দ্বিভূজা-রূপেণ...

ভোলার মায়ের বড় আয়োজন!

রাত থাকতে উঠে মাটির দুয়ার নিকিয়ে রেখেছে।

দিঘি থেকে তুলে এনেছে লাল পদ্ম।

ভোলা নদীর ধারে গিয়ে কাশ ফুলের

শ্বেত ভেলা বানিয়ে এনে রেখেছে 

মায়ের আয়োজনে।


একটু সকাল হতেই পাড়ার লোকে

উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ভোলার মায়ের বাড়ি।

কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে বেড়ার ফাঁক

দিয়ে, ও ভোলার মা! এত আয়োজন!

তা তোমার ঠাকুর কই?

কেউ বললো,

...এই যে এ বছর নিজে নিজে দুগ্গা আনছো,

টাকা কড়ি বেশ ভালোই হয়েছে তবে বলো!


কিছুক্ষণ পরে ভোলার মায়ের দরজায় গাড়ি

থামলো এক।

নেমে এলো তসরের শাড়ি পরা এক ছিপছিপে রমণী।

ভোলার মা দৌড়ে গিয়ে তার হাত ধরে নিয়ে এলো

সেই আয়োজনে। 

আল্পনা আঁকা পিড়ি পেতে বললো, এসো মা দুগ্গা!

উঁকি মারা মুখ গুলো বিস্ময়ে চমকে ওঠে...

এটা কী রকম হলো!

তসরের শরীর সেই ছিপছিপে রমণী ভোলার মাকে 

জড়িয়ে বলে, কী বলছো তুমি?

আমি এক নিঃসন্তান সামান্য নারী!

ভোলার মা বেড়ার বাইরের দিকে উত্তর ছুঁড়ে দিল,

...মহালয়ায় দেখেছি অসুর নিধনে দেবতারা 

সব শক্তি একত্রিত করে জন্ম দেয় দশভূজার!

এই যে কমাস আগে মস্ত অসুখ গেল!

আমার ভোলা পড়লো সে অসুখে,

তুমি মা গো! 

ওর মায়ের মতন ওকে বাঁচিয়ে আনলে

হাসপাতাল থেকে!

নিধন করলে অসুখাসুর।

সবচেয়ে বড় যে অসুর; অভাব!

তার দিকে তুমি ধরলে তোমার দয়ার ত্রিশূল খানি তুলে,

কাজ না করেও আমি তোমার দানে পেট ভর্তি খাবার পেলাম, 

ঝড়ে উড়ে যাওয়া ঘরের নতুন ছাদ পেলাম।

বলো তো মা! তুমি না তো, কে আর দুর্গা আমার?


বাইরের ভিড় কমে যেতে লাগলো।

ছিপছিপে রমণীর গাল দিয়ে নেমে এলো গঙ্গা।

ভোলার মা ভোলাকে বললো, ভোলা প্রণাম কর!

আমাদের ঘরে স্বয়ং দেবী এসেছেন আজ!

অঞ্জলি নাও গো মা, আমাদের ...

দ্বিভূজা-রূপেণ সংস্থিতা!

নমস্তস্যৈ নমঃ নমঃ।

------------------

Sujata Mishra


বন্ধু

_ এই রাহুল! কেমন আছিস? বাব্বা কতদিন পরে দেখা আমাদের! 

_ হ্যাঁ রে চয়ন! এই ভয়ংকর অসুখ পেরিয়ে তবে তো আবার একসাথে হওয়া! দেখ না, মা-দুগ্গার মুখটাও কেমন মনখারাপ মনখারাপ!

রাহুল আর চয়ন বন্ধু। অসুখ শেষের পরে যখন মা দুর্গা এসেছেন মণ্ডপে মণ্ডপে, যখন অসুখ কমে এসেছে প্রায় একেবারেই, যখন সমাজে আবার শুরু হয়েছে নতুন ছন্দ, সেই সময় সপ্তমীর সকালে দুই বন্ধুর দেখা পাড়ায় ঠাকুর দেখতে গিয়ে। কথা বলতে বলতেই তাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হলো বিজিত, সৌম্য, পলাশরাও। হঠাৎ সৌম্যর চোখ পড়লো রাহুলের জামার দিকে, অবাক দৃষ্টিতে বললো, সব তো বুঝলাম রাহুল! কিন্তু পুজোর সকালে তুই নতুন জামা পরিসনি কেন? রাহুল ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসলো, বললো এমনি পরিনি রে। তোরা তো পরেছিস! বাঃ দেখতে কত ভালো লাগছে!

চয়ন বললো, আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। বিকেলে আমরা একটু ঘুরতে যাবো সবাই তৈরি হয়ে এইখানে চলে আসবি কিন্তু।


বিকেলে আবার সেই পাড়ার মণ্ডপে এসে হাজির হলো সব বন্ধুরা। সবার গায়ে সুন্দর নতুন পোশাকের আভিজাত্য, মনে আনন্দ। রাহুলও একটা সুন্দর আকাশি রঙের জামা পরে এসেছে। এবার ভ্রু কুঁচকে বিজিত বললো, রাহুল! এই জামাটা তো তোর আগের বছরের! তোর কাকু এনে দিয়েছিল কলকাতা থেকে! কী ব্যাপার বলতো? তোর বাবা তোকে একটাও জামা কিনে দেয়নি এবার? পলাশ হো হো করে হেসে উঠে বললো, আরে তোরা জানিস না? ওর বাবার কাজ নেই তো আর! লকডাউনের সময় গেছে সেটা!

ওরা বোধহয় খেতেও পায়না আর দেখ গিয়ে!

রাহুল বুঝতে পারলো না, বেড়াতে যাওয়ার সঙ্গে নতুন পোশাকের কী সম্পর্ক? তবে জীবনে প্রথমবার বুঝতে পারলো সেই ছোটবেলা থেকে এই ক্লাস এইট অবধি যাদের ও বন্ধু বলে মনে করেছে, তারা কেউ ওর বন্ধু নয়। কান্না চেপে বাড়ি ফিরে গেল সে।


অষ্টমীর পুজো দেখতে এসে বিজিত, পলাশ, সৌম্য আর চয়ন দেখে, তাদের পাড়ার সবচেয়ে গরীব মানুষ হারু কাকার চার ছেলে মেয়ে হাসতে হাসতে নতুন জামা পরে মণ্ডপে আসছে, হাতে পুজোর প্রসাদ নিয়ে আনন্দে ঘুরছে চারিদিক। সৌম্য ভারী অবাক হয়ে পলাশকে বলে, এত সুন্দর দামি দামি পোশাক ওরা কোথায় পেলো বলতো? পাশ থেকে শুনতে পেল হারু কাকার বড় ছেলে রাজু। বললো কেন! আমাদের বন্ধু দিয়েছে!

পলাশ মুখ বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোদের আবার বন্ধু! কে রে সে? স্বয়ং ভগবান নাকি? এমন সুন্দর সুন্দর জামা দেয়…

হারু কাকার মেয়ে রুমা ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে, শুধু জামা নয় গো, সেই ষষ্ঠী থেকে পেট পুরে খেতে পাচ্ছি আমরা! রাহুল দাদা আমাদের খুব ভালোবাসে, বন্ধু তো এমনই হয়, তাই না দাদারা?

কারো মুখ থেকে একটাও কথা বেরোয় না আর।


রাহুলের বাবার কাজ চলে যাওয়ার পরে তাদের বড় কষ্টে দিন কাটছে এটা ঠিক, তবুও তার বাবা রাহুলের কোনো অভাব রাখেননা, ভালোবেসে সবচেয়ে ভালো জামাই কিনতে চেয়েছিলেন পুজোয়, কিন্তু কেনাকাটা করার তোড়জোড় শুরু হতেই রাহুল তার সারা বছরের জমানো টাকার ছোট্ট বাক্সটা বের করে সে বাবার হাত দুটো ধরে তার মনের ইচ্ছাটা বলে। হারু কাকার বড় ছেলে রাজু রাহুলকে খুব ভালোবাসে। পেয়ারা এনে দেয় বাগান থেকে পেড়ে, পুকুরে নেমে শিখিয়ে দেয় সাঁতার, কেবল ওরা স্কুলে যায়না তাই রাহুলের মা ওদের সঙ্গে মিশতে দেননা বিশেষ। কিন্তু রাহুলের এরকম প্রস্তাবে তার বাবার সাথে সাথে মাও খুব খুশি হয়ে ওঠেন, নিজে মুখে বলেন পুজোর চারদিন ওরা আমাদের লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী, আর কার্তিক হবে তবে। ওদের পেট পুরে খাওয়াবো। রাহুল তো আনন্দে একেবারে কেঁদেই ফেলে।


সৌম্য, বিজিত, পলাশ চয়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভিতর এক উথালপাতাল আফসোস। 

কিছুক্ষণ পরে রাহুল তার আগের বছরের পুরনো জামা পরে মণ্ডপে ঢোকে। রাজু ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে নেয় তাকে, নতুন আর পুরানো পোশাক মিলে গিয়ে সৃষ্টি হয় বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। মা দুর্গার মুখে মনখারাপ মনখারাপ ভাবটা কেটে গিয়ে আলো ফুটে ওঠে একরাশ... 

রাহুল চয়নদের বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়ায়...বন্ধু হবি ফের একবার?

-----------–-------

Sujata Mishra

সংরক্ষণ ও মধ্যবিত্ত মার্কশিট

 


আমার নাম পার্বতী, পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়।

মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষার মার্কশিট আর নিম্নবিত্ত উঠোনের

মালিকানা ছিল আমার।

খুব ছোটোতেই বাবার মারণ ব্যাধি ধরা পড়েছিল।

মাধ্যমিকের এক মাস আগে অস্তাচলে চলে গেল

আমার মাথায় অসুস্থ অভাবী হাত রাখার প্রথম সেই স্নেহ।


সাদা থানে মোড়া মা বুঝতো না ফসলের হিসেব।

বাসন মাজার কাজ চাইতে গেলে ভদ্র দরজা চমকে উঠলো, 

...সে কী! ব্যানার্জী বাড়ির বউ!

জমির ধান, আলু ঘরে তুলে নিল কাকা।

আমি আর মা একসঙ্গে লড়াই করতে করতে 

উচ্চমাধ্যমিকের আগে ঝরে গেল মা।

নিভু নিভু সূর্যের দিকে তাকিয়ে আমি আমার অস্তাচলের 

রাস্তা খুঁজলাম,

কাকা বললো, বেশ বেশ অত কান্নাকাটির দরকার নেই, 

থাকবি, খাবি তোর কাকিমার দুটো কাজ করে দিবি…


পাড়ার লোকে কাকাকে খুব হিংসে করলো,

দাদার সম্পত্তি পেয়েছে অথচ মেয়েটাকে পড়াবে না!

জেদ করে কাকা আমাকে ভর্তি করে দিল কলেজে।

কাকিমার হাঁড়ি মুখ আরো হাঁড়ি দেখতে দেখতে আমি

সপ্তাহে দু একদিন কলেজ যেতাম।

কালি ঝুলি মেখে কাজ শেষ হলেই পরীক্ষার পড়া

মুখস্ত করতাম।

কাকিমা খোঁটা দিত পুজোর জোগাড়ে ভুল হলেও,

বামুন বাড়ির অলক্ষ্মী একটা! কোনো কাজ জানে না!

কাকার মেয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে দেখিয়ে দিত,

ইস্ত্রির কোনখানে কোঁচ রয়ে গেছে।

আমার চোখে এত জল থাকতো যে পরীক্ষার প্রশ্নই

ভালো করে দেখতে পেতাম না।

তবুও মধ্যবিত্ত মার্কশিট ভরে চলেছি ঝোলায়।

বাবার জমির ফসল বিক্রি করে গয়না পরেছে কাকিমা।


আমার নিম্নবিত্ত উঠোনে একদিন ভীষণ রাগ নেমে এলো।

ঝোলা হাতে বেরিয়ে পড়লাম চুপিচুপি,

রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করলাম, কেউ ভিক্ষে দেবে!

দৃষ্টি থামিয়ে পথ বললো ...নাম কী?

ধীরে ধীরে বললাম, পার্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়।

পথ দ্রুত এগোতে লাগলো।

বললো, হবে না হবে না। সংরক্ষণ চাই!

ইংরেজিতে যাকে বলে রিজার্ভেশন, বুঝেছো!

ভিক্ষেতেও রিজার্ভেশন?

পথ বললো আমার সঙ্গে এসো, ওই যে অফিস

ওখানে যাও, বলো কাজ চাই!

আমি এক ছুটে এগিয়ে গেলাম, চকচকে দিদিমণির

সামনে সব মার্কশিট উজাড় করে দিলাম।

উনি উল্টে পাল্টে বললেন, নাঃ! একে বন্দ্যোপাধ্যায়,

তায় মান মধ্য, অন্য কোনো কিছু হলে নাহয় বুঝতাম!


বেরিয়ে আসতেই পথ বললো, ওই দেখো ছোট অফিস, 

বেতন কম। যাও গিয়ে বলো।

আমি ভিতরে ঢুকে ঝোলা খুলতেই একমুখ দাড়ি বাবু

হাঁ হাঁ করে উঠলো, এ কী! এত ডিগ্রি! না না 

আপনার মর্যাদা রাখতে পারবো না এখানে সব ওই প্রাইমারি!

আমি ছিটকে বেরিয়ে এলাম।

পথ খুব জোরে হাসলো,

বাতাস আমার কানের পাশে এসে কেটে কেটে বলল

একে পার্বতী, দুইয়ে বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনে অসংরক্ষণ!

চারে…


আমি ছুটলাম, কেবল ছুটলাম।

নিম্নবিত্ত উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম।

আমার চারিদিকে গিজগিজ করছে কাকার লোভ,

কাকিমার গয়না, মধ্যবিত্ত মার্কশিট, অসংরক্ষণ আর

এত বড় পদবী ...বন্দ্যোপাধ্যায়!

আমি আমার পায়ের তলার মাটিতে আছাড় খেলাম বারবার!

চিৎকার করলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে…

আমি যদি পার্বতী, তবে আমার নটরাজ কই?

যে আমার দেহ কাঁধে নিয়ে ক্রোধে উদ্দাম নৃত্য করতে করতে বলবে, সংরক্ষণ কেন!

পদবী কেন?

নামের পরে শুধু মানুষ নয় কেন?


আমি পার্বতী, পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়।

মাটির ভিতরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে আমার ঝোলা

মধ্যবিত্ত মার্কশিট, আর নিম্নবিত্ত উঠোন।

শুধু কোনো নটরাজ এলো না আমার শরীরের এই বোঝ

কাঁধে তুলে নিতে।

এত বড় পদবী আর সংরক্ষিত সম্মানকে পীঠে ছড়িয়ে দিতে!

যদি দিত তবে সে সব পীঠের নাম হতো, 

না-সংরক্ষণ পীঠ, না-ভিক্ষা পীঠ, না-পদবী পিঠ।


আমি গর্ভ গৃহে প্রবেশ করে যাচ্ছি ক্রমশ!

চারিদিকের সংরক্ষণ সংরক্ষণ চিৎকারটা 

ঢাকা দিয়ে দিচ্ছে আমার অস্তিত্ব।


অনেক বছর পরে এক কবি এসে মাটির গন্ধ শুঁকে

তার খাতায় লিখে নিল, 

এই মাটিতে ডুবে আছে আনন্দ! 

সৃষ্টির কোনো সংরক্ষণ হয় না যে!

----------------------

Sujata Mishra