চারুলতা

...চারু...দরজা খোল!

দরজার ভিতরে সিলিং থেকে ঝুলছিল মৃত চারু।


তার পায়ের নিচে মাটি নেই, বাতাস খেলছিল। মাথার উপর পাথর নয়, মাথা নিজেই হালকা হয়ে লুটিয়ে পড়েছিল ফাঁসির দড়ির গায়ে। চোখের কোলে কান্না নয়, ঠান্ডা ঘুম ঝরে পড়ছিল তার।


না, চারু দরজা খোলেনি। বাইরে থেকে ধাক্কা দিয়ে সে ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করেছিল তার অনাত্মীয় বাড়ির লোকজনেরা।  


চারুর অবশ্য মৃত্যু সেদিনই হয়েছিল যেদিন সে পৃথিবীতে প্রথম জন্ম নিয়েছিল। চার দিদির পরেও সে কন্যা হয়েই মায়ের কোলে এল...এই তো তার মৃত্যুর জন্য বড় কারণ! তাই তার কান্নায় বিগলিত হলেন না মা। বিরক্ত হলেন বাবা, কাকা, জ্যাঠা।

ঠাকুমা নাম রেখেছিলেন চারুলতা। বলেছিলেন, হোক না মেয়ে! মানুষ তো! দাদু হেসে বলেছিলেন, মেয়েমানুষ। 


ঠাকুমার মৃত্যুর পর দাদু বুঝেছিলেন মেয়েমানুষ পুরুষকে ছেড়ে চলে গেলে কী হয়। 


চারুর পরে আরো দুজন দুই পুরুষাঙ্গ নিয়ে একসাথে নেমে আসে মায়ের কোলে। মা প্রসব বেদনা ভুলে নেচে গেয়ে উঠতে চান যেন সেই মুহূর্তে! বাবা চারুসহ অন্য বোনদের বুঝিয়ে দেন, তোমাদের সব আলো ফুরালো এবার। নটে গাছ মুড়ালো... এটা কী আর বলতে পারেন বাপ হয়ে!


চারুর চার সু-কন্যা দিদির সুপাত্রে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল শীঘ্রই। চারুর বেলাই দেখা গেল মুশকিল। আসলে চারু ভাইদের পড়াশুনা শুনে শুনে মুখস্ত করে ফেলে তাড়াতাড়ি, গান গাইতে পারে রেডিওর সুরে সুরে, আকাশ নদী গাছ পাখি এমনকি বাতাসও আঁকতে পারে ভারী সুন্দর কিন্তু মায়ের হাজার শিক্ষাতেও সে বাসন মাজা, কুটনো কোটা, কাপড় কাচা, সেলাই ফোঁড়াই এসবে একেবারে দক্ষ নয়। ভীষণ মার, বকুনি কোনোকিছুতেই তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করেনা এসব। তাই পাত্রপক্ষের সামনে বারবার নাজেহাল হতে হয় চারুর বাবা মাকে। পাত্রের মা যদি জিজ্ঞেস করেন, সোয়েটার বুনতে পারো? চারু দুদিকে মাথা হেলিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলতে শুরু করে, আমি বিশেষ কিছুই পারিনা।


তবুও অনেক কষ্টে চারুর বিয়ে ঠিক হল অবশেষে একদিন। চারুর চার দিদি ভালো মত শিখিয়ে পড়িয়ে দিল, মুখে মুখে কথা বলবি না, সব সহ্য করবি। কালশিটে, লাথি ঝাঁটা, আধ পেটা ভাত, সব…


চারু চলে গেল। 


বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চারু ফিরে এল। 

তার শাশুড়ি লিখে পাঠিয়েছে তারই হাত দিয়ে…

আপনাদের মেয়ে সংসারের অনুপযুক্ত একেবারেই, আমার ছেলের আবার বিয়ে দিতে চাই। 


চারুলতা বেঁচে আছে, এটাই আর কেউ মনে রাখতে চায়না। চারু বারবার বাঁচতে চায়, ছবি আঁকে, গুনগুন গান গায় চিলেকোঠার ঘরে।

চারুর ছবি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ভাই। তার আকাশকে পায়ে মাড়িয়ে যান তার বাবা। ভাতের থালায় অভিশাপ মিশিয়ে তরকারি ঢেলে দেন মা। হা হুতাশ করে দিদিরা। 

চারু তবুও পথ বোনে। 


চারু পথ বোনে। দিনের পর দিন।

দিনের পর দিন,

সময়ের পর সময়।


তার বাড়ির আত্মীয়রা তার আত্মা ছাড়িয়ে অনেক দূরের পাতাল থেকে শব্দ পাঠায়…

চারু, বেঁচে আছিস?


চারু পথ বোনে। একটা একটা করে কাঁটা সরিয়ে একটাই ফুল দেখতে চায়, মেঘ সরিয়ে আকাশ।

কিন্তু দুটোতেই কেবল একটাই বাক্য শোনে সে, ...তুই বেঁচে আছিস চারু?


সিলিংয়ের সঙ্গে ঝুলছে চারু। 


তার পায়ের নিচে বাতাস যেমন খুশি তেমন উড়ছে, ভাসছে, আঁকছে। তারা যেন চারুর মৃত্যুতে আনন্দ করছে!

তাদের কাছে চারুর যেন এই প্রথমবার জন্ম হল।


...চারু তুই এ কী করলি? 

তার বাবা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। বিস্মিত বাবা যেন প্রথম কন্যার মৃত্যু দর্শন করলেন!


পাশের বাড়ির কোনো এক ছাত্র রবীন্দ্রনাথ পড়ছিল…


চারুলতাও মরে গিয়ে প্রমাণ করে গেল, সে বাঁচতে চেয়ে বারবার মরলেও এতদিন বেঁচেই ছিল!

––––––––––

SUJATA MISHRA

নষ্ট

দু কামরার ঘর, ছোট্ট ডাইনিং, একটা রান্নাঘর…

আমি, ভাই, বাবা, মা, হাবু কাকা গাদাগাদি ঠাসাঠাসি। একটা বিড়াল ব্যালকনি দিয়ে এসে রান্নাঘরে উঁকি দেয়। সুযোগ পেলেই দুধের বাটিতে গোঁফ চোবায়। মা খুন্তি ছোঁড়ে, মর মর!


আমার বিয়ের ফুল ফোটাতে চায় আমার মা, বাবা। চায়ের কাপে চুমুক দেয় ডাইনিংয়ে বসা লোকগুলো। বাবা মিউ মিউ করে বলতে শুরু করে, আমার মেয়ে রান্না বান্না সেলাই ফোঁড়াই সব পারে, শুধু বুদ্ধি একটু হালকা…

গলায় লাগে গরম চায়ে ডোবানো ঠোঁটগুলোর।


ওরা চলে গেলে মা ঝাঁটা তোলে, মর মর আবাগি!


ভাইয়ের বন্ধুর সরু গোঁফ, চওড়া বুক। আমার চোয়াল ছুঁয়ে চুক চুক করে, আহা রে এমন সুন্দর মুখ মামনদির! 

লোডশেডিং হয়ে যায় ঠাসাঠাসি ঘরে। মা বাবা বাজারে, হাবু কাকা ক্লাবে, ভাইয়ের পায়খানার চাপ…

ভাইয়ের বন্ধুর হাত নেমে আসে বুকে, নাভিতে, বিছানায়…


আমার মা আমায় মেরে মেরে মাড়িয়ে যাওয়া ধানক্ষেত বানিয়ে দেয়। গলা টিপে ধরে ভাই, নষ্ট একটা! ধিক্কার ছুঁড়ে দেয়। 

ক্ষ্যাপা পাগলের আবার শরীর! হাবু কাকা বলে। 

বাবা মাকে বলে, ওকে জিজ্ঞেস করো এ আগাছার বীজ কে পুঁতেছে জমিতে? 

কাঁদতে কাঁদতে বলি, ভাইয়ের বন্ধু কুশল…


কুশল আসে। হাসে। মুখ ভেঙায়।


দুই কামরার ঘরে কাঁদার ঘর আর বুক আছড়ানোর তক্তাপোষ কোনোটাই নেই আমার।


ভাই জোরে জোরে বৈষ্ণব পদাবলী পড়ে। মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান…

আমার তো বুদ্ধি হালকা। এসব কী এত সহজে বুঝতে পারি?


বড় বড় আলোর নীচে শুইয়ে ডাক্তার ছিঁড়ে নেয় কুঁড়ি। 


দু কামরার ঘরের মধ্যেই একটা ছোট্ট স্টোররুম, সেইখানে বাঁধা হয় আমায়। আমার বাক রুদ্ধ হয়। 


ভালোই! নইলে আমার হৃদয় ফুঁড়ে আসা বুদ্ধিহীন প্রশ্নটা মাকে অতিষ্ট করে তুলত…


ও মা! মাগো! কুশল কেন নষ্ট নয়? 

-----------------

SUJATA MISHRA