উলুপি


আমি পঞ্চসতীর সতী নই।

আমি ক্ষত্রিয় রাজকন্যা নই।

আমি অলংকার বিভূষিতা অহংকারী কুলবধূও নই।

আমি নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা উলুপি; সামান্যা নারীমাত্র।


আমার পতি সুপর্ণ নাগকে গড়ুর যখন হত্যা করলো

তখন আমার পরিচয় হলো, বিধবা রমণী।

অথচ আমার শরীরের সদ্য যৌবন যে সেই বৈধ্যবের দাস নয়, 

আমার শরীরের প্রত্যেক উত্তেজনার কেন্দ্রে

যে লুকিয়ে থাকতে পারে গোপন ইচ্ছে,

মাতৃত্বের জন্য যে ছটফট করতে পারে আমার গর্ভ,

আমার হৃদয়...

তা বুঝতে চাইলো না কেউ।

পিতার আলয়ে বৈধব্যের শৃঙ্খলা মানতে মানতে

আমি ইহজীবন অতিবাহিত করে দেবো, এই তো নিয়ম!


কিন্তু হঠাৎ সেদিন গঙ্গাবক্ষে দেখলাম এক অপূর্ব জ্যোতি!

চারিদিকে আলো হয়ে আছে মা গঙ্গার সব স্রোত।

কী অপূর্ব সুষমা সেই আলোয়!

মুহূর্তেই সদ্য যৌবনা আমার শরীরের উত্তেজনার সব

কেন্দ্র একত্রিত হয়ে গেলো।

সেই আলোর উৎসের কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে ভিক্ষা করলো...

আমায় কিছু দাও গো, ঋষি!

তুমি আমার বাড়ানো হাতে হাত রেখে বললে, 

কিন্তু আমি যে বিবাহিত!

দ্রৌপদী আর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গম দেখে ফেলার অপরাধে

ব্রহ্মচর্যে এসেছি!

তবুও তোমার এত রূপ! আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি নাগকন্যা!


আমি তোমার হাত আমার আগুন বুকে নিয়ে বললাম,

বিবাহ করবে আমায়, হে দেব?

তুমি বোধহয় তখন হৃদয় আর কর্তব্যের দোলাচলতায়

দোদুল্যমান ছিলে!

কর্তব্য তোমার কাছে শ্রেয় মনে হলেও আমার রূপ

তোমাকে স্থির থাকতে দেয়নি।

আমার পিতার অনুমতি নিয়ে তুমি আমাকে

স্বীকৃতি দিলে।

পাণ্ডু রাজার পুত্র তৃতীয় পাণ্ডব আমাকে

স্ত্রীর স্বীকৃতি দিলো।


আমি সারারাত আমার শরীরে তোমার উত্তাপ জড়িয়ে

রাখলাম।

তোমার চরণে নিজের ইচ্ছা সমর্পণ করলাম,

প্রভু! সন্তান চাই আমার!

আমার কাঁধে, কটিতে, পায়ের আঙুলে

তোমার যৌনতা আর করুণা রেখে 

পরদিন তুমি নিশ্চিন্তে বিদায় নিলে!


আমার অ-ক্ষত্রিয় অনার্য শরীর তোমার যৌনতা মিটিয়ে

তোমাকে কর্তব্যে ফিরিয়ে আনলো।

তুমি ব্রহ্মচর্যে এসে এমন অনাচার আর করতে পারো না!


আমি রয়ে গেলাম দ্বিতীয় স্বামীর স্মৃতি নিয়ে

পিতৃগৃহে।


কিন্তু ঠিক এরপর লোকমুখে শুনলাম

তুমি ব্রহ্মচর্য ছেড়ে চিত্রাঙ্গদার অপরূপ

লাবণ্যে মুগ্ধ হয়েছো।

আশ্রয় নিয়েছ তার পিতার রাজগৃহে।


লোকমুখে আরো শুনলাম, এর বেলায় কোনো কর্তব্যে তোমার কোনো ত্রুটি নেই!

কারণ চিত্রাঙ্গদা ক্ষত্রিয় বংশদ্ভূতা।

তুমি তার পিতাকে তোমার সন্তান উপহার দিতে চাও।


সে অবশ্য আমাকেও দিয়েছো।

তুমি না জানলেও দিয়ে গেছো আমাকে।

তোমার শুক্রাণু, তোমার বীর্য, তোমার বংশ ...

আমার ইরাবান।

আমি ওকে ভীষণ দৃঢ়তায় যুদ্ধের অগ্নিবর্ণ চিনিয়েছি।

ওকে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম শিখিয়েছি।


তারপর শুনেছি তোমার বংশের রাজসূয় যজ্ঞে যাচ্ছে

বিদুষী চিত্রাঙ্গদা,তার পুত্রকে নিয়ে।

আমি অনার্য রমণী! আমার কী আর পাণ্ডব রাজসূয়ে নিমন্ত্রিত হওয়া সাজে?



কিন্তু এরপর যখন যুদ্ধ শুরু হলো,

কুরুক্ষেত্রের ভয়ংকর যুদ্ধে তুমি প্রতিপক্ষ ভীষ্মকে

বধ করতে কোন্ আর্যের ভূমিকা পালন করলে, হে পতি!

শিখন্ডি কে সামনে বসিয়ে তুমি যুদ্ধের নতুন কৌশল

আবিষ্কার করলে?


ভীষ্মের ভ্রাতাগণ তোমায় অভিসম্পাত করলো

নরক দর্শনের।

গঙ্গা বক্ষে সিক্ত আমি তখন তোমার সু প্রার্থনা করছিলাম।

তাঁদের পায়ে মাথা কুটে আমি প্রতিকার জেনে নিলাম

সে অভিশাপের।

আমি তোমার স্ত্রী! তোমার মঙ্গল কামনাই আমার একমাত্র কাম্য।


আমার পুত্র ইরাবানকে ঠেলে দিলাম যুদ্ধে।

হে স্বামী! তোমার ঐ এক রাতের বীর্যস্খলন কী একেবারেই

স্মৃতির অতীত হয়ে গিয়েছিল? 

নাহয় তাতে তোমার প্রেম ছিলোনা! 

বারবার প্রমাণ করতে হলো ইরাবানকে

যে সে তোমার সন্তান!

পুত্রের পরিচয়ে তুমি তাকে যুদ্ধের অনুমতি দিলে ঠিকই

কিন্তু একবারও কি বুকে টেনে নিয়েছিলে তাকে?

নাওনি! যুদ্ধ করতে করতে তার মৃত্যুতেও নাও নি।


আমার শেষ আশ্রয় ছিন্ন হওয়ার পরেও 

তোমার নরক দর্শনের অভিশাপ মুক্ত করতে

ছুটে গেছি মনিপুর।

তোমার ভীত সন্তান বভ্রুবাহনকে উত্তেজিত করে

তোমাকে অভিসম্পাত থেকে মুক্ত করতে

তোমার সেই পুত্রের হাতে মৃত্যু ঘটিয়েছি।

চিত্রাঙ্গদা এসে আমাকে অনার্য বলে

অপমান করেছে! 

সঞ্জীবনী নাগমনি ছুঁইয়ে তোমার প্রাণ স্পন্দন এনেছি আমিই।


কিন্তু ঠিক এইবার তোমার চেতনা প্রস্ফুটিত হয়েছে।

তুমি আমার মত অনার্য রমণীকে দেবী বলে সম্বোধন করেছ!

হায়রে ভাগ্য! 

স্ত্রীর অধিকার পেতে চেয়ে আমি হয়ে গেলাম তোমার দেবী!


তুমি আমাকে হস্তিনাপুরে নিয়ে গেলে!

চারিদিকে কত প্রজা, তোমার জয়গান গাইলো।

তোমার স্ত্রী দ্রৌপদী আমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানালো।

সবাই তোমার এত স্ত্রীর মধ্যে আমাকেও একজন জানলো।

কিন্তু তোমাকে আর এক মুহূর্তও আমি পেলাম না।


এরপর যখন মহাপ্রস্থান করলে, যখন আর কিছুই 

নেই আমার,

তখন তোমাদের পঞ্চভ্রাতার সঙ্গে স্থান পেল

কেবল দ্রৌপদী!

আমি উলুপি, তৃতীয় পাণ্ডবের এক রাত্রির সহবাসী স্ত্রী।

পুত্রহারা এক অনার্য রমণী প্রবল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লাম

গঙ্গা বক্ষে।


তুমি ভাবলে, আত্মহত্যা।

দ্রৌপদী দুহাত কপালে তুলে প্রণাম করে বললো,

পতির শোক। আত্মার শান্তি হোক।


কিন্তু মা গঙ্গা জানলো, আমি ঠিক এইখান থেকে আবার শুরু করতে চাই।

আমি ঠিক এইখানে আবার জন্ম নিতে চাই

ব্রহ্মচর্যের অর্জুন হয়ে।

আর এরপর তুমি হবে অনার্য উলুপি।


এইখানে স্নানরত আমাকে দেখে 

তোমার বাহু বন্ধনে জড়িয়ে নেবে আমার হাত।

আমার উত্তাপে ভিজবে পূর্ণ এক রাত্রি।

তারপর কোনোদিন জীবনে আর অধিকার পেতে চাইবে না।

শুধুই তোমাকে উপেক্ষা করবো আমি। বিস্মৃত হবো।

সমস্ত অভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে,

তোমার পুত্রকে মৃত দেখেও শোক না করে 

তুমি আমার অভিশাপ মুক্তির উপায় ভেবে চলবে। 


বেঁচে ওঠার পরে আমি তোমাকে দেবী বলে ডাকবো।



এ জন্মের প্রত্যেক স্মৃতি তোমার ফিরে আসবে এইবার।

আমার মহাপ্রস্থানের পথে তুমি চিৎকার করে ডাকবে,

উলুপি! আমি অনার্য রমণী নই! আমি তৃতীয় পান্ডব

অর্জুন! আমাকে সঙ্গে নাও!

আমি আমার ভুবন ভোলানো হাসি নিয়ে দ্রৌপদীর

আগে আগে স্বর্গে গিয়ে উঠবো।

আমার অনার্য আত্মার উপর তখন গজানো আছে

অর্জুনের কায়া!

তোমার উলুপি শরীর আর ক্ষত্রিয় মন দেখে বড় মায়া

হবে আমার!

কিন্তু তোমার ঠিক তখন কী হবে?

ক্ষত্রিয়ের আভিজাত্য, নাকি অনার্যের অভিমান!


ঠিক এই খান থেকে শুরু হবে এক নতুন

মহাভারত।

তাই আমি গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিলাম, পতি!

অর্জুন যখন উলুপি আর অনার্য!

তার বুকে যখন কান্না আর অভিমান!

রাজসূয় যজ্ঞে তৃতীয় পাণ্ডব যখন অনাহুত!


গঙ্গাবক্ষের এই খানে শুরু হবে নতুন মহাভারত!

শুধু ব্যাসদেবের জেগে ওঠা অপেক্ষা।

শুধু ব্যাসদেবের জেগে ওঠা অপেক্ষা।

---------------

Sujata Mishra




No comments:

Post a Comment