বন্ধু

_ এই রাহুল! কেমন আছিস? বাব্বা কতদিন পরে দেখা আমাদের! 

_ হ্যাঁ রে চয়ন! এই ভয়ংকর অসুখ পেরিয়ে তবে তো আবার একসাথে হওয়া! দেখ না, মা-দুগ্গার মুখটাও কেমন মনখারাপ মনখারাপ!

রাহুল আর চয়ন বন্ধু। অসুখ শেষের পরে যখন মা দুর্গা এসেছেন মণ্ডপে মণ্ডপে, যখন অসুখ কমে এসেছে প্রায় একেবারেই, যখন সমাজে আবার শুরু হয়েছে নতুন ছন্দ, সেই সময় সপ্তমীর সকালে দুই বন্ধুর দেখা পাড়ায় ঠাকুর দেখতে গিয়ে। কথা বলতে বলতেই তাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হলো বিজিত, সৌম্য, পলাশরাও। হঠাৎ সৌম্যর চোখ পড়লো রাহুলের জামার দিকে, অবাক দৃষ্টিতে বললো, সব তো বুঝলাম রাহুল! কিন্তু পুজোর সকালে তুই নতুন জামা পরিসনি কেন? রাহুল ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসলো, বললো এমনি পরিনি রে। তোরা তো পরেছিস! বাঃ দেখতে কত ভালো লাগছে!

চয়ন বললো, আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। বিকেলে আমরা একটু ঘুরতে যাবো সবাই তৈরি হয়ে এইখানে চলে আসবি কিন্তু।


বিকেলে আবার সেই পাড়ার মণ্ডপে এসে হাজির হলো সব বন্ধুরা। সবার গায়ে সুন্দর নতুন পোশাকের আভিজাত্য, মনে আনন্দ। রাহুলও একটা সুন্দর আকাশি রঙের জামা পরে এসেছে। এবার ভ্রু কুঁচকে বিজিত বললো, রাহুল! এই জামাটা তো তোর আগের বছরের! তোর কাকু এনে দিয়েছিল কলকাতা থেকে! কী ব্যাপার বলতো? তোর বাবা তোকে একটাও জামা কিনে দেয়নি এবার? পলাশ হো হো করে হেসে উঠে বললো, আরে তোরা জানিস না? ওর বাবার কাজ নেই তো আর! লকডাউনের সময় গেছে সেটা!

ওরা বোধহয় খেতেও পায়না আর দেখ গিয়ে!

রাহুল বুঝতে পারলো না, বেড়াতে যাওয়ার সঙ্গে নতুন পোশাকের কী সম্পর্ক? তবে জীবনে প্রথমবার বুঝতে পারলো সেই ছোটবেলা থেকে এই ক্লাস এইট অবধি যাদের ও বন্ধু বলে মনে করেছে, তারা কেউ ওর বন্ধু নয়। কান্না চেপে বাড়ি ফিরে গেল সে।


অষ্টমীর পুজো দেখতে এসে বিজিত, পলাশ, সৌম্য আর চয়ন দেখে, তাদের পাড়ার সবচেয়ে গরীব মানুষ হারু কাকার চার ছেলে মেয়ে হাসতে হাসতে নতুন জামা পরে মণ্ডপে আসছে, হাতে পুজোর প্রসাদ নিয়ে আনন্দে ঘুরছে চারিদিক। সৌম্য ভারী অবাক হয়ে পলাশকে বলে, এত সুন্দর দামি দামি পোশাক ওরা কোথায় পেলো বলতো? পাশ থেকে শুনতে পেল হারু কাকার বড় ছেলে রাজু। বললো কেন! আমাদের বন্ধু দিয়েছে!

পলাশ মুখ বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোদের আবার বন্ধু! কে রে সে? স্বয়ং ভগবান নাকি? এমন সুন্দর সুন্দর জামা দেয়…

হারু কাকার মেয়ে রুমা ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে, শুধু জামা নয় গো, সেই ষষ্ঠী থেকে পেট পুরে খেতে পাচ্ছি আমরা! রাহুল দাদা আমাদের খুব ভালোবাসে, বন্ধু তো এমনই হয়, তাই না দাদারা?

কারো মুখ থেকে একটাও কথা বেরোয় না আর।


রাহুলের বাবার কাজ চলে যাওয়ার পরে তাদের বড় কষ্টে দিন কাটছে এটা ঠিক, তবুও তার বাবা রাহুলের কোনো অভাব রাখেননা, ভালোবেসে সবচেয়ে ভালো জামাই কিনতে চেয়েছিলেন পুজোয়, কিন্তু কেনাকাটা করার তোড়জোড় শুরু হতেই রাহুল তার সারা বছরের জমানো টাকার ছোট্ট বাক্সটা বের করে সে বাবার হাত দুটো ধরে তার মনের ইচ্ছাটা বলে। হারু কাকার বড় ছেলে রাজু রাহুলকে খুব ভালোবাসে। পেয়ারা এনে দেয় বাগান থেকে পেড়ে, পুকুরে নেমে শিখিয়ে দেয় সাঁতার, কেবল ওরা স্কুলে যায়না তাই রাহুলের মা ওদের সঙ্গে মিশতে দেননা বিশেষ। কিন্তু রাহুলের এরকম প্রস্তাবে তার বাবার সাথে সাথে মাও খুব খুশি হয়ে ওঠেন, নিজে মুখে বলেন পুজোর চারদিন ওরা আমাদের লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী, আর কার্তিক হবে তবে। ওদের পেট পুরে খাওয়াবো। রাহুল তো আনন্দে একেবারে কেঁদেই ফেলে।


সৌম্য, বিজিত, পলাশ চয়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভিতর এক উথালপাতাল আফসোস। 

কিছুক্ষণ পরে রাহুল তার আগের বছরের পুরনো জামা পরে মণ্ডপে ঢোকে। রাজু ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে নেয় তাকে, নতুন আর পুরানো পোশাক মিলে গিয়ে সৃষ্টি হয় বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। মা দুর্গার মুখে মনখারাপ মনখারাপ ভাবটা কেটে গিয়ে আলো ফুটে ওঠে একরাশ... 

রাহুল চয়নদের বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়ায়...বন্ধু হবি ফের একবার?

-----------–-------

Sujata Mishra

No comments:

Post a Comment