রামকিঙ্করবাবুর পাতলা চুলে যখন বয়স উঁকি দিচ্ছে রসিকতায়, সেই সময় তাঁর গায়ে ফুটলো বিয়ের টাটকা ফুল। ঘরে এলো সুন্দরীবউ। যে কিনা একেবারে ছেলেমানুষ। মুখে হাসি মেলায়না কখনো তার, আদর-সোহাগ-শাসন সবেতেই হাসিমুখী সে। ছোটজায়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করা থেকে শাশুড়ির পান সেজে দেওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে তার রসিকতা। পাড়ার কচি মেয়েরাও আসে তাদের পুটু বৌদির কাছে রসের ভাগ নিতে। রামকিঙ্করবাবুরও বউ নিয়ে স্ফূর্তি আর ধরেনা।
কিন্তু বউয়ের দোষ একটি কেবল। প্রতিদিনের মেনুতে বেগুন তার চাই। এদিকে শাশুড়ির আবার তাতে এলার্জি ভীষণ, তাই যে বেগুন সাপ্তাহিক বাজারের থলিতে স্থানই পেতনা কখনো সেটাই এখন রান্নার কড়াইয়ে তেলের সঙ্গে ফুটছে চড়বরিয়ে। খাওয়ার পাতে বেগুন নাহলে নতুনবউ কিচ্ছুটি মুখে দেবেনা, আবার ওই বেগুন দর্শনেই শাশুড়ির গাত্রজ্বালা। নিত্য অশান্তি শুরু হলো সুখের বাড়িতে। হাসিমুখী পুটু গোসাঘরে খিল দিত নইলে শাশুড়ি ভাত ফেলে পান গুঁজে বসতেন চিলেকোঠায়।
রামকিঙ্করবাবু পড়লেন মহা ফ্যাসাদে। এমতাবস্থায় বউকে নিয়ে চললেন শ্বশুরবাড়ী। পুটু শাশুড়িকে প্রনাম করতে গেলে তিনি বললেন, ‘বাছা, বেগুন প্রীতিকে নদীতে দিয়ে কিন্তু এসো।’
দিনসাতেক পরে রামকিঙ্করবাবু ফিরে এলেন একা, সঙ্গে একজন উড়ে বালক। পুটু কোথায় বা তিনি কেন এমন বিধ্বস্ত এইসবের উত্তর দিল ওই উড়ে বালক ভাঙা ভাঙা বাংলায়। ঘটনা হলো এই, শশুর বাড়ী থেকে নদী পথে ফেরার সময় পুটু নৌকা থেকে পড়ে যায়। অনেক খোঁজার পরেও পাওয়া যায়নি তাকে। আর শোকে অজ্ঞান রামকিঙ্করবাবুকে জ্ঞান ফিরিয়ে সঠিক ঠিকানায় নিয়ে এসেছে এই বালক, যার কিনা আবার তিনকূলে কেউ নেই।
উড়ে বালক পটল রামকিঙ্করবাবুর দেখাশোনার দায়িত্ব বেশ মনদিয়ে বুঝে নিল। খাওয়ানো স্নান করানো ঘুম পাড়ানো সব করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির অন্যান্য কাজও করে বেশ পরিপাটি। ভালোমত বেগুন ভাজা বেগুন ভর্তা বেগুন পোস্ত বানিয়ে পুটুর শ্রাদ্ধ সম্পন্ন হলো। রাত্রে ক্লান্ত শাশুড়ি তাঁর খাটে আচ্ছন্ন ঘুমের মধ্যে হঠাৎ যেন গায়ের উপর কার স্পর্শ পেলেন। ধড়ফড় করে উঠে বসে দেখলেন তাঁর পাশেই বসে পুটু। তিনি ভয়ে চিৎকার করার আগেই মুখ চেপে ধরে পুটু। , ‘মা, চ্যাঁচাবেন না। আমি মানছি আমি ভূত, তাও লজ্জা করবে না বলুন! শাশুড়ি কখনো বউকে ভয় পায়?’
পরদিন সকালে উঠে বাড়ির ছোট ছেলে শ্যমকিঙ্কর দেখে মা উঠোনের মাঝখানে বসে বেগুন চারা বসাচ্ছে। ‘এ কি মা, কি করছো এসব? আমাদের বাড়িতে কেউ তো পছন্দ করেনা বেগুন, আর তোমার তো এতে এলার্জি, তবে কেন বসাচ্ছ মা?’ কোনো উত্তর দেয়না শাশুড়ি রমা দেবী। এরপর দুপুরের পাতে সবার ভাতের উপর বসানো থাকে দুটো বেগুনভাজা। মায়ের কড়া নিয়ম এ খেতেই হবে। শাশুড়িও খায় রোজ। বাড়ির উঠোন ভরে যায় বেগুন গাছে। টাটকা সতেজ বেগুন কালো সাদা রঙে ভরিয়ে রাখে উঠোনের মন।
রাত্রে বিছানায় শাশুড়ির পাশে এসে বসে ভূত পুটু। চুলকে দেয় পিঠ হাত পা। তারপর এলার্জির ওষুধ মালিশ করে ঘুম পরিয়ে দিয়ে তবে ভূতপুরিতে ফিরবে সে। বাড়ির কেউ বুঝে পায়না মায়ের পরিবর্তনের রহস্য কি।
পটল এখন বেগুনের নানারকম রেসিপি বানায়। বেশ ভালো রাঁধে ছেলেটা। শাশুড়িও হাত চেটে খায় সেসব। রামকিঙ্করবাবু আবার পটলকে কখনো চোখের আড়াল করেন না। একদিন তো ছোট বউ মঞ্জুর 7 বছরের মেয়ে দেখে এসে মাকে বলে, ‘মা মা জানো তো, জ্যেঠু না পটল কে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিল দুপুরে, আমি দেখেছি।’ কি হাসি তখন পাড়ার ননোদিনী দের সঙ্গে মঞ্জুর মহিলামহলে।
সেদিন ছিল শাশুড়ি রমার জন্মদিন। খাবার টেবিল সাজানোর ব্যস্ততা তুঙ্গে। অন্য খাবারের সঙ্গে আছে বেগুনেরই আঠারো রকম পদ। শাশুড়ি মা টেবিলে এসে কাটবেন গাছের সবচেয়ে বড় বেগুন, যেটা এই জন্মদিন উপলক্ষেই রাখা হয়েছিল সযত্নে। সেইটা ভেজে সাজানো হয়েছে মোমবাতির আলোর মাঝখানে। হাততালির আওয়াজের পর শাশুড়ি মা প্রথম বেগুন অংশটা তুলে দিলেন কয়েক মাসেই আপন হয়ে যাওয়া ছেলেটার মুখে।
বেগুন ভাজা খাওয়ার আমেজে চোখ বুজে আসে পটলের। আর উপস্থিত সকলের মুখ হাঁ হয়ে যায় হঠাৎ। ছেলেটি আমেজ করে বেগুনের সঙ্গে চিবচ্ছে তার সাধের গোঁফজোড়া। আর রামকিঙ্করবাবুর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠছে মুচকি হাসি।
কথা হয়ে ছিল পুটুর বাৎসরিকের দিন শাশুড়ি নিজে রাঁধবেন বেগুন বাহার। সেটাই হলো তবে বাৎসরিকে নয়, পুটুর সঙ্গে রামকিঙ্করবাবুর দ্বিতীয়বার বিয়েতে। বেগুনের মালায় মালাবদলের পরে শাশুড়ি মা নিজে হাতে খায়িয়ে দিলেন উড়ে পটল থুড়ি রসিক বৌমা পুটুর মুখে। বুদ্ধিটা অবশ্য ছেলের হওয়ায় কানমলা খেতে হলো তাকেও।
বেগুন বাড়ি কিন্তু ঈর্ষা এবং আফসোস এর ঠিকানা হয়ে উঠলো সকলের কাছে, ‘...রামকিঙ্করবাবুর বাড়ি খুঁজছেন?যে বাড়িটার বাইরের রাস্তায় পর্যন্ত বেগুনগাছ দেখবেন, আর মোড় থেকে হাসি পাবেন শুনতে, ওটাই বেগুন বাড়ি, না মানে রামকিঙ্করবাবুর বাড়ি।’
______________
Sujata Mishra