দ্বিভূজা-রূপেণ...

ভোলার মায়ের বড় আয়োজন!

রাত থাকতে উঠে মাটির দুয়ার নিকিয়ে রেখেছে।

দিঘি থেকে তুলে এনেছে লাল পদ্ম।

ভোলা নদীর ধারে গিয়ে কাশ ফুলের

শ্বেত ভেলা বানিয়ে এনে রেখেছে 

মায়ের আয়োজনে।


একটু সকাল হতেই পাড়ার লোকে

উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ভোলার মায়ের বাড়ি।

কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে বেড়ার ফাঁক

দিয়ে, ও ভোলার মা! এত আয়োজন!

তা তোমার ঠাকুর কই?

কেউ বললো,

...এই যে এ বছর নিজে নিজে দুগ্গা আনছো,

টাকা কড়ি বেশ ভালোই হয়েছে তবে বলো!


কিছুক্ষণ পরে ভোলার মায়ের দরজায় গাড়ি

থামলো এক।

নেমে এলো তসরের শাড়ি পরা এক ছিপছিপে রমণী।

ভোলার মা দৌড়ে গিয়ে তার হাত ধরে নিয়ে এলো

সেই আয়োজনে। 

আল্পনা আঁকা পিড়ি পেতে বললো, এসো মা দুগ্গা!

উঁকি মারা মুখ গুলো বিস্ময়ে চমকে ওঠে...

এটা কী রকম হলো!

তসরের শরীর সেই ছিপছিপে রমণী ভোলার মাকে 

জড়িয়ে বলে, কী বলছো তুমি?

আমি এক নিঃসন্তান সামান্য নারী!

ভোলার মা বেড়ার বাইরের দিকে উত্তর ছুঁড়ে দিল,

...মহালয়ায় দেখেছি অসুর নিধনে দেবতারা 

সব শক্তি একত্রিত করে জন্ম দেয় দশভূজার!

এই যে কমাস আগে মস্ত অসুখ গেল!

আমার ভোলা পড়লো সে অসুখে,

তুমি মা গো! 

ওর মায়ের মতন ওকে বাঁচিয়ে আনলে

হাসপাতাল থেকে!

নিধন করলে অসুখাসুর।

সবচেয়ে বড় যে অসুর; অভাব!

তার দিকে তুমি ধরলে তোমার দয়ার ত্রিশূল খানি তুলে,

কাজ না করেও আমি তোমার দানে পেট ভর্তি খাবার পেলাম, 

ঝড়ে উড়ে যাওয়া ঘরের নতুন ছাদ পেলাম।

বলো তো মা! তুমি না তো, কে আর দুর্গা আমার?


বাইরের ভিড় কমে যেতে লাগলো।

ছিপছিপে রমণীর গাল দিয়ে নেমে এলো গঙ্গা।

ভোলার মা ভোলাকে বললো, ভোলা প্রণাম কর!

আমাদের ঘরে স্বয়ং দেবী এসেছেন আজ!

অঞ্জলি নাও গো মা, আমাদের ...

দ্বিভূজা-রূপেণ সংস্থিতা!

নমস্তস্যৈ নমঃ নমঃ।

------------------

Sujata Mishra


বন্ধু

_ এই রাহুল! কেমন আছিস? বাব্বা কতদিন পরে দেখা আমাদের! 

_ হ্যাঁ রে চয়ন! এই ভয়ংকর অসুখ পেরিয়ে তবে তো আবার একসাথে হওয়া! দেখ না, মা-দুগ্গার মুখটাও কেমন মনখারাপ মনখারাপ!

রাহুল আর চয়ন বন্ধু। অসুখ শেষের পরে যখন মা দুর্গা এসেছেন মণ্ডপে মণ্ডপে, যখন অসুখ কমে এসেছে প্রায় একেবারেই, যখন সমাজে আবার শুরু হয়েছে নতুন ছন্দ, সেই সময় সপ্তমীর সকালে দুই বন্ধুর দেখা পাড়ায় ঠাকুর দেখতে গিয়ে। কথা বলতে বলতেই তাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হলো বিজিত, সৌম্য, পলাশরাও। হঠাৎ সৌম্যর চোখ পড়লো রাহুলের জামার দিকে, অবাক দৃষ্টিতে বললো, সব তো বুঝলাম রাহুল! কিন্তু পুজোর সকালে তুই নতুন জামা পরিসনি কেন? রাহুল ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসলো, বললো এমনি পরিনি রে। তোরা তো পরেছিস! বাঃ দেখতে কত ভালো লাগছে!

চয়ন বললো, আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। বিকেলে আমরা একটু ঘুরতে যাবো সবাই তৈরি হয়ে এইখানে চলে আসবি কিন্তু।


বিকেলে আবার সেই পাড়ার মণ্ডপে এসে হাজির হলো সব বন্ধুরা। সবার গায়ে সুন্দর নতুন পোশাকের আভিজাত্য, মনে আনন্দ। রাহুলও একটা সুন্দর আকাশি রঙের জামা পরে এসেছে। এবার ভ্রু কুঁচকে বিজিত বললো, রাহুল! এই জামাটা তো তোর আগের বছরের! তোর কাকু এনে দিয়েছিল কলকাতা থেকে! কী ব্যাপার বলতো? তোর বাবা তোকে একটাও জামা কিনে দেয়নি এবার? পলাশ হো হো করে হেসে উঠে বললো, আরে তোরা জানিস না? ওর বাবার কাজ নেই তো আর! লকডাউনের সময় গেছে সেটা!

ওরা বোধহয় খেতেও পায়না আর দেখ গিয়ে!

রাহুল বুঝতে পারলো না, বেড়াতে যাওয়ার সঙ্গে নতুন পোশাকের কী সম্পর্ক? তবে জীবনে প্রথমবার বুঝতে পারলো সেই ছোটবেলা থেকে এই ক্লাস এইট অবধি যাদের ও বন্ধু বলে মনে করেছে, তারা কেউ ওর বন্ধু নয়। কান্না চেপে বাড়ি ফিরে গেল সে।


অষ্টমীর পুজো দেখতে এসে বিজিত, পলাশ, সৌম্য আর চয়ন দেখে, তাদের পাড়ার সবচেয়ে গরীব মানুষ হারু কাকার চার ছেলে মেয়ে হাসতে হাসতে নতুন জামা পরে মণ্ডপে আসছে, হাতে পুজোর প্রসাদ নিয়ে আনন্দে ঘুরছে চারিদিক। সৌম্য ভারী অবাক হয়ে পলাশকে বলে, এত সুন্দর দামি দামি পোশাক ওরা কোথায় পেলো বলতো? পাশ থেকে শুনতে পেল হারু কাকার বড় ছেলে রাজু। বললো কেন! আমাদের বন্ধু দিয়েছে!

পলাশ মুখ বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোদের আবার বন্ধু! কে রে সে? স্বয়ং ভগবান নাকি? এমন সুন্দর সুন্দর জামা দেয়…

হারু কাকার মেয়ে রুমা ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে, শুধু জামা নয় গো, সেই ষষ্ঠী থেকে পেট পুরে খেতে পাচ্ছি আমরা! রাহুল দাদা আমাদের খুব ভালোবাসে, বন্ধু তো এমনই হয়, তাই না দাদারা?

কারো মুখ থেকে একটাও কথা বেরোয় না আর।


রাহুলের বাবার কাজ চলে যাওয়ার পরে তাদের বড় কষ্টে দিন কাটছে এটা ঠিক, তবুও তার বাবা রাহুলের কোনো অভাব রাখেননা, ভালোবেসে সবচেয়ে ভালো জামাই কিনতে চেয়েছিলেন পুজোয়, কিন্তু কেনাকাটা করার তোড়জোড় শুরু হতেই রাহুল তার সারা বছরের জমানো টাকার ছোট্ট বাক্সটা বের করে সে বাবার হাত দুটো ধরে তার মনের ইচ্ছাটা বলে। হারু কাকার বড় ছেলে রাজু রাহুলকে খুব ভালোবাসে। পেয়ারা এনে দেয় বাগান থেকে পেড়ে, পুকুরে নেমে শিখিয়ে দেয় সাঁতার, কেবল ওরা স্কুলে যায়না তাই রাহুলের মা ওদের সঙ্গে মিশতে দেননা বিশেষ। কিন্তু রাহুলের এরকম প্রস্তাবে তার বাবার সাথে সাথে মাও খুব খুশি হয়ে ওঠেন, নিজে মুখে বলেন পুজোর চারদিন ওরা আমাদের লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী, আর কার্তিক হবে তবে। ওদের পেট পুরে খাওয়াবো। রাহুল তো আনন্দে একেবারে কেঁদেই ফেলে।


সৌম্য, বিজিত, পলাশ চয়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভিতর এক উথালপাতাল আফসোস। 

কিছুক্ষণ পরে রাহুল তার আগের বছরের পুরনো জামা পরে মণ্ডপে ঢোকে। রাজু ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে নেয় তাকে, নতুন আর পুরানো পোশাক মিলে গিয়ে সৃষ্টি হয় বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। মা দুর্গার মুখে মনখারাপ মনখারাপ ভাবটা কেটে গিয়ে আলো ফুটে ওঠে একরাশ... 

রাহুল চয়নদের বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়ায়...বন্ধু হবি ফের একবার?

-----------–-------

Sujata Mishra

সংরক্ষণ ও মধ্যবিত্ত মার্কশিট

 


আমার নাম পার্বতী, পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়।

মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষার মার্কশিট আর নিম্নবিত্ত উঠোনের

মালিকানা ছিল আমার।

খুব ছোটোতেই বাবার মারণ ব্যাধি ধরা পড়েছিল।

মাধ্যমিকের এক মাস আগে অস্তাচলে চলে গেল

আমার মাথায় অসুস্থ অভাবী হাত রাখার প্রথম সেই স্নেহ।


সাদা থানে মোড়া মা বুঝতো না ফসলের হিসেব।

বাসন মাজার কাজ চাইতে গেলে ভদ্র দরজা চমকে উঠলো, 

...সে কী! ব্যানার্জী বাড়ির বউ!

জমির ধান, আলু ঘরে তুলে নিল কাকা।

আমি আর মা একসঙ্গে লড়াই করতে করতে 

উচ্চমাধ্যমিকের আগে ঝরে গেল মা।

নিভু নিভু সূর্যের দিকে তাকিয়ে আমি আমার অস্তাচলের 

রাস্তা খুঁজলাম,

কাকা বললো, বেশ বেশ অত কান্নাকাটির দরকার নেই, 

থাকবি, খাবি তোর কাকিমার দুটো কাজ করে দিবি…


পাড়ার লোকে কাকাকে খুব হিংসে করলো,

দাদার সম্পত্তি পেয়েছে অথচ মেয়েটাকে পড়াবে না!

জেদ করে কাকা আমাকে ভর্তি করে দিল কলেজে।

কাকিমার হাঁড়ি মুখ আরো হাঁড়ি দেখতে দেখতে আমি

সপ্তাহে দু একদিন কলেজ যেতাম।

কালি ঝুলি মেখে কাজ শেষ হলেই পরীক্ষার পড়া

মুখস্ত করতাম।

কাকিমা খোঁটা দিত পুজোর জোগাড়ে ভুল হলেও,

বামুন বাড়ির অলক্ষ্মী একটা! কোনো কাজ জানে না!

কাকার মেয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে দেখিয়ে দিত,

ইস্ত্রির কোনখানে কোঁচ রয়ে গেছে।

আমার চোখে এত জল থাকতো যে পরীক্ষার প্রশ্নই

ভালো করে দেখতে পেতাম না।

তবুও মধ্যবিত্ত মার্কশিট ভরে চলেছি ঝোলায়।

বাবার জমির ফসল বিক্রি করে গয়না পরেছে কাকিমা।


আমার নিম্নবিত্ত উঠোনে একদিন ভীষণ রাগ নেমে এলো।

ঝোলা হাতে বেরিয়ে পড়লাম চুপিচুপি,

রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করলাম, কেউ ভিক্ষে দেবে!

দৃষ্টি থামিয়ে পথ বললো ...নাম কী?

ধীরে ধীরে বললাম, পার্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়।

পথ দ্রুত এগোতে লাগলো।

বললো, হবে না হবে না। সংরক্ষণ চাই!

ইংরেজিতে যাকে বলে রিজার্ভেশন, বুঝেছো!

ভিক্ষেতেও রিজার্ভেশন?

পথ বললো আমার সঙ্গে এসো, ওই যে অফিস

ওখানে যাও, বলো কাজ চাই!

আমি এক ছুটে এগিয়ে গেলাম, চকচকে দিদিমণির

সামনে সব মার্কশিট উজাড় করে দিলাম।

উনি উল্টে পাল্টে বললেন, নাঃ! একে বন্দ্যোপাধ্যায়,

তায় মান মধ্য, অন্য কোনো কিছু হলে নাহয় বুঝতাম!


বেরিয়ে আসতেই পথ বললো, ওই দেখো ছোট অফিস, 

বেতন কম। যাও গিয়ে বলো।

আমি ভিতরে ঢুকে ঝোলা খুলতেই একমুখ দাড়ি বাবু

হাঁ হাঁ করে উঠলো, এ কী! এত ডিগ্রি! না না 

আপনার মর্যাদা রাখতে পারবো না এখানে সব ওই প্রাইমারি!

আমি ছিটকে বেরিয়ে এলাম।

পথ খুব জোরে হাসলো,

বাতাস আমার কানের পাশে এসে কেটে কেটে বলল

একে পার্বতী, দুইয়ে বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনে অসংরক্ষণ!

চারে…


আমি ছুটলাম, কেবল ছুটলাম।

নিম্নবিত্ত উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম।

আমার চারিদিকে গিজগিজ করছে কাকার লোভ,

কাকিমার গয়না, মধ্যবিত্ত মার্কশিট, অসংরক্ষণ আর

এত বড় পদবী ...বন্দ্যোপাধ্যায়!

আমি আমার পায়ের তলার মাটিতে আছাড় খেলাম বারবার!

চিৎকার করলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে…

আমি যদি পার্বতী, তবে আমার নটরাজ কই?

যে আমার দেহ কাঁধে নিয়ে ক্রোধে উদ্দাম নৃত্য করতে করতে বলবে, সংরক্ষণ কেন!

পদবী কেন?

নামের পরে শুধু মানুষ নয় কেন?


আমি পার্বতী, পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়।

মাটির ভিতরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে আমার ঝোলা

মধ্যবিত্ত মার্কশিট, আর নিম্নবিত্ত উঠোন।

শুধু কোনো নটরাজ এলো না আমার শরীরের এই বোঝ

কাঁধে তুলে নিতে।

এত বড় পদবী আর সংরক্ষিত সম্মানকে পীঠে ছড়িয়ে দিতে!

যদি দিত তবে সে সব পীঠের নাম হতো, 

না-সংরক্ষণ পীঠ, না-ভিক্ষা পীঠ, না-পদবী পিঠ।


আমি গর্ভ গৃহে প্রবেশ করে যাচ্ছি ক্রমশ!

চারিদিকের সংরক্ষণ সংরক্ষণ চিৎকারটা 

ঢাকা দিয়ে দিচ্ছে আমার অস্তিত্ব।


অনেক বছর পরে এক কবি এসে মাটির গন্ধ শুঁকে

তার খাতায় লিখে নিল, 

এই মাটিতে ডুবে আছে আনন্দ! 

সৃষ্টির কোনো সংরক্ষণ হয় না যে!

----------------------

Sujata Mishra


রাজা রাণীর গল্প


এক যে আছে রাজা,                    তার আছে ছয় রাণী

সবার মধ্যে থেকেও তবু                শরৎ অভিমানী!


শিশির হয়ে দুর্বা ভেজায়                শিউলি হয়ে মাটি,

আকাশ ঘিরে মেঘকে সাজায়        রোদও পরিপাটি।


কাশের ঢেউয়ে মন উদাসী            রাণীর ভীষণ শোক,

এমন সময় ঢাকের বাদ্যি               আঁকে মায়ের চোখ!


ঘাসে ঘাসে লুটায় খুশি                   রাণী ভীষণ হাসে,

নির্বিঘ্নে রাজামশাই                        বসেন রাণীর পাশে।

কুয়াশা ঘেরা চিবুক খানি                তুলে ধরেন হাতে,

মেঘ চোবানো চাঁদের মায়া             তখন রাজার ছাতে।


পুজোর গন্ধ শেষের পরে                ক্লান্ত যখন রাণী,

ঠিক তখনই রাজার ঘরে                হেমন্ত অভিমানী!

-----------------

Sujata Mishra

উলুপি


আমি পঞ্চসতীর সতী নই।

আমি ক্ষত্রিয় রাজকন্যা নই।

আমি অলংকার বিভূষিতা অহংকারী কুলবধূও নই।

আমি নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা উলুপি; সামান্যা নারীমাত্র।


আমার পতি সুপর্ণ নাগকে গড়ুর যখন হত্যা করলো

তখন আমার পরিচয় হলো, বিধবা রমণী।

অথচ আমার শরীরের সদ্য যৌবন যে সেই বৈধ্যবের দাস নয়, 

আমার শরীরের প্রত্যেক উত্তেজনার কেন্দ্রে

যে লুকিয়ে থাকতে পারে গোপন ইচ্ছে,

মাতৃত্বের জন্য যে ছটফট করতে পারে আমার গর্ভ,

আমার হৃদয়...

তা বুঝতে চাইলো না কেউ।

পিতার আলয়ে বৈধব্যের শৃঙ্খলা মানতে মানতে

আমি ইহজীবন অতিবাহিত করে দেবো, এই তো নিয়ম!


কিন্তু হঠাৎ সেদিন গঙ্গাবক্ষে দেখলাম এক অপূর্ব জ্যোতি!

চারিদিকে আলো হয়ে আছে মা গঙ্গার সব স্রোত।

কী অপূর্ব সুষমা সেই আলোয়!

মুহূর্তেই সদ্য যৌবনা আমার শরীরের উত্তেজনার সব

কেন্দ্র একত্রিত হয়ে গেলো।

সেই আলোর উৎসের কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে ভিক্ষা করলো...

আমায় কিছু দাও গো, ঋষি!

তুমি আমার বাড়ানো হাতে হাত রেখে বললে, 

কিন্তু আমি যে বিবাহিত!

দ্রৌপদী আর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গম দেখে ফেলার অপরাধে

ব্রহ্মচর্যে এসেছি!

তবুও তোমার এত রূপ! আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি নাগকন্যা!


আমি তোমার হাত আমার আগুন বুকে নিয়ে বললাম,

বিবাহ করবে আমায়, হে দেব?

তুমি বোধহয় তখন হৃদয় আর কর্তব্যের দোলাচলতায়

দোদুল্যমান ছিলে!

কর্তব্য তোমার কাছে শ্রেয় মনে হলেও আমার রূপ

তোমাকে স্থির থাকতে দেয়নি।

আমার পিতার অনুমতি নিয়ে তুমি আমাকে

স্বীকৃতি দিলে।

পাণ্ডু রাজার পুত্র তৃতীয় পাণ্ডব আমাকে

স্ত্রীর স্বীকৃতি দিলো।


আমি সারারাত আমার শরীরে তোমার উত্তাপ জড়িয়ে

রাখলাম।

তোমার চরণে নিজের ইচ্ছা সমর্পণ করলাম,

প্রভু! সন্তান চাই আমার!

আমার কাঁধে, কটিতে, পায়ের আঙুলে

তোমার যৌনতা আর করুণা রেখে 

পরদিন তুমি নিশ্চিন্তে বিদায় নিলে!


আমার অ-ক্ষত্রিয় অনার্য শরীর তোমার যৌনতা মিটিয়ে

তোমাকে কর্তব্যে ফিরিয়ে আনলো।

তুমি ব্রহ্মচর্যে এসে এমন অনাচার আর করতে পারো না!


আমি রয়ে গেলাম দ্বিতীয় স্বামীর স্মৃতি নিয়ে

পিতৃগৃহে।


কিন্তু ঠিক এরপর লোকমুখে শুনলাম

তুমি ব্রহ্মচর্য ছেড়ে চিত্রাঙ্গদার অপরূপ

লাবণ্যে মুগ্ধ হয়েছো।

আশ্রয় নিয়েছ তার পিতার রাজগৃহে।


লোকমুখে আরো শুনলাম, এর বেলায় কোনো কর্তব্যে তোমার কোনো ত্রুটি নেই!

কারণ চিত্রাঙ্গদা ক্ষত্রিয় বংশদ্ভূতা।

তুমি তার পিতাকে তোমার সন্তান উপহার দিতে চাও।


সে অবশ্য আমাকেও দিয়েছো।

তুমি না জানলেও দিয়ে গেছো আমাকে।

তোমার শুক্রাণু, তোমার বীর্য, তোমার বংশ ...

আমার ইরাবান।

আমি ওকে ভীষণ দৃঢ়তায় যুদ্ধের অগ্নিবর্ণ চিনিয়েছি।

ওকে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম শিখিয়েছি।


তারপর শুনেছি তোমার বংশের রাজসূয় যজ্ঞে যাচ্ছে

বিদুষী চিত্রাঙ্গদা,তার পুত্রকে নিয়ে।

আমি অনার্য রমণী! আমার কী আর পাণ্ডব রাজসূয়ে নিমন্ত্রিত হওয়া সাজে?



কিন্তু এরপর যখন যুদ্ধ শুরু হলো,

কুরুক্ষেত্রের ভয়ংকর যুদ্ধে তুমি প্রতিপক্ষ ভীষ্মকে

বধ করতে কোন্ আর্যের ভূমিকা পালন করলে, হে পতি!

শিখন্ডি কে সামনে বসিয়ে তুমি যুদ্ধের নতুন কৌশল

আবিষ্কার করলে?


ভীষ্মের ভ্রাতাগণ তোমায় অভিসম্পাত করলো

নরক দর্শনের।

গঙ্গা বক্ষে সিক্ত আমি তখন তোমার সু প্রার্থনা করছিলাম।

তাঁদের পায়ে মাথা কুটে আমি প্রতিকার জেনে নিলাম

সে অভিশাপের।

আমি তোমার স্ত্রী! তোমার মঙ্গল কামনাই আমার একমাত্র কাম্য।


আমার পুত্র ইরাবানকে ঠেলে দিলাম যুদ্ধে।

হে স্বামী! তোমার ঐ এক রাতের বীর্যস্খলন কী একেবারেই

স্মৃতির অতীত হয়ে গিয়েছিল? 

নাহয় তাতে তোমার প্রেম ছিলোনা! 

বারবার প্রমাণ করতে হলো ইরাবানকে

যে সে তোমার সন্তান!

পুত্রের পরিচয়ে তুমি তাকে যুদ্ধের অনুমতি দিলে ঠিকই

কিন্তু একবারও কি বুকে টেনে নিয়েছিলে তাকে?

নাওনি! যুদ্ধ করতে করতে তার মৃত্যুতেও নাও নি।


আমার শেষ আশ্রয় ছিন্ন হওয়ার পরেও 

তোমার নরক দর্শনের অভিশাপ মুক্ত করতে

ছুটে গেছি মনিপুর।

তোমার ভীত সন্তান বভ্রুবাহনকে উত্তেজিত করে

তোমাকে অভিসম্পাত থেকে মুক্ত করতে

তোমার সেই পুত্রের হাতে মৃত্যু ঘটিয়েছি।

চিত্রাঙ্গদা এসে আমাকে অনার্য বলে

অপমান করেছে! 

সঞ্জীবনী নাগমনি ছুঁইয়ে তোমার প্রাণ স্পন্দন এনেছি আমিই।


কিন্তু ঠিক এইবার তোমার চেতনা প্রস্ফুটিত হয়েছে।

তুমি আমার মত অনার্য রমণীকে দেবী বলে সম্বোধন করেছ!

হায়রে ভাগ্য! 

স্ত্রীর অধিকার পেতে চেয়ে আমি হয়ে গেলাম তোমার দেবী!


তুমি আমাকে হস্তিনাপুরে নিয়ে গেলে!

চারিদিকে কত প্রজা, তোমার জয়গান গাইলো।

তোমার স্ত্রী দ্রৌপদী আমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানালো।

সবাই তোমার এত স্ত্রীর মধ্যে আমাকেও একজন জানলো।

কিন্তু তোমাকে আর এক মুহূর্তও আমি পেলাম না।


এরপর যখন মহাপ্রস্থান করলে, যখন আর কিছুই 

নেই আমার,

তখন তোমাদের পঞ্চভ্রাতার সঙ্গে স্থান পেল

কেবল দ্রৌপদী!

আমি উলুপি, তৃতীয় পাণ্ডবের এক রাত্রির সহবাসী স্ত্রী।

পুত্রহারা এক অনার্য রমণী প্রবল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লাম

গঙ্গা বক্ষে।


তুমি ভাবলে, আত্মহত্যা।

দ্রৌপদী দুহাত কপালে তুলে প্রণাম করে বললো,

পতির শোক। আত্মার শান্তি হোক।


কিন্তু মা গঙ্গা জানলো, আমি ঠিক এইখান থেকে আবার শুরু করতে চাই।

আমি ঠিক এইখানে আবার জন্ম নিতে চাই

ব্রহ্মচর্যের অর্জুন হয়ে।

আর এরপর তুমি হবে অনার্য উলুপি।


এইখানে স্নানরত আমাকে দেখে 

তোমার বাহু বন্ধনে জড়িয়ে নেবে আমার হাত।

আমার উত্তাপে ভিজবে পূর্ণ এক রাত্রি।

তারপর কোনোদিন জীবনে আর অধিকার পেতে চাইবে না।

শুধুই তোমাকে উপেক্ষা করবো আমি। বিস্মৃত হবো।

সমস্ত অভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে,

তোমার পুত্রকে মৃত দেখেও শোক না করে 

তুমি আমার অভিশাপ মুক্তির উপায় ভেবে চলবে। 


বেঁচে ওঠার পরে আমি তোমাকে দেবী বলে ডাকবো।



এ জন্মের প্রত্যেক স্মৃতি তোমার ফিরে আসবে এইবার।

আমার মহাপ্রস্থানের পথে তুমি চিৎকার করে ডাকবে,

উলুপি! আমি অনার্য রমণী নই! আমি তৃতীয় পান্ডব

অর্জুন! আমাকে সঙ্গে নাও!

আমি আমার ভুবন ভোলানো হাসি নিয়ে দ্রৌপদীর

আগে আগে স্বর্গে গিয়ে উঠবো।

আমার অনার্য আত্মার উপর তখন গজানো আছে

অর্জুনের কায়া!

তোমার উলুপি শরীর আর ক্ষত্রিয় মন দেখে বড় মায়া

হবে আমার!

কিন্তু তোমার ঠিক তখন কী হবে?

ক্ষত্রিয়ের আভিজাত্য, নাকি অনার্যের অভিমান!


ঠিক এই খান থেকে শুরু হবে এক নতুন

মহাভারত।

তাই আমি গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিলাম, পতি!

অর্জুন যখন উলুপি আর অনার্য!

তার বুকে যখন কান্না আর অভিমান!

রাজসূয় যজ্ঞে তৃতীয় পাণ্ডব যখন অনাহুত!


গঙ্গাবক্ষের এই খানে শুরু হবে নতুন মহাভারত!

শুধু ব্যাসদেবের জেগে ওঠা অপেক্ষা।

শুধু ব্যাসদেবের জেগে ওঠা অপেক্ষা।

---------------

Sujata Mishra




'মা বিদ্বিষাবহৈ' ('Ma Vidwisawahai') 'May There Be No Enmity Among Us!'

Om 

'Lead Me From The Illusion To the Reality.'

'Lead Me From Darkness Of Ignorance To The Light Of Knowledge.'

'Lead Me From Death To The Immortality.'


(From Upanisad)


Between black board, chalk, table, chair,

and the green faces 

I have cherished being a bridge.


The inner strength 

of the saplings

been filled with light and air.


The seedlings have Photosynthesized on their own

Stood their ground 

on their own 

by themselves 

To become enormous trees 

that spread shade.


My bag is full

with self-satisfaction and bliss.

On the way,

the trees bowed to me,

I raised my hands blessing them:


Be Immortal!

   Be Immortal!


Then the war transpires,

The battle for development!  

Movements of progression!

The war of modernity!


Opposition, Antagonism

have been assigned 

to my black board, 

on my strong shoulders,

And on my 

uncompromising spine.


Sometimes, I’m rudely addressed as 

'Hey, Master!'

Sometimes as 

'Ohh, Shameless!'

Sometimes I’m deemed 

insincere and over waged!'

My knowledge is auctioned:

 ... A master worthy of a hundred rupees only!

 ... A master worthy of a couple of hundreds only!


The collar of my righteousness 

is twisted by 

civil sophistication.


Now,

I’m a virtual teacher through computers, mobiles, 

and online classes,

weaving the bridge

beyond phone screens 

to infinite galaxies.


I am The Teacher!


No matter which title you place before or after my name,

No matter how much you try 

to distort my backbone, 

Burying as much 

poison of hatred 

in your own body.

Still,

I will carve you into 

a doctor, 

an engineer, 

a lawyer.

Maybe, you sit on the throne of selfishness,

Maybe, you smile, 

a smile of insolence eyeing me.


Still,

I will raise my hands to say,

Not adversity, 

Not hatred, 

Speak love only.


If ever your throne is overthrown,

If ever you think of 

The 'Bliss Of Immortality'!

If ever you come again, 

running through the very bridge 

I weaved,

If you Call me … 

"Oh! My Teacher!:

Again I will raise my hands in blessings on your head ...,

And call out 


'Srinwantu Vishwe Amritashy Putra'

'Ma Vidwisawahai'


'Hear, Ye Children of Immortal Bliss!'

'May There Be No Enmity Among Us!'


At last, I will be far away

Blending with the beyond!

Still you will hear,

What your inner great soul is calling … 


'Asato Ma Sadgamaya

 

Tamoso Ma Jyotirgamaya


Mrityorma Amritam Gamaya'


Lead Me From The Illusion To the Reality.'

'Lead Me From Darkness Of Ignorance To The Light Of Knowledge.'

'Lead Me From Death To The Immortality.'

-----------------

Written By:

Sujata Mishra


Translated By:

Manabesh Middar

Premangshu Ghosh

Bandana Sengupta