আমার নাম পার্বতী, পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়।
মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষার মার্কশিট আর নিম্নবিত্ত উঠোনের
মালিকানা ছিল আমার।
খুব ছোটোতেই বাবার মারণ ব্যাধি ধরা পড়েছিল।
মাধ্যমিকের এক মাস আগে অস্তাচলে চলে গেল
আমার মাথায় অসুস্থ অভাবী হাত রাখার প্রথম সেই স্নেহ।
সাদা থানে মোড়া মা বুঝতো না ফসলের হিসেব।
বাসন মাজার কাজ চাইতে গেলে ভদ্র দরজা চমকে উঠলো,
...সে কী! ব্যানার্জী বাড়ির বউ!
জমির ধান, আলু ঘরে তুলে নিল কাকা।
আমি আর মা একসঙ্গে লড়াই করতে করতে
উচ্চমাধ্যমিকের আগে ঝরে গেল মা।
নিভু নিভু সূর্যের দিকে তাকিয়ে আমি আমার অস্তাচলের
রাস্তা খুঁজলাম,
কাকা বললো, বেশ বেশ অত কান্নাকাটির দরকার নেই,
থাকবি, খাবি তোর কাকিমার দুটো কাজ করে দিবি…
পাড়ার লোকে কাকাকে খুব হিংসে করলো,
দাদার সম্পত্তি পেয়েছে অথচ মেয়েটাকে পড়াবে না!
জেদ করে কাকা আমাকে ভর্তি করে দিল কলেজে।
কাকিমার হাঁড়ি মুখ আরো হাঁড়ি দেখতে দেখতে আমি
সপ্তাহে দু একদিন কলেজ যেতাম।
কালি ঝুলি মেখে কাজ শেষ হলেই পরীক্ষার পড়া
মুখস্ত করতাম।
কাকিমা খোঁটা দিত পুজোর জোগাড়ে ভুল হলেও,
বামুন বাড়ির অলক্ষ্মী একটা! কোনো কাজ জানে না!
কাকার মেয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে দেখিয়ে দিত,
ইস্ত্রির কোনখানে কোঁচ রয়ে গেছে।
আমার চোখে এত জল থাকতো যে পরীক্ষার প্রশ্নই
ভালো করে দেখতে পেতাম না।
তবুও মধ্যবিত্ত মার্কশিট ভরে চলেছি ঝোলায়।
বাবার জমির ফসল বিক্রি করে গয়না পরেছে কাকিমা।
আমার নিম্নবিত্ত উঠোনে একদিন ভীষণ রাগ নেমে এলো।
ঝোলা হাতে বেরিয়ে পড়লাম চুপিচুপি,
রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করলাম, কেউ ভিক্ষে দেবে!
দৃষ্টি থামিয়ে পথ বললো ...নাম কী?
ধীরে ধীরে বললাম, পার্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়।
পথ দ্রুত এগোতে লাগলো।
বললো, হবে না হবে না। সংরক্ষণ চাই!
ইংরেজিতে যাকে বলে রিজার্ভেশন, বুঝেছো!
ভিক্ষেতেও রিজার্ভেশন?
পথ বললো আমার সঙ্গে এসো, ওই যে অফিস
ওখানে যাও, বলো কাজ চাই!
আমি এক ছুটে এগিয়ে গেলাম, চকচকে দিদিমণির
সামনে সব মার্কশিট উজাড় করে দিলাম।
উনি উল্টে পাল্টে বললেন, নাঃ! একে বন্দ্যোপাধ্যায়,
তায় মান মধ্য, অন্য কোনো কিছু হলে নাহয় বুঝতাম!
বেরিয়ে আসতেই পথ বললো, ওই দেখো ছোট অফিস,
বেতন কম। যাও গিয়ে বলো।
আমি ভিতরে ঢুকে ঝোলা খুলতেই একমুখ দাড়ি বাবু
হাঁ হাঁ করে উঠলো, এ কী! এত ডিগ্রি! না না
আপনার মর্যাদা রাখতে পারবো না এখানে সব ওই প্রাইমারি!
আমি ছিটকে বেরিয়ে এলাম।
পথ খুব জোরে হাসলো,
বাতাস আমার কানের পাশে এসে কেটে কেটে বলল
একে পার্বতী, দুইয়ে বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনে অসংরক্ষণ!
চারে…
আমি ছুটলাম, কেবল ছুটলাম।
নিম্নবিত্ত উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম।
আমার চারিদিকে গিজগিজ করছে কাকার লোভ,
কাকিমার গয়না, মধ্যবিত্ত মার্কশিট, অসংরক্ষণ আর
এত বড় পদবী ...বন্দ্যোপাধ্যায়!
আমি আমার পায়ের তলার মাটিতে আছাড় খেলাম বারবার!
চিৎকার করলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে…
আমি যদি পার্বতী, তবে আমার নটরাজ কই?
যে আমার দেহ কাঁধে নিয়ে ক্রোধে উদ্দাম নৃত্য করতে করতে বলবে, সংরক্ষণ কেন!
পদবী কেন?
নামের পরে শুধু মানুষ নয় কেন?
আমি পার্বতী, পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়।
মাটির ভিতরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে আমার ঝোলা
মধ্যবিত্ত মার্কশিট, আর নিম্নবিত্ত উঠোন।
শুধু কোনো নটরাজ এলো না আমার শরীরের এই বোঝ
কাঁধে তুলে নিতে।
এত বড় পদবী আর সংরক্ষিত সম্মানকে পীঠে ছড়িয়ে দিতে!
যদি দিত তবে সে সব পীঠের নাম হতো,
না-সংরক্ষণ পীঠ, না-ভিক্ষা পীঠ, না-পদবী পিঠ।
আমি গর্ভ গৃহে প্রবেশ করে যাচ্ছি ক্রমশ!
চারিদিকের সংরক্ষণ সংরক্ষণ চিৎকারটা
ঢাকা দিয়ে দিচ্ছে আমার অস্তিত্ব।
অনেক বছর পরে এক কবি এসে মাটির গন্ধ শুঁকে
তার খাতায় লিখে নিল,
এই মাটিতে ডুবে আছে আনন্দ!
সৃষ্টির কোনো সংরক্ষণ হয় না যে!
----------------------
Sujata Mishra