তুমি আমার কাছে সবচেয়ে কাছের ঠাকুর।
ঠাকুমার অজস্র সিঁদুর মাখা আমশখা ঘট
মূর্তির মত ঠাকুর নও,
তুমি আমার প্রাণের ঠাকুর।
ঠাকুমাকে লুকিয়ে মা একদিন আমার হাতে
তুলে দিয়েছিল তোমায়, বলেছিল এই যে
সহজ পাঠ। রবি ঠাকুর।
তারপর থেকেই তুমি আমার ঠাকুর হয়ে গেছ।
অভ্যাসটা এমন হয়ে গেল, সুখে দুঃখে প্রেমে
তোমাকেই ধরলাম আঁকড়ে।
রাতের বালিশে তোমাকে রাখলাম।
আমার দু চোখ দিয়ে পুজো করলাম,
আমার এলোচুলে মিশে গেল রাত্রি।
ঘুমের মধ্যে তোমার স্পর্শ পেলাম কপালে।
এসব কথা কেউ বিশ্বাস করে না, জানো।
একবার বলেছিলাম প্রেমিককে।
ও খুব হেসে বললো, 'তবে তোর ঠাকুরকে
আমায় দেখাস তো একদিন।'
তারপর আর বলিনা।
আমার সেই প্রেমিক আমায় ছেড়ে গেল।
আমার বাবা, আমশখা পুজো করা ঠাকুমা
চলে গেল।
তারপর যেদিন আমার মাকে নিয়ে গেলাম
পাহাড়ে, ভোরের সূর্যোদয়
দেখতে দেখতে মা আমায় চিৎকার করে বললো
…'খুকু! ওই দেখ মেঘ!'
আমি বললাম, মেঘই তো!
মা আরও উত্তেজিত হয়ে বলল,
'ওই দেখ মেঘ সাজিয়ে ঠাকুর এঁকে রেখেছে রে!'
শুভ্র সাজে সজ্জিত মেঘ, আমার ঠাকুর
আমার মায়ের ঠাকুর। দুহাত তুলে প্রণাম
করলো মা।
আমিও।
আমার আর মায়ের ঘরে এখন শুধুই তুমি, তুমিই।
বইয়ে গল্পে কথায় খাবার টেবিলে শুধুই তুমি ছিলে।
তারপর একদিন পাহাড়ের অসুখ হলো এক।
তোমার সামনে তোমার ছবিতে মালা দিতে দিতে
মা চলে গেল, তোমার ভুবনে।
যাওয়ার আগে বলে গেল, 'খুকু, আজ ঠাকুরের বাড়ি
যাচ্ছি। তুই কাঁদিস না। আজ যে বাইশে শ্রাবণ।'
মায়ের শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করলাম তোমার সামনে নতজানু হয়ে।
তুমি আমার এখন একলা ঠাকুর।
বুকের মধ্যে চেপে ধরার,
একলা বালিশের পাশে থাকার ঠাকুর।
একদিন আমার অন্ধ পথে কিছু অসুর দেখলাম
আমার দিকে তাকিয়ে আছে জিভ দিয়ে।
তারপর চারদিক থেকে চারজন আমাকে জড়িয়ে ধরলো
তাদের নোংরা দৃষ্টি দিয়ে।
আমার ব্যাগ ছিঁড়ে গেল।
তোমার ছবিটা বাঁধিয়ে আনছিলাম সেদিনই।
তুমি পড়লে রাস্তার ধুলোয়।
আমার ঠাকুর ধুলোয় মাখামাখি!
সঙ্গে সঙ্গে তোমায় তুলে নিলাম বুকে।
চারজনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলাম তোমার ঘায়ে।
শক্ত ফ্রেমের আচম্বিতে ঘা খেয়ে তারা
হকচকিয়ে গেল।
পথও অন্ধত্ব ভুলে কালবৈশাখীর ঝড় তুললো হঠাৎ।
অন্ধ হলো তারা চারজন।
আমি তোমার ভাঙা ফ্রেমের তোমাকে বুকে
জড়িয়ে নিয়ে এলাম ঘরে।
খুব কাঁদছিলাম সেদিন জানো ঠাকুর।
হঠাৎ শুনতে পেলাম পাড়ার মাইকে বাজছে
'...আজ পঁচিশে বৈশাখ, বিশ্বকবির জন্মদিন।'
সম্বিৎ ফিরলো আমার।
আমার কবির জন্মদিন। আমার ঠাকুরের জন্মদিন।
সুন্দর করে পায়েস বানিয়ে রেখে এলাম মেঘের নিচে।
তোমার মেঘের প্রতিচ্ছবি থেকে নেমে এল বৃষ্টি।
আমার পায়েসের বাটি শূন্য হলো।
বৃষ্টি থামার পরে দেখি তোমার প্রতিচ্ছবি মেঘের মুখে
লেগে আছে পরমান্ন।
আমি তোমায় জড়িয়ে নিলাম বুকের ভিতরে
হৃদয়ে।
এবার তুমি আমার ঠাকুর
আমার প্রাণের মানুষ হলে।
আমার প্রাণের মানুষ
আমার নিজের মানুষ…
পঁচিশে বৈশাখ আমার একলা বুকে জন্ম হলো
প্রেমের।
আমার সহজ পাঠের ঠাকুরের জন্ম হলো
জীবন জোড়া প্রেমিকের।
এরপর থেকে যে আমার এলোচুলে বুলিয়ে দেবে
আদর, ভেজা চোখে সুখ।
এর পরের শ্রাবণে তুমি
আমায় তোমার মেঘের পাশে রাখবে তো?
তোমার মেঘের গায়ে আমার জলবিন্দু
আদর পাবে তো?
বলো না ঠাকুর, মেঘমুলুকে আমার রবির বুকে
আমি ঠাঁই পাবো তো?
------------------
SUJATA MISHRA