃদ্ধ অভিনেতা রাকেশ জানা এক পঁচিশ বছরের তরুণীকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছেন তাঁর নিজেরই বাড়িতে। বাড়ির পরিচারক হঠাৎ দেখে ফেলায় হাতে নাতে ধরা পড়েছেন তিনি।
মানুষটার জীবনে নিঃসন্তান দাম্পত্য এতই সুখের যে রুপোলি জগৎও তাতে ঈর্ষান্বিত।
তবুও মানুষটাকে কেউ বিশ্বাস করল না। মানুষটা ইচ্ছে করেই অভিমানে কারো কাছে নিজের কথা বলল না। একটানা চুপচাপ বসে থাকার পর মেয়েটার সঙ্গে আনা ব্যাগটা যা পুলিশের চোখ এড়িয়েই গিয়েছিল, হঠাৎ মানুষটা তার থেকে এক ছেঁড়া খোঁড়া ডায়েরি বের করে সামনে খুলে বসল। মেয়েটার মৃত্যুর পর থেকেই যে তাঁর খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কে ছিল সেই মেয়ে? কেন এসেছিল তার কাছে এত আকুতি নিয়ে? কেন তার বুকে মাথা দিয়েই ঢলে পড়ল সে মৃত্যুতে?
ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা
... মা, তুমিও তোমার মায়াকে ছেড়ে চলে গেলে? এখন কে আমায় বাঁচিয়ে রাখবে এ পৃথিবীতে?
তারপরের প্রত্যেক পাতায় মায়ার কাকু কাকিমার অত্যাচার, অশিক্ষিত মদ্যপের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া, তার অত্যাচার এসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে।
কিন্তু কোথাও মানুষটার কথা তো লেখা নেই! তবে মেয়েটা একমাস ধরে রোজ কেন আসত তার বাড়ির সামনে?
ডায়েরি আবার ব্যাগে ভরতে যাওয়ার ঠিক মুহূর্তে পুরানো জ্যালজেলে ডায়েরির পাতার ভাঁজ থেকে খসে পড়ল রাকেশবাবুর অল্পবয়সের এক ছবি। উল্টো পিঠে লেখা, তোমার মেয়ে মায়া...পৃথিবী তো ভীষণ ছোট! যদি কোনোদিন দেখা হয় চিনে নিও।
মানুষটার কানের সামনে এক ফিসফিসে সুর ভেসে এল হঠাৎ,
...রাকেশদা, এবার কী হবে? যদি কিছু হয়?
...রাকেশদা! আমায় বিয়ে করবে তো?
মানুষটার ঠোঁট নড়ে উঠল, ...নিশ্চই করব! শুধু একবার সিনেমায় চান্সটা পেয়ে যাই!
...তুই কিন্তু অপেক্ষা করবি পুতুল! তোকে কী ভুলতে পারি রে, এই তো মায়া!
মনে পড়েছে! রাকেশবাবুর সব মনে পড়েছে। এত বড় অপরাধ করেছেন তিনি! রুপোলি জগতের স্রোতে ভেসে কবে যেন বেমালুম ভুলে গেছেন তাঁর পুতুলকে...তাঁদের সম্পর্কের মায়াকে।
ইন্সপেক্টর এলেন মানুষটার কাছে।
বললেন, মেয়েটার নাম মায়া। ওর বর মদ গাঁজা মেয়েমানুষ এই নিয়েই বুঝলেন কিনা…
রোজ বউ পেটাত। তাই মেয়েটির গায়ে কালশিটে ছিল। খেতে পরতেও দিতনা ঠিকঠাক। হার্টের প্রবলেমও ছিল মেয়েটার।
এই মাসখানেক হল ওরা ওই কলপারের বস্তিপাড়ায় এসে থাকতে শুরু করেছিল। মেয়েটির মৃত্যু যে কার্ডিয়াক আরাষ্টে হয়েছে, পোস্টমর্টেমে এখন তো তা পরিষ্কার। আর আপনার তাকে ধর্ষণের কোনো চিহ্ন পাওয়াও যায়নি। শুধু মরতে যে কেন আপনার কাছে এল, এটাই প্রশ্ন সবার এখন!
বৃদ্ধ মানুষটির বালিশের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে খিলখিল হাসি, ও বাবা! এবার বলো, কেমন শাস্তি দিলাম তোমায়? আমার মাকে ভুলে আমায় যন্ত্রণায় ফেলে এসেছিলে তাই না?
মানুষটা সেই স্বর ধরতে চান দুহাত দিয়ে জড়িয়ে! জীবনের সব সুখের একমাত্র অসুখটা হাউ হাউ করে ঢেলে দেন সেই স্বরে…
...মায়া! আর একবার বুকে আয়, মা'রে!
-----------------
SUJATA MISHRA
No comments:
Post a Comment